সাহিত্যে ‘নীরব চরিত্রের’ স্রষ্টা ইয়ন ফোসে
রবিউল কমল
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইয়ন ফোসে। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদক। কিন্তু নাট্যকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত তিনি। কয়েক দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে তাকে কখনো হেনরিক ইবসেন, ফ্রান্ৎস কাফকা, টমাস বার্নহার্ড, জর্জ ট্র্যাকলের, স্যামুয়েল বেকেট, এমনকি বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ফোসের নাটকগুলো সহজবোধ্য মনে না-ও হতে পারে। সমসাময়িক যে কোনো নাট্যকারের চেয়ে তার নাটকগুলো সবচেয়ে বেশিবার মঞ্চস্থ হয়েছে। ১৯৫৯ সালে নরওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে জন্ম নেওয়া ইয়ন ফোসে এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠেন যেখানে লুথেরানবাদের কঠোর নিয়ম মেনে চলা হতো। অবশ্য তিনি নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা করে বিদ্রোহ করেছিলেন। পরে ২০১৩ সালে ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করেন ৬৪ বছর বয়সি এই লেখক।
তুলনামূলক সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার পর ১৯৮৩ সালে ‘রেড, ব্ল্যাক’ উপন্যাসের মাধ্যমে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ইয়ন ফোসে। তার প্রধান কাজগুলোর মধ্যে আছে ‘বোটহাউস’ (১৯৮৯) যা খুবই প্রশংসিত হয়েছিল এবং দুই খণ্ডের ‘মেলাংকলি’ (১৯৯৫-১৯৯৬)।
তার সর্বশেষ বই ‘সেপ্টোলজি’ আধা-আত্মজীবনীমূলক মহাকাব্য, এটি সাতটি অংশে তিন খণ্ডে বিস্তৃত। বইটির চরিত্র এমন একজন নিঃশব্দ মানুষ যিনি নিজেরই অন্য এক সংস্করণের সঙ্গে মিলিত হন। এ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডটি ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার মনোনয়নে সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। নব্বই দশকের শুরুর দিকে একজন লেখক হিসেবে জীবনধারণের জন্য লড়াই করছিলেন ফোসে। তখন তাকে একটি নাটকের শুরুর অংশ লিখতে বলা হয়। তিনি একবার এক ফরাসি থিয়েটার ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তখন আমি প্রথম এ ধরনের কাজ শুরুর চেষ্টা করছিলাম। লেখক হিসেবে এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিস্ময়। কিন্তু আমি জানতাম এটা আমার জন্যই।’ তিনি সেই কাজটি এতোটাই উপভোগ করেছিলেন যে ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’ শিরোনামের নাটকটি পুরোটাই লিখে ফেলেন। ইয়ন ফোসের লেখা প্রায় ৫০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নরওয়েজিয়ান প্রকাশক সামলাগেটের মতে, ‘ইয়ন ফোসের নাটকগুলো বিশ্বজুড়ে হাজারবারের বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে। ফোসের কাজ খুব সাবলীল, যেগুলো সহজ সরল ভাষায় লেখা হয়েছে। আর তাতে আছে ছন্দ, সুর ও নীরবতার মিশ্রণ। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো খুব বেশি কথা বলে না। শুধু তাই নয়, এসব চরিত্র যা বলে তা প্রায়ই পুনরাবৃত্তি শোনায়। এক পুনরাবৃত্তি থেকে অন্য পুনরাবৃত্তিতে ছোট কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন থাকে। শব্দগুলোকে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হয়, দোদুল্যমান এবং প্রায়ই কোনো বিরামচিহ্ন থাকে না।
২০১৮ সালে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফোসে বলেন, কাহিনির জন্য আমার বই পড়বেন না। আমি চিরাচরিত অর্থে চরিত্র নিয়ে লিখি না। আমি মানবতা নিয়ে লিখি। ২০০৩ সালে ফরাসি সংবাদপত্র ল্য মোঁদকেও একই কথা বলেছিলেন তিনি। ইয়ন ফোসের লেখায় আছে সমাজতাত্ত্বিক উপাদানের উপস্থিতি। যেমন বেকারত্ব, একাকীত্ব ও ভেঙেপড়া পরিবার।
তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার লেখায় দরকারি সব বার্তাই থাকে। ইয়ন ফোসের লেখায় যে নীরবতার কথা বলা হচ্ছে, সেই নীরবতা যেন কথা বলার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাকে বলা হচ্ছে ‘নৈঃশব্দ্যের লেখক’। একসময় নাটক লেখা থেকে বিরতি নিয়েছিলেন ফোসে, সেই বিরতি প্রায় এক দশক দীর্ঘ হয়েছিল। বিরতি ভেঙে নাটকে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘নাটক লেখা তাকে কোনো আনন্দ দেয় না।’ সেবার তিনি থিয়েটারের জন্য যে নতুন নাটক নিয়ে ফিরেছিলেন তার নাম ছিল ‘স্টার্ক ভিন্ড’। এটি এখনো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি, যদিও তার নাটকগুলো মঞ্চস্থ করা বেশ কঠিন। ফোসের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- তিন খণ্ডের ‘সেপ্টোলজি’, ‘মর্নিং অ্যান্ড ইভনিং’, দুই খণ্ডের ‘মেলাংকলি’, ‘অ্যালিস অ্যাট দ্য ফায়ার’, ‘অ্যা শাইনিং’ ও ‘বোটহাউস’। ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা অসাধারণ একটি সিরিজ ‘সেপ্টোলজি’। উপন্যাসের প্রতিটি সিরিজে একজন বয়স্ক শিল্পীর জীবনের গল্প ফুটে উঠেছে। প্রতিটি সিরিজের শুরু একইভাবে হয়েছে এবং শেষও হয়েছে একইভাবে। ‘মর্নিং অ্যান্ড ইভনিং’ সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালী উপন্যাস।
উপন্যাসটি শুরু হয় একটি নীরব চরিত্র জোহানেসের জন্মের সঙ্গে, যার বাবা-মা মনে করেন জোহানেস বাবার মতো মৎস্যজীবী হবে। কয়েক বছর পর জোহানেসের মধ্যেও তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের প্রতিফলন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি একজন মৎস্যজীবী হন। ‘মেলাংকলি’ উপন্যাসের দুটি খণ্ড উনিশ শতকের নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী লার্স হার্টেরভিগের (১৮৩০-১৯০২) জীবনকে চিত্রিত করে। ডুসেলডর্ফে অধ্যয়নকালে হার্টেরভিগ নিজের প্রতিভা নিয়ে এতোটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যা তাকে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যায়। একসময় বাড়ির মালিকের মেয়ের প্রতি আকর্ষণ তাকে যৌন বিভ্রান্তির দিকে পরিচালিত করে। তিনি গৃহহীন হয়ে পড়েন।
‘অ্যালিস অ্যাট দ্য ফায়ার’ উপন্যাসে সিগনে নামের এক নারীর ২০ বছরেরও বেশি সময় আগের কথা মনে পড়ে যায়। তার স্বামী নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। শিগগির ওই নারীর চিন্তাভাবনা আধ্যাত্মিক গুণে রূপান্তরিত হয়। এমনকি পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষের স্মৃতিও তিনি মনে করতে পারেন।
সিগনে যেখানে বাস করেন সেই বাড়িটি তার দুঃখস্মৃতির সঙ্গে জড়িত। ফোসের নাটকের বদ্ধতাভীতি বা ক্লাস্ট্রোফোবিয়ার অনুভূতি এবং ‘কথা না বলা’ নীরব চরিত্রগুলো দর্শকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি করে। ‘অ্যা শাইনিং’ উপন্যাসে দেখা যায় গভীর রাতে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি নরওয়ের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। তার গাড়িটি দুর্গম রাস্তায় হারিয়ে যায়। তিনি হতাশ হয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। দেখতে পান, একটি অদ্ভুত প্রাণী তার দিকে এগিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রানজিট বুকস এই কাজটিকে ‘জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময় নিয়ে লেখা চমৎকার একটি উপন্যাস’ বলে অভিহিত করেছে। অপরদিকে ‘বোটহাউস’ উপন্যাসে সন্ন্যাসী ঘরানার এক ব্যক্তির খোঁজ পাই, তিনি তার স্ত্রী ও পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন। তারপর তিনজনই ত্রিভুজ প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। ইয়ন ফোসের উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- ‘আই অ্যাম দ্য উইন্ড’, ‘অ্যা সামার ডে’, ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’ এবং ‘দ্য নেম’। ‘আই অ্যাম দ্য উইন্ড’ নাটকটিকে জীবিত ইউরোপীয় নাট্যকারদের মধ্যে ‘সর্বাধিক প্রদর্শিত’ নাটক বলে মনে করা হয়।
এ নাটকের গল্প একটি মাছ ধরার নৌকায় দুইজন পুরুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অস্তিত্ববাদী এ নাটকটি নিয়ে ২০১৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘ ফোসের ছন্দময় পাণ্ডুলিপির চরিত্রগুলোতে মৌলিক প্রশ্নে অস্তিত্বের উদ্বেগ ফুটে উঠেছে।’ ‘অ্যা সামার ডে’ নাটকটি দর্শককে ‘অ্যালিস অ্যাট দ্য ফায়ার’-এর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। এ নাটকের সংবেদনশীল কেন্দ্র হলো একজন নারী, যিনি তার মাছ ধরতে যাওয়া স্বামীর অপেক্ষায় আছেন। টাইমসের এক সমালোচক লিখেছেন, ‘অবিরাম ভয়ের অনুভূতি সত্ত্বেও নাটকটি শক্তিশালী এবং মৌলিক নাটকীয় গতি সঞ্চার করে।’ অপরদিকে ঈর্ষা, যৌন উত্তেজনা ও প্যারানোইয়ার নাটক ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’। এতে দেখা যায় এক দম্পতি সমুদ্রের তীরে প্রত্যন্ত ছিন্নভিন্ন পুরনো এক বাড়িতে চলে যায়, যেখানে ‘কেউ আসবে’ এমন চিন্তাও তাদের মনে আসে না।
আর ‘দ্য নেম’ নাটকে দেখা যায় একজন অল্পবয়সি গর্ভবতী নারীকে, তিনি তার বাবা-মায়ের বাড়িতে চলে যান, সঙ্গে তার অনাগত সন্তানের বাবাও থাকে। কিন্তু তার বাবা-মা জানেন না তাদের মেয়ে কী চাচ্ছেন।
নাটকের বদ্ধতাভীতি বা ক্লাস্ট্রোফোবিয়ার অনুভূতি এবং ‘কথা না বলা’ নীরব চরিত্রগুলো দর্শকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি করে। ২০০৭ সালে ডেইলি টেলিগ্রাফের শীর্ষ জীবিত ১০০ প্রতিভাবানদের মধ্যে ৮৩তম স্থানে ছিল ইয়ন ফোসে। তাকে নরওয়ের জাতীয় নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ২০১০ সালে থিয়েটার বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ইন্টারন্যাশনাল ইবসেন পুরস্কার পান ফোসে।