ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ওয়ালী কিরণ : বরেন্দ্রভূমির লালমাটির কবি

আনোয়ার কামাল
ওয়ালী কিরণ : বরেন্দ্রভূমির লালমাটির কবি

কবি ওয়ালী কিরণ তার নিজের সম্বন্ধে বলেছেন, ‘কবিতা- আমার জীবন থেকে উঠে আসা। বাল্যকালে বছর দশেক উপজেলা পর্যায়ে আর গ্রামপর্যায়ে দাদার বাড়িতে প্রাইমারি স্কুলে বছর দেড়েক- এই ক’বছরই বলা যায় গ্রামজীবন। তারপর থেকে রাজশাহী সিটিতে অথবা অন্যান্য জেলা সদরে। দাদা-দাদির মৃত্যুর পর দেশের বাড়িতে কেউ না থাকায় (আমার পিতা দাদা-দাদির একমাত্র সন্তান) পিতা ও আমার শহরবাসী হয়ে যাওয়ায় গ্রামের বাড়ির সঙ্গে যোগসূত্র কমতে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নেয় প্রচণ্ড স্মৃতিকাতরতা। বাল্যজীবনের স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।’এই যে শেকড় ছেঁড়া অভিবাসন- তা তাকে প্রচণ্ড মনোকষ্টে ফেলে দেয়। স্মৃতি সবারই থাকে কিন্তু কবিরাই সম্ভবত সর্বাধিক স্মৃতিকাতর। অবশ্য কোনটা স্মৃতি নয়? অভিজ্ঞতা জ্ঞানপঠন-পাঠন- সবই তো স্মৃতি। ওয়ালী কিরণের কবিতা একই সঙ্গে নাগরিক ও গ্রামীণ বোধসম্পন্ন। স্মৃতিতাড়িত হয়ে প্রায়ই মোটরবাইকে দেশের বাড়ি (ভাতুড়িয়া, মোহনপুর, রাজশাহী) চলে গেছেন, প্রকৃতিকে প্রাণভরে দেখেছেন, প্রকৃতির রূপ-রস থেকে শুষে নিয়েছেন নির্যাস। গ্রামের পুরাতন পরিত্যক্ত মাটির সড়কগুলো খুঁজে বের করে সেসব রাস্তায় ভ্রমণ করে করে মাটিলগ্ন মানুষের প্রকৃত প্রতিভূ সন্ধান করে ফিরেছেন। এভাবেই তিনি বাংলার প্রকৃতিতে ঢুকে তার রস আস্বাদন করেছেন। বাস্তবে সেটা ছিল তার অতি পরিচিত বরেন্দ্রভূমি- মোহনপুর, বাগমারা, তানোর, কাঁকনহাট ইত্যাদি এলাকা। বরেন্দ্রভূমির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে লিখেছেন দীর্ঘ কবিতা ‘উৎসভূমি’। কবির জন্মভূমি বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে দূরে হলেও কবির বেড়ে ওঠা, দুরন্ত কিশোর সময় আর যৌবনদীপ্ত পদভারে উদ্দীপ্ত সময় কেটেছে এখানে। আবার তার কর্মময় জীবনও তাকে বুকে আকড়ে রেখেছে এই বরেন্দ্রভূমি। কাজেই, তার কবিতায় বারংবার ফিরে এসেছে সেই বরেন্দ্রপ্রেম। বরেন্দ্রভূমির মানুষ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর তাদের জীবনাচার তার কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠে এসেছে। সাওতালদের জীবন সংগ্রাম তার কবিতায় উপজীব্য হয়ে ধরা দিয়েছে। সাওতালদের জীবন সংগ্রাম, তীর ধনুক নিয়ে নগ্নপায়ে কালো কালো বালকদের সংগ্রামী জীবন কবিকে আবেগী করে তোলে। যা তার কবিতায় অনন্য মাত্রায় এ অবহেলিত সম্প্রদায়ের জীবনগাঁথা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আবার এই বরেন্দ্র অঞ্চলের লালমাটি, এটা যে তার দেশ, তার পিতা-পিতামহের শেকড় গাড়া মাটি। বটের ঝুরির মতো প্রাচীন শেকড় যেন কবির শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। কারণ, এ অঞ্চল যে কবির কাছে পিতৃভূমিতূল্য।

চাট্ জমকিয়া.../চাট্ জম্কিয়ারে..../চাট্ জম্কিয়া.../ওই যায় সাঁওতাল কাঁধে/জোড়া বনবিড়ালের ভারা,/তীর ধনু ফালা হাতে/পেছনে পেছনে ধায়/নগ্নপ্রায় কালো বালকেরা। / [ উৎসভূমি ]

এই তো আমার দেশ/বরেন্দ্রভূমি,/আমাদের পিতা পিতামহদের/উৎসভূম...উৎসভূমি/এই লালমাটি। শেকড়বিহীন নই নিশ্চিত; / বটের ঝুরির মত/প্রাচীন শেকড় এক/শিরায় শিরায় বহমান। [ উৎসভূমি ]

সাঁওতালদের সেই চাট্ জমকিয়া চাট্ জমকিয়ারে হাঁক ডেকে তীর ধনুক আর ফালা নিয়ে শিকারের সন্ধানে বনবাদাড়ে ছুটে যাওয়া আর বনবিড়াল শিকার করে নিয়ে ফিরে আসা। কবির চোখে এসবই ধরা পড়ে। কবি তার পূর্বপুরুষের উৎস খুঁজে বেড়ান। এখানেই তার পূর্ব পুরুষরা বটের ঝুরির মতো একদিন শেকড় গেড়েছিলেন। কবি তারই উত্তরসূরি। কবির ভাবনায় পূর্বপুরুষদের গৌবরগাঁথা জীবন সংগ্রাম তাকেও ছুঁয়ে যায়; কবিও উত্তরসূরি হিসেবে সেই সংগ্রামী জীবনের অংশীদার। কবিরা সাধারণত স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন। স্মৃতিময়তা ভর করে কবির মনের অবচেতন মনে। কবি তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ইচ্ছা করলেও পারেন না। কবি ওয়ালী কিরণও পারেননি। তাই তো তার কবিতায় আমরা তাকে স্মৃতি রোমন্থন করতে দেখি; দেখি তিনি তার হিরণ¥য় স্মৃতিগুলোকে প্রতিদিন দুধকলা খাইয়ে পুষে রাখেন। এমনি অনুভূতির কবিতা আমরা নিচের কবিতা পাঠে দেখতে পাই। স্মৃতিপুষি পুষি মিনি বেড়াল স্মৃতির,/প্রতিদিন দুধকলা স্মৃতিকে খাওয়াই,/স্মৃতিকে রমণ করি, শৃঙ্গারও করি। [ মিউজিয়াম, মগ্নপ্রতীক ]

ঝুলে গেছো একদিকে/পাল্লার, তুমি তো আসলে আত্মরতির অবতার!/কিসের অহংকার তোমার/জড়িয়ে রয়েছো তুমি নিজেকে যখন? [ সর্পমিলন, মগ্নপ্রতীক ]

কবির চোখে আজকাল বৃক্ষ কিংবা মানুষ চোখে পড়ে না। সবকিছু জল ও জলজ দেখায়। সমাজের সব ক্ষেত্রে তোষামোদি আর চাটুকারে ভরে গেছে। যা দেখে কবি বসে থাকতে পারেন না। তাই তিনি কবিতার ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলেন, জলের রূপকে অলংকারিত করেন চাটুকারীদের কায়কারবার। আসলেই তাই, কবি স্বভাবে তো সমাজের যে কোনো অসংগতি তাকে নাড়া দেবেই দেবে। কারণ, সমাজের নানা অসঙ্গতি কবিকে তাড়িত করে, কিছু মানুষ নিজেকে জলের মতো মিশে যেতে সহজেই কত ধরনের যে ভেক ধরেন তার ইয়ত্তা নেই। আর কবি ওয়ালী কিরণকেও তাই তাড়িত করে তার বিবেক, তাকে উদ্বুদ্ধ করে কবিতায় শাণিত হতে। তাইতো তিনি লিখে তা প্রকাশ করেন- আজকাল বৃক্ষ কিংবা মানুষ দেখি না,/শুধু জল দেখি/জল ও জলজ দেখি, /জলস্বভাবী জল, চাটুকার জল,/আর কত প্রকার যে জলাধার! /এই যে অসংখ্য জলছাপ দেখি/একি জলাতঙ্ক নাকি? [ জলজবোধ, মগ্নপ্রতীক ]

কবি গভীরভাবে সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন। ফলে, তার কবিতায় বরেন্দ্র রমণীদের দেখা যায়। আর বরেন্দ্র রমণীর কেশ জীবনানন্দীয় আবহে তার কাছে ধরা পড়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের কবি ওয়ালী কিরণের চোখে বরেন্দ্র রমণীর তছনছ হয়ে যাওয়া, কবিকে আবেগে তাড়িত করে। তার দেখা কেশবহুল রমণী তাকে প্রতারিত করে; কৌশলী এ মরণীকে কবি উপলব্ধি করতে পারেন ঠিকই। বরেন্দ্র অঞ্চলের বৃক্ষরাজি কবিকে অকপটে আহ্বান করেছেন। অথচ বরেন্দ্র রমণী কৌশলে পুষ্পার্ঘ্য পদতলে রেখে তাকে অবহেলা করেছে, কবি তাকে স্মরণে রেখেছেন আপন মহিমায়। কবির বেদনা বরেন্দ্রভূমিতে আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয়েছে। কারণ, কবি যে বরেন্দ্র অঞ্চলকে আপন করে তার সাথে জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন। সমস্ত প্রেক্ষাপটই তছনছ বরেন্দ্র রমণী;/বলো, রাখলে কি তোমার কেশবহুল শিরে?/ বৃক্ষ রাখে অকপট আহ্বান, অথচ তুমি/কৌশলে পুষ্পার্ঘ্য পদতলে রেখে/ফুলভারমুক্ত রেখেছিলে কেশ।

[ বরেন্দ্র রমণী, মগ্নপ্রতীক ]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত