হাসপাতাল- এই জায়গাটাকে আমি যতটা ঘৃণা করি, ততটা ভয়ও করি। হাসপাতাল বলতে আমি বুঝি কাটাছেঁড়া, সুই সেলাই, ইঞ্জেকশন, লাশ, মর্গ, এমনকি ভয়ংকর ময়নাতদন্তও। অথচ এই হাসপাতালকে ভয় পাওয়া সেই আমি আজ ৯ দিন ধরে রুগ্ন রোগীর পরিচয় নিয়ে বেডে শুয়ে আছি। জ্ঞান ফেরার পর কলেজে রওনা দেয়া সেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম খুব পরিচিত এই হাসপাতালে। আচ্ছা এটা কি সেই হাসপাতাল, যেখানে আটাশ বছর আগে আমার মা ধুকে ধুকে মরেছে?
ডাক্তার সতীনাথ বাবু বললেন, আমি নাকি ভাগ্য জোরে বেঁচে আছি। মালবাহী ট্রাক আমাকে যেভাবে বেপরোয়া ধাক্কা দিয়েছে, এভাবে কোনো মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়। অচেতন আমাকে যারা রাস্তা থেকে এখানে তুলে এনেছেন, তাদের ধারণা আমি ততক্ষণে লাশ হয়ে গেছি। আমার শরীরের লালচে রক্তে নাকি হাসপাতালের সিঁড়িগুলো রঙিন হয়ে গেছে আর সে দৃশ্য দেখে নাকি এখানকার একজন হার্টের রোগী চিৎকার দিয়ে সমস্ত হাসপাতালের ডাক্তারদের মনে ভয় জাগিয়ে দিয়েছেন। আমি তখনো লাশ হয়ে যাইনি- ডাক্তার তদন্তে এই রিপোর্ট পেলেন। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন তারা।
এই ঘটনার তিন দিন পর এক পড়ন্ত বিকেলে জ্ঞান ফিরল আমার। দেখলাম বাবা নিরস মুখে আমার কেবিনে বসে বসে আমার ব্যান্ডেজ করা শরীর দেখে গলার ভেতর কান্না আটকিয়ে রেখেছেন, এবং সে কান্না জল হয়ে বাবার দুটি প্রবীণ চোখের কোণ বেয়ে গলে পড়ছে। আমি চোখ মেলেছি দেখে বাবা তার স্নেহশীল হাতে আমায় চেপে ধরেছেন..., ‘আব্বারে, কোথায় বেশি জখম লেগেছে? মাথায় না কোমরে, বল আব্বা!’ মিনমিনে গলায় বললাম ‘আপনি অস্থির হয়ে যাবেন না তো। আমার কিচ্ছু হবে না। বাড়ি থেকে কেউ আমাকে দেখতে আসেনি বাবা?’ মা কেমন আছে?’
বাবা লজ্জার ভঙ্গিমায় নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ না আসলে বাবার কী করার আছে! এই সড়ক দুর্ঘটনায় আমি যদি মারা যেতাম, খুশি হতেন কেউ কেউ, যাদের প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। অভিমানও নেই। আল্লাহর কসম। মাগরিবের পর পরই আমার কেবিনে আসা মানুষটাকে দেখে আমার দুনিয়া ভেঙে কান্না আসতে চাইল। আমি স্বয়ং মাকে দেখতে পাচ্ছি। মা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- ‘তুই কেমন আছিসরে বাবলু? আমাকে ক্ষমা করে দে। সতী সন্তান বলে তোকে চিরকাল নিন্দা করেছি।’ ঠোঁট কাঁপানো গলায় বললাম- ‘তাতে কী মা! সৎমা বলে আপনাকে কখনো অবহেলা করিনি। আমার বাবা তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আপনাকে বিয়ে করে সংসারের হাল ধরেছেন। আপনার দেয়া সব অপবাদ আর তিরষ্কার আমি মাটিচাপা দিয়ে দিলাম মা।’ আমি দেখলাম, যে মায়ের কাছে আমি রোজদিন ঘৃণার পাত্র ছিলাম, আজ সে মা সে ঘৃণার পাত্রের জন্য কী ব্যাকুল হয়ে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছেন। মিথ্যে ভালোবাসা অভিনয় করে বোঝানো যায়, কিন্তু সত্যিকারের চোখের জল দেখাতে কোনো অভিনয় লাগে না। এটা প্রকৃতিগত ব্যাপার। পরের দৃশ্যটি আমাকে পুরোপুরি আপ্লুত করে দিল। একি আমি সত্যি দেখছি? আমার তিন ভাই পলাশ, বিলাস, তিতাস নিরস মুখে আমাকে দেখতে এখানে এসেছে। এতটা কাল যে ভাইগুলো আমাকে সৎভাই ভেবে ১ হাজার মাইলের মতো দূরে রেখেছে, তাদের প্রত্যেকের ধারণা বাবা যদি সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেয়! এই অভিযোগে তারা আমাকে বিভিন্ন সময়ে অপদস্থ করে এসেছে। আমি তাদের সৎভাই- এই পরিচয় তারা তাদের বন্ধুদের কাছে দিত। দ্বিতীয় সংসারে তিন সন্তানের এমন কাণ্ডে বাবা প্রায়ই গভীর রাতে প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বসে থাকতেন।
আমার মা আর তিন ভাইয়েরা নার্সদের সাথে আমার রোগমুক্তির ব্যাপারে আলোচনা জুড়ে দিল। পলাশকে দেখলাম সতীনাথ বাবুকে খুব আকুল আবেদনে বলছে- ‘আমার ভাইয়া খুব দ্রুত সুস্থ হবে তো?’ মা বললেন ‘ও ডাক্তার বাবু, আপনারা ভালোভাবে চিকিৎসা করছেন তো?’
আমার মা ভাইদের কাণ্ড দেখে আমার দুনিয়া ভাঙানো কান্না আসছে। সৎমা আর সৎভাই বলে যারা সব সময় আমাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতো, আজ তারা তাদের সৎভাই হলেও রক্তের টানে কি গভীর ভালোবাসার আবেসে আমাকে কাছে টেনে নিচ্ছে। আমি যেন এক স্বর্গে আছি। এটাকে এখন আর আমার ভয়ার্ত আর ঘৃণিত হাসপাতাল মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে হাসপাতালের এই কেবিনটা আজ একটি সুখের স্বর্গ। ওই যে চেয়ারে অশ্রুত চোখে মা বসে আছেন, তিনি এই সুখের স্বর্গে পরিচালনাকারী।