ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কবি আসাদ চৌধুরী স্মরণে

তৃণে ছাওয়া আদিম ঠিকানা নানা বোধের হিরণ্ময় পঙ্‌ক্তিমালা

আনোয়ার কামাল
তৃণে ছাওয়া আদিম ঠিকানা নানা বোধের হিরণ্ময় পঙ্‌ক্তিমালা

বাংলা কবিতা মননবুদ্ধি-তর্কজটিল চিন্তাভার থেকে মুক্ত এক নির্ভার নন্দনক্রীড়া। মনন নয়, স্বজ্ঞা ও সংবেদনই কবিতার আশ্রয়- যেহেতু প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও আধিপত্যের চেয়ে এখানে প্রকৃতির প্রভাব বেশি। স্বজ্ঞা দিয়েই বোধ্য করা হয়েছে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানকে। প্রযুক্তিসর্বস্ব নই বলে আমাদের মানসিকতাটা হয়ে উঠেছে প্রকৃতির সঙ্গে তদ্গতচিত্ত। এই প্রকৃতি দুর্বোধ্য, অজ্ঞেয়, নিত্য পরিবর্তনশীল হলেও তা পরমাত্মীয়। প্রযুক্তি বানিয়ে তোলা যায়, তার উৎকর্ষ ঘটানো যায়, ব্যাখ্যাও করা যায়। কিন্তু প্রকৃতিময়তা উপলব্ধির বিষয়, কেননা তা নিজেই উদ্ভুত ও মূর্ত হয়। [বাংলা কবিতার কতিপয় রূপকল্প: বিবর্তনের রূপরেখা, বেগম আকতার কামাল; ‘কবিতার নান্দনিকতা প্রচীন ও মধ্যযুগ’]

আমরা কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতায় এই ধরনের নান্দনিক সুর ব্যঞ্জনায় মোহিত হই। তার কবিতায় দেশ-জাতি-জাতীয়তাবাদ, স্বদেশপ্রেমণ্ডমুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতিময়তা, আধ্যাত্মিকতা আর দেশাত্মবোধ মূর্ত হয়ে ওঠে। এমনি একটি কবিতাগ্রন্থ ‘তৃণে ছাওয়া আদিম ঠিকানা’য় আমরা তারই বাঙময় সুর ব্যঞ্জনা অনুরণিত হতে দেখি। যে চলে গেছে কেবলমাত্র সেই জানে কোথায় তার ঠিকানা, পরপারে কী আছে? তা কেবল সেই জানে, অন্য কারো জানবার কথা নয়। যে-যায় সে শুধু জানে/কোথায় মঞ্জিল/ কী আছে অপেক্ষা করে তার,/কাঁপা কাঁপা পাত্র হাতে/রেশমি রুমালে-ঢাকা মুখ,/নাকি সোনার শিকল? [পথের কাব্য]

প্রেমের কবিতায় আসাদ চৌধুরীর জুড়ি মেলা ভার। তার কবিতায় প্রেমের সিম্ফনি ধ্বনিময় হয়ে ফিরে আসে ইথার তরঙ্গে। প্রেমিকার শাড়ির আঁচলে পরম শান্তিতে দুদণ্ড ডুবে থাকার চাইতে আর কি মধুময় সুখ পাওয়ার থাকে? তাই তো তিনি তারই এক সরল বয়ানে জানান দিচ্ছেন- ক্লান্তমাথা রেখে দুদণ্ড শান্তির পরশ পেতে শাড়ির আঁচলই তার শ্রেয় জায়গা।/যতো দূরে যেখানেই যাই/ঘুরেফিরে তোমারই আঁচলের নিচে/ ক্লান্ত মাথা রাখা,/তোমার শাড়ির পাড় মনে এনে/দুদণ্ড শান্তিতে ডোবা। [ঘুরেফিরে]

আমাদের দেশবরেণ্য প্রধান কবিদের অন্যতম কবি সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণে কবি আসাদ চৌধুরীও অন্যান্যের মতো গভীর মর্মপীড়নে ব্যথিত হন। তাই তো তিনি কবিতাগ্রন্থের নাম শিরোনামীয় কবিতায় ‘তৃণে-ছাওয়া আদিম ঠিকানায় তাকে গভীর মমতায়, শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। কবি চিত্রকল্প এঁকেছেন, কবির মরদেহ হেলিকাপ্টারে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার নিজ এলাকা কুড়িগ্রামে। সেখানে বানের পানির মতো পরাণের ভেতরে গহীন ভালোবাসা নিয়ে কবি ফিরে যাচ্ছেন, তার প্রিয় মাটির কাছে। আদতে সেখানেই তো আমাদের ফিরে যেতে হয়, ফিরে যেতে হবে। যে কবি দেশ মাটি আর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চৌষট্টি হাজার গ্রাম বুকে পুরে রেখেছিলেন, তাকে আজ বিদায় সম্ভাষণ দেওয়া হচ্ছে। বাঙলার আলো-বাতাসে আবহমান বাংলার সুরের মূর্ছনায় ছেয়ে যাওয়া বাঁশি আর একতারা-দোতারায়।

বুকে পুরে চৌষট্টি হাজার গ্রাম/দুঃখী হেলিকপ্টার আকাশে/যাচ্ছে কুড়িগ্রাম/মানুষ আসতাছে বানের লাহান/পরাণের গহীন ভিতর থরে থরে/বাঁশি আর দোতারা একতারা/ [তৃণে-ছাওয়া আদিম ঠিকানা]

মানুষ তার বয়স সত্যিই ভুলে যায়। পায়ে পায়ে মানুষের বয়স বাড়ে, আর মৃত্যুর দিকে তার ধাবিত হওয়ার সময় এগিয়ে আসে। আসলে আমরা ভুলে যাই, বেমালুম ভুলে যাই। ক্লান্ত পায়ে আমাদের বয়সের ভারে একদিন চলে যেতে হয়- না ফেরার দেশে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম কে ভাঙতে পেরেছে কোন্ কালে? তাই তো কবি বয়সকে স্মরণ করে লিখেছেন, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আমরা। নিজেকে চেনার, জানার মোহে বিভোর হয়ে থাকি, বেসুমার থাকি। শপথ ভুলে যাই, পথ হারিয়ে ফেলি। আবার আমাদের ভেতরের পাখির কি কোনো খোঁজ আমরা পাই। কবি আসাদ চৌধুরীও তার ‘যে পাখির নাম জানিনে’ কবিতার লালনের মতো করে সেই খাঁচার ভেতর অচিন পাখির সন্ধান করেছেন। কবি পাখির বাসার সন্ধানে ব্যস্ত, পাখি দেখতে কেমন? কি-ইবা তার রঙ। এমন তরো প্রশ্নে সামনে দাঁড়িয়ে কবি খুঁজে ফিরছেন তার জিজ্ঞাসার সাতরঙ। ‘বয়স’ ও ‘যে পাখির নাম জানিনে’ এ কবিতা দুটি পাঠ করলে আমরা তার ভেতরে আধ্যাত্মিকতার সুর অনুরণিত হতে দেখি। ভাবের মিশ্রণ দেখতে পাই তার সরল বয়ানে। আসলে প্রতিটি মানুষই ভাবের জগতে বসবাস করে। তবে একেক জনের সুর একেক ধরনের, ভিন্ন তাল, লয় ধারণ করে কবিতায় মজে থাকেন। কবি আসাদ চৌধুরী ভাবে ডুবে যান নিমগ্ন হয়ে পড়েন যখন তিনি আধ্যাত্মিকতায় অচ্ছন্ন থাকেন। প্রতিধ্বনি বেমালুম ভুলেছে শপথ/নিজেকে চেনার লোভে/ক্লান্ত দুই পা’য়/ ধরি তার পায়ে-চলা পথ। [বয়স] যে পাখির নাম জানিনে/ কেউ কি তার বাসা চেনে?/ কী রঙের? দেখতে কেমন?/ আমি তার খোঁজ রাখিনি। [যে পাখির নাম জানিনে]

প্রিয়কবি রফিক আজাদের বিয়োগ ব্যথায় কাতর হয়ে কবি তার অনুভূতিতে লিখেছেন- মানুষ তো একদিন তার স্ব স্ব আয়ুষ্কাল শেষে তাকে মাটির কাছে ফিরে যেতেই হয়। তার চলে যাওয়ার আগে রেখে যান নিজস্ব কর্মময় জীবনের দীপ্তিময়তা। কবি তাই বলেছেন, কবি চলে গেলেও তিনি তার সৃষ্টিশীল কাজের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকেন; যা বেঁচে থাকা মানুষগুলো পরম বিস্ময়ে তার কবিতার পঙ্ক্তি আওড়ে তাঁকে স্মরণে রাখেন। আসাদ চৌধুরী সে কারণেই কবি রফিক আজাদের মৃত্যুতে তার কবিতার প্রতিটি শব্দের মধ্যে পরম মমতায় সান্নিধ্য ফিরে পাওয়ার বা কবিকে ফিরে পাওয়ার এক অনবদ্য কথামালা তুলে ধরেছেন তার ‘রফিক আজাদ’ কবিতায়। যার যার ক্ষেত্র থেকে নিজস্ব ফসল/তোলা শেষ হলে /ঘরে ফেরা মানুষেরা কণ্ঠে নিয়ে গান/বিস্ময় ওড়ায়।/ কবিতার প্রতিটি শব্দের মধ্যে/সাধ্যমতো সান্নিধ্য কুড়াই। [রফিক আজাদ] রফিক আজাদের বিয়োগ ব্যথায় কবি আসাদ চৌধুরী আবারো ‘রফিক আজাদ: সশব্দে কাঁপিয়ে ঘরবাড়ি’ কবিতায় জানান দিলেন, কাউকে আগে আর কাউকে পরে যেতে হয়, যেতে হবেই। এই যে চিরায়ত সত্য- এ অমোঘ সত্যকে অস্বীকার করবার কোনো যো নেই। মানুষ চলে গেলেও তার টুকরো টুকরো স্মৃতি আর কথার তরঙ্গমালা ঢেউ তোলে। তবে এ সমাজে মানুষের মৃত্যুর পর তাকে ব্যবচ্ছেদ করে খোঁচানোর লোকেরও অভাব নেই। কবি এ কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তার নিচের এ কবিতায়। কেউ আগে, কেউ বা পরে, যেতে তো হবেই/অতিপ্রিয় নিজের ছায়াটি ফেলে রেখে/ টুকরো টুকরো স্মৃতির বুনোটে কথার তরঙ্গ তুলবে কেউ,/কেউ কেউ রেগে-মেগে টুকরো করবে কাছি/খোঁচানোর লাগানোর জন্যে/বাঙালির অভাব হবে না কোনো দিন। [রফিক আজাদ : সশব্দে কাঁপিয়ে ঘরবাড়ি]

শহীদ মিনার আমাদের প্রাণের মিনার। ভাষার দাবিতে তাজা প্রাণ ঢেলে দেওয়া জাতি আর কয়টা আছে। এই শহীদ মিনারকে নিয়ে বার বার নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। রাতের আঁধারে শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমাদের কীর্তিগুলো, অর্জনগুলোকে মুছে ফেলার নানা ফন্দি ফিকির করা হয়েছে। আমাদের তারুণ্যের স্বপ্নমাখা শহীদ মিনার। শহীদ মিনার মানি অসমাপ্ত/বারবার ভাঙচুরের শিকার/আমাদের কীর্তি ও সাফল্যের/প্রথম সোপান তবু তারুণ্যের স্বপ্নমাখা/শহীদ মিনার। [শহীদ মিনার]

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হয়। সেই বিড়ম্বনার সঙ্গে কবিও কম-বেশি জড়িয়ে আছেন। বয়সের কাছে অসুখণ্ডবিসুখ দানা বেঁধেছে তার শরীরে। চোখ, দাঁত আক্রান্ত হয়েছে। কবি ভাবছেন, কবে তার নিজের নামটাই কাটা পড়ে জীবনের খাতা থেকে। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার যে ভাবনার পরিবর্তন হয়ে মৃত্যু চিন্তা ভর করে সে কথাই কবি বলতে চেয়েছেন ‘হালহকিকত’ কবিতায়। আবার অপর একটি কবিতা ‘মৃত্যুকে সঙ্গী করে’ কবিতায় একই সুর ধ্বনিত হয়েছে। জীবদ্দশায় আমরা যত আস্ফালনই করি না কেন, মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমাদের চলতে হয়। আমরা কি আবার আঁতুড় ঘরের গন্ধে ফিরে যেতে চাই, কিংবা কবরের বা চিতায় ভস্ম হতে চাই? কবির এ উপলব্ধিই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বয়স একটা বিষয়। বয়সকে আমরা অনেকেই হেলা ফেলায় কাটিয়ে দেই।

বয়েস নিজেই এ পর্যায়ে/অসুখের দায়িত্ব নিয়েছে।/প্রথমে দুচোখ/ তারপর/ কতিপয় দাঁত/কখন যে কাটা পড়ে/আমার নিজের নাম! [হালহকিকত] মৃত্যুকে সঙ্গী করে/আমাদের সব আস্ফালন/আঁতুড়ঘরের গন্ধ/কে আর খুঁজতে চায়/কবরে কি চিতায়। / [মৃত্যুকে সঙ্গী করে]

আমাদের সমাজে বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর জঙ্গিবাদিদের আস্ফালনে আমরা যে নাজেহালে আছি তারই এক উজ্জ্বল উদ্ভাসিত হয়েছে ‘ধিক্কার’ নামের কবিতায়। এই কর্মকাণ্ড আমাদের সমাজকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। এর যাঁতাকল থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে না পারলে বিষাদের কালো রঙে রক্তের রাঙা স্রোতে কলম ডুবিয়ে দেই। কি সরল বয়ানে তিনি আমাদের মোহিত করেন। আমরা তো এই শাঁখের করাতে দিনাতিপাত করছি। সন্ত্রাসী অপরাধ করে/জঙ্গিরা সাথে করে পাপ/এইসব দেখে যারা/ থাকে চুপচাপ/ শাঁখের করাত হ’য়ে/ দিন কেটে, রাত কেটে/ করে ফালি-ফালি

বাঙালি জাতির জীবনে এক পরম পাওয়া নাম জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। জাতিকে পথের দিশা দেখিয়ে নিশানা তাক করে লক্ষ্য ভেদ করেছেন। আমাদের তিনি এনে দিয়েছেন স্বাধীন রাষ্ট্র। এ রক্তে কেনা ভুখণ্ড আর এমন করে কটা জাতি কিনতে পেরেছে। আর এর পেছনে যিনি নেতার আসনে থেকে চালিকা শক্তি হয়ে আগুয়ান হয়েছেন তিনি আজ নেই! কিন্তু তার নির্দেশিত পথেই হাঁটছে দেশ, জাতি। দেশের জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন যে নেতা তিনি আজ নেই। তবে কী সত্যিই তিনি নেই? কে বলেছে তিনি নেই! তিনি আছেন আমাদের চেতনায়, আমাদের মননে, বাঙালির ঘরে ঘরে। আমরা তো ঘরছাড়া হয়েছি, মুক্তির আস্বাদন নিতে, মুক্তির মিছিলে শামিল হয়ে পায়ে পায়ে। তাইতো রক্তের দামে কেনা স্বদেশ সোনার বাংলা আমার আমি তোমায় ভালোবাসি। কবি তাই সেই মহান নেতার তিরোধানে মর্মাহত হয়ে ‘তিনি নেই, তিনি আজ অনেক বেশি আছেন’ কবিতায় বলেন, তিনি স্বশরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও তিনি অছেন বাংলার আকাশে বাতাসে। আবার কবি আসাদ চৌধুরী তার ‘সহিষ্ণু প্রতীক্ষা’য় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আক্ষেপ করে লিখেছেন, আমাদের গর্বের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে যে সময়ে আমাদের সকল বঞ্চনা, দুঃখ-কষ্টের অনিশ্চয়তার দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে আটক ছিলেন। আমরা তার বিশাল ছায়া পাইনি, তবে তিনি যে বিশাল ছায়াবৃক্ষ হয়ে আমাদের বাতিঘর হয়ে যুদ্ধ জয়ের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তারই প্রেরণাই আমরা যুদ্ধজয়ী গর্বিত জাতি।

না প্রবল তুষার, না তেতে-ওঠা তেড়ে-আসা বালি এক জীবনে কত আর তাঁবু পাল্টানো যায়?/কত বার শরণার্থী হতে পারে পোড় খাওয়া মানুষেরা? /যারা কর্দমাক্ত, কলুষিত সোনার বাংলাকে/গভীর মমতা দিয়ে বুকে তুলে নিয়েছিলো/গলা উঁচু ক’রে গাঢ় স্বরে বলি ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি...’। [তিনি নেই, তিনি আজ অনেক বেশি আছেন] আমাদের সবচেয়ে গর্বের/

দুঃখের, বঞ্চনা ও বেদনার সেই নয় মাস/তোমার বিশাল ছায়া/আমরা পাইনি- /আর তুমিই ছিলে, যেমন আজও আছ অবিচল আমাদের একটি মাত্র বাতিঘর। / [সহিষ্ণু প্রতীক্ষা]

শুধু উপরের কবিতা দু’টিই নয়, আমরা যদি আসাদ চৌধুরীর নিচের আরো দুটি কবিতা পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাই- জাতির জনককে তিনি যে কতোভাবে তার এই কবিতাগ্রন্থে’ স্বমহিমায় উজ্জ্বলতম ভাস্বর করে উপস্থাপন করেছেন। প্রথম কবিতাটি ‘আগুন ছিল’ আর দ্বিতীয়টি ‘মৃত্যুও পারেনি ছুঁতে’। এ কবিতা দুটিতে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুও ছুতে পারেনি, যুদ্ধ জয়ের নয় মাসে। এই নয় মাসে আমাদের মুখে আগুন ঠিকরে বেরিয়েছে। আমাদের কাউকে এসে আগুন জ্বালিয়ে দিতে হয়নি। আমরা জেনেছি তারই অমর বাণীতে- এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। সেই আগুন দেদীপ্যমান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। তখন ফুলের ভেতর থেকেও আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে। শহীদদের চোখে, বীরাঙ্গনার চোখে এমন কি নীবর থাকা সবুজ কচি কলাপাতার ভেতর থেকেও আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসে। আমাদের সাহসী করে, তেজী করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা জোগায়। যে আমাদের সাহস জুগিয়েছে, শক্তি জুগিয়েছে তাকে নির্মমভাবে দেশীর চক্রান্তকারী আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছিল। আমাদের সব আলো ঠিক তখনই নিভে গেল। যে নিরাপদ সড়ক ধরে বাঙালি জাতি সমুখপানে এগিয়ে যাবে, তাতে বাধা পড়ল। যে শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা হত্যা করতে সাহস পায়নি, তাকে কারাগারের প্রকোষ্ঠে মৃত্যু ছুঁতে পারেনি। অথচ দেশীয় ঘাতকরা তাকে নির্মম, নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাইতো কবি বলেন- এখন তোমার স্মৃতি/স্বপ্ন বোনে অবাধ মুক্তির- /বিপন্ন বিস্ময়ে জানি/তুমি আছ আমাদেরই পাশে/থাকবে চিরকাল। আসলেই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা অনাদিকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের লালিত স্বপ্নের সারথি হিসেবে। ফুলের মধ্যে কোনো মহাপুরুষ এসে/আলো জ্বালেননি/সেখানে কোনো আলোই নেই/কখনো ছিল না/তবুও ফুলের মধ্যে ঠিকই আলো জ্বলে/চোখের মধ্যেও/যেমন একাত্তর/বীরাঙ্গনার চোখে/শহীদদের চোখে/এমনকি কচি কলাপাতার মধ্যে/আগুন ছিল/ফুলের মধ্যে তো ছিলই [আগুন ছিল]

পরিশেষে এ কথা বলা যায়, কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতাগ্রন্থ ‘তৃণে ছাওয়া আদিম ঠিকানা’ মানুষের মৌলিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছেন। তিনি তার এ কবিতাগ্রন্থে দেশাত্মবোধ, প্রেম, ভাববাদ, মৃত্যুভাবনা এবং জাতির জনককে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করেছেন। নাম শিরোনামীয় কবিতাটি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে লেখা হলেও মূলত এ কবিতাগ্রন্থে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক কবিতায় তাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। আমি এ কবিতাগ্রন্থটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছি। আজ তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। রেখে গেছেন তার অমূল্য লেখনি, যা আগামী প্রজন্ম তাকে আরো বেশি উপলব্ধিতে আনবেন। কবির প্রতি অতল শ্রদ্ধা। ‘তৃণে ছাওয়া আদিম ঠিকানা’ কবিতাগ্রন্থের ব্যাপক প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি। সেইসঙ্গে কবি বেঁচে থাকবেন আমাদের বাংলা কবিতার এক অমর কীর্তিমান কবি হিসেবে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত