শিশির কণার স্বপ্ন

শরিফুল ইসলাম

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাত সকালে ফোন! ইমার্জেন্সি ছাড়া ওই সময় কেউ ফোন করে না। বিছানায় আমি তখন মহাঘুমে। বোধহয় বিশ-পঁচিশ মিনিট আগেই ফজর পড়ে বিছানায় গেছি। সারারাতই আমি ফোন বন্ধ করে রাখি নানান রকম মেসেজের টোন এবং ফোন এর কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে বলে।

গতরাতে ফোন অফ করতে ভুলে গেছিলাম। ফোনের নম্বর চেক করলাম। অপরিচিত নম্বর। অনেকগুলো আননোন ডিজিট। সাধারণত এমন ডিজিট বাংলাদেশের বাইরের কোনো দেশের হয়ে থাকে। বাইরের ফোনের কল বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনের কল রিসিভ করলাম।

হ্যালো। হ্যালো এটা কি পাংশা, বাংলাদেশ? হ্যাঁ। আপনি কি শফিকুল? হ্যাঁ। আপনি কে? আপনি-আজ্ঞে করছো কেন? কে আপনি? আমি শম্পা আমি শম্পা নামের কারো সাথে পরিচিত নই। আমার আর একটা নাম আছে-সুইটি। আমি... বহুদূর থেকে ভেসে আসা কোনো সিম্ফনী যেন-একইসাথে মোহনীয় ছন্দের স্পন্দন এবং সাইক্লোন সৃষ্টি করে! সুইটি এ জীবনে ভুল হয় কী করে? মনে করতে পেরে খুব তীব্র ভোল্টেজের অনেকগুলো গালি ঠোঁটের কাছে ভিড় করতে থাকে। কী ব্যাপার, শফিকুল, শুনতে পাচ্ছো না? আমি সুইটি! হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। তবে চিনতে পারছি না। আমি একটু ঝাঁকাতে চাই সুইটিকে। কোন মতলবে এতদিন পরে ফোন করেছে কে জানে! হ্যাঁ, সুইটি আপনি পরে ফোন দিয়েন। আমি... না আমি এখনই তোমার সাথে কথা বলবো। আমার খুব হ্যাপি লাগছে। কেন? হ্যাপির কী হলো? কংগ্রাচুলেশন ড. শফিকুল ইসলাম! এ আবার কেমন সম্বোধন? ক’দিন পরে তোমাকে সবাই ড. শফিকুল হিসেবে সম্বোধন করবে। আমি আগে থেকেই শুরু করলাম। আমার পিএইচডি’র রেজাল্ট কি তবে হয়ে গেছে? সুইটি জানলো কীভাবে? সরি আমি ড. শফিকুল ইসলাম নই। মানে আমি এখনও রিসার্সের রেজাল্ট পাইনি! আমি পেয়েছি! আমি তোমার সব সংবাদ রাখি। আমি সিডনী থাকলেও তোমার কথা মনে আছে! আমাকে মনে রেখে তোমার লাভ কী? তোমার মতো ইতরের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না। আমার ক্ষতি যা করার করেছো। আমার পিএচডি’র রেজাল্ট আরো কত আগে হয়ে যেতো। নকিব স্যারকে সুপারিশ করতে কে বলেছিল তোমাকে? আমার স্বপ্নগুলোকে ধ্বংস করে দেবার পরেও দূরদেশে বসে একই খেলা তোমার শেষ হয়নি? সরি‌্য শফিকুল, আমি না তোমার বন্ধু? ছিলে একদিন। এখন পরম শত্রুর চেয়েও শত্রু। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। ফোনের মধ্যে কান্নার শব্দ। আমি ফোনটা পড়ার ঘরে অন অবস্থায় রেখে আসলাম। যার কান্নাতে সুখ- সে কাঁদুক। ক’দিন থেকে আমিও ভাবছিলাম পিএইচডি’র রেজাল্ট নিয়ে। ঈদের আগেই নকিব স্যার ইংগিত করেছিলেন। নকিব স্যার খুব কম কথা বলেন। তেমন হাসেনও না। এবার ফোনে স্যার আমার সাথে অনেক কথা বললেন। হাসিটা হয়তো সামনে থাকলে দেখতে পেতাম। মনটা হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে যায়। মনে মনে সুইটিকে দেওয়া গালিটা ফেরত নিই। একটা বেসরকারি কলেজে পড়াচ্ছি প্রায় বছর দশেক। চাকুরি পাবার বছর খানেকের মধ্যেই সুইটির সাথে বিয়ের কথা পাকা ছিল। ফল বেশি পাকলে যেমন খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে আমাদের বিয়ের কথাটাও বোধহয় বেশি পেকে গিয়েছিল। তাই হয়নি।

কলেজের পাশে বাসা হলেও সুহাস বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার জন্য কলেজের হোস্টেলে আসতো। রাত জেগে খেলা দেখা। খিদেটিদে লেগে যেত। তিন চারদিন খেলা দেখার পরে সুহাস বললো, শফিক চল আমাদের বাসায় খেলা দেখবো। চা-টা খাওয়া যাবে। সুহাসের বোন সুইটি। পরিচয় দুইহাজার দুই সালে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে। রাতজেগে খেলা দেখার ফাঁকে ঝালমুড়ি আর চা বানিয়ে দেবার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল সুইটি। বিশ্বকাপ খেলা শেষ হলেও আমার আর সুইটির মনের স্টেডিয়ামে নতুন খেলার জন্ম নেয়। সে খেলায় সুইটি জিতেছে আর আমি চরমভাবে হোয়াইট ওয়াশ হয়েছি সময়ের কাছে, সুইটিদের পরিবারের কাছে। মেয়ের বাবা-বড়ভাই সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য অনেককিছুই ভাবতে পারেন,করতে পারেন। কিন্তু মেয়েটি কি বলবে না তার ইচ্ছ-অনিচ্ছার কথা? মেয়েটির জোরালো মনোভাবের কাছে অভিভাবকেরা অনেকসময় কি নমনীয় হয়না ? সুইটি একবারও কেন বলতে পারলো না, আমি শরিফকে ভালোবাসি! আমি বেকার ছিলাম সত্যি। কিন্তু যোগ্য-শিক্ষিত মানুষ কি চিরকাল বেকার থাকে? একসময় আমাদের মনের নদীটা থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকা একটা নৌকা অন্য নদীর দিকে রওয়ানা হয়। সে নৌকা ফুলে-ফলে-রঙে-রসে ভরে ওঠে। অন্য নৌকাটা কোনোমতে ভেসে থাকে-সঙ্গিহীন-অসহায়- ভর্সিটিতে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। আগামী সপ্তাহে সিনেটের মিটিংয়ে আমার পিএচডি’র রেজাল্ট আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। আমি কাকে জানাবো? এই সংবাদে কেউ খুশি হবে এমন কেউই আমার নেই। অগত্যা প্রথম সংবাদদাতাকে স্বপ্রণোদিত হয়ে ফোন করি, হ্যালো, সরি‌্য সুইটি! তুমি কেমন আছো শফিকুল? জানি না। এবার একটা বিয়ে কর। কাকে?

কাকে আবার? খুঁজবে-পছন্দ করবে। এতদিন মাস্টারি করলে - কোনো ছাত্রীকে মনে ধরেনি? মনের আয়নার পারদ তো সুইটি নামের একজন নষ্ট করে মহাসুখে বিদেশে আছে। কী করে আর নতুন কোনো ছবি মনে ধরে? সুইটি বিদেশে খুব ভালো আছে না? শফিকুল তুমিও তাই ভাবো? না ভাবার কী আছে! না তুমি ভাবতে পারো না। আমি খুব কষ্টে আছি শরিফুল। হাফিজের সাথে গত আগস্টে সব চুকেবুকে গেছে। ডিভোর্সের পরে অস্ট্রেলিয়ার নিয়মানুযায়ী অনেক টাকা-পয়সা পেয়েছি । ফ্ল্যাট কিনেছি । এখন একটা চাকুরিও করি। শরিফুল, তুমি এদেশে চলে আসো আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি... কথা শেষ না করে ফোনটা বন্ধ করে দিই। শেষ পর্যন্ত কথার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ফোনটা অফ করে ছুঁড়ে ফেললাম মেঝেতে। কোথায় গিয়ে সেটা পড়লো, অক্ষত থাকলো কি না সে হিসেব করতেও চাইলো না মন!