ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লাল শাড়িটি

নুসরাত সুলতানা
লাল শাড়িটি

সারা বাড়িজুড়ে খুশি আর আনন্দের আবহ প্রবাহিত। চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন সবাই খুবই খুশি। নীরু আসবে বরকে নিয়ে বেড়াতে। পাঁচ ভাইয়ের ভেতর নীরু বড় ভাই রফিক চৌধুরীর মেয়ে। এর আগে দুই প্রজন্মে কোনো মেয়ে ছিল না। নীরুর দাদি স্কুলে যাওয়া মেয়েদের ডেকে চুল আঁচড়ে দিতেন। তারপর নীরু যখন জন্মালো- হয়ে উঠল একেবারে ননীর পুতুল। এরপর যদিবা ছোট ভাই ছাড়া সবারই মেয়ে হয়েছে কিন্তু নীরুর জায়গা আর কেউ নিতে পারেনি। বাবা-চাচারা নীরুকে ডাকে মনু। প্লেট থেকে মুরগির পা, পাখা, গিলা তুলে খাওয়ায়। এতে অবশ্য কেউ কেউ বেশ ঈর্ষান্বিত। বিশেষ করে মেজ ভাইয়ের মেয়েরা এবং মেজ ভাই।

নীরুকে যখন শ্বশুরবাড়ি তুলে নেয়া হয়েছিল চাচিদের প্রতিযোগিতা লেগে গিয়েছিল; কে কী পদ বানাবে সেটা নিয়ে। কেউ বানায় করল্লার মোরোব্বা, কেউবা তৈরি করে চন্দ্রপুলি, আবার কেউ বানায় চিংড়ি কাবাব, কেউ বানায় কচুর পিঠা, কেউবা নানা পদের হালুয়া। নীরুর বিয়ে হয়েছিল একটু বেশি বয়সে। এত আদরের মেয়ের জন্য পাত্র পছন্দ হচ্ছিল না বাবা-চাচাদের। জামিল তালুকদার পটুয়াখালী ডিগ্রি কলেজের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক। পাঁচ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রঙ ধবধবে শাদা। এই পাত্রকে নিয়েও যখন বাবা-চাচাদের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব তখন জামিল তালুকদার বলেছে, আপনাদের শ্যামলা মেয়ে আমার কাছে বিয়া দেবেন না ক্যান? পাত্রের এই আত্মবিশ্বাস ভালো লেগে যায় বাবা আর চাচাদের।

২. বিয়ের পরে নীরু আর জামিল প্রথম আসছে দাদা বাড়ি। নীরুর বাবা পটুয়াখালি শহরের খাদ্য পরিদর্শক সেখানেই হয়েছে সব অনুষ্ঠান। এবারই প্রথম বংশের বড় মেয়ে দাদাবড়ি এসেছে জামাই নিয়ে। সমস্ত বাড়িতে একেবারে ঈদের আমেজ। একেকদিন একেক চাচার ঘরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন আর তাতে বাড়ির সবাই নিমন্ত্রিত। পাঁচ ভাইয়ের ভেতর মধ্যবর্তী তিন ভাই গ্রামের বাড়িতে বসবাস করে; মেজ, সেঝ, আর নোয়া ভাই। বড় ভাই থাকেন পটুয়াখালী শহরে আর ছোট ভাই কুষ্টিয়া শহরে। সেঝ আর নোয়া চাচার ঘরেই আয়োজন বেশি নীরু আর তার বর আসা উপলক্ষ্যে। মেজ চাচার ঘরেও দাওয়াত হয় কালেভদ্রে। সোনা চাচা আর সোনা চাচিও বেশ কাজে হাত লাগায় প্রতিদিন। সোনা চাচা আর সোনা চাচি বড় ভাইয়ের গ্রামের ঘরে আশ্রিতা থাকেন। সোনা চাচা, সোনা চাচির চেয়ে বয়সে বেশ বড়। সোনা চাচার চোখগুলো কোটরে ঢুকে গিয়েছে, গাল ভাঙা, থুতনির নিচে অল্প কয়েকটি কাঁচাপাকা দাড়ি। সোনা চাচির গায়ের রঙ উজ্জ্বল নয় কিন্তু মসৃণ ত্বক, বড় চোখ, চ্যাপ্টা ঠোঁট এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা ছড়ায়। পাঁচ ফুট উচ্চতার সোনা চাচি খুবই মিষ্টভাষী। সোনা চাচা আর সোনা চাচির জীবনের চাহিদাও খুব কম। সোনা চাচা গ্রামের বিভিন্ন মানুষের গোল পাতার আর ছনের চালা ছেয়ে (বানিয়ে) দেন। তাতেই টোনাটুনির সংসার বেশ চলে। কারণ তারা নিঃসন্তান আর চাহিদাও খুব কম। সেদিন ছিল নোয়া চাচা মানে আউয়াল চৌধুরীর ঘরে সবার দাওয়াত। সবাই সকাল থেকে খুশি মনে রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে। নীরুর বর জামিল তালুকদার বাড়ির বড় পুকুরে জাল ফেলে ধরেছে চার কেজি ওজনের রুই মাছ, পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা, ছোট-বড় ওজনের মৃগেল মাছ। মাছ ধরার জন্য বানানো হয়েছে কলাগাছের ভেলা। ছোটরা তাতে চড়ে বেশ আনন্দ কুড়াচ্ছে। সবাই হাতে হাতে বানাচ্ছে চালের রুটি, রান্না হচ্ছে রাজহাঁস, মাছ, পোলাও, মুরগি, চিংড়ি, পিঠা, পায়েশ। গোসল সেরে নীরু পরেছে একটা লাল সুতি শাড়ি। লাল জমিনে হলুদ আর ফিরোজা ব্লু ডালিয়া ফুলের ছাপা শাড়িটিতে। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, কোঁকড়া চুল আর বড় চোখের নীরুকে দেখছে আর ছোট বোনরা বলছে, আজ বড় আপা আপনেরে কী সুন্দর লাগতেছে! নীরু অমলিন হাসি হাসে। বাড়ির পুরুষদের খাওয়া হলে মেয়েরা খেতে বসেছে। খেতে বসেই বোনেরা মিলে পরিকল্পনা করে; বিকালে যাবে কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে সবাই মিলে।

সময়টা ছিল আশির দশক। এনালগ ক্যামেরায় ছবি তোলারও পরিকল্পনা করে তারা। বাড়ির দুয়েকজন ছেলে ততদিনে চলে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নদীর পাড়ে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য কাপড় বদলায়। কাপড় বদলে নীরু একটি নীল কাতান শাড়ি পরে আর লাল শাড়িটি শুকাতে দেয় বাড়ির উঠানে।

৩. সব বোনেরা লিপস্টিক, চুড়ি আর টিপ পরে বেশ সাজগোজ করে বেড়াতে যায় নদীর পাড়ে। মেজ চাচার কোনো মেয়েই গেল না। নদীর পাড় হয়ে গ্রামের স্কুল ঘরে গিয়ে চা, বিস্কুট খেয়ে সবাই যখন সন্ধ্যায় হুড়োহুড়ি করে বাড়ি ফেরে তখন নীরু এসে আর তার লাল শাড়িটি উঠানে দেখতে পায় না। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে; আম্মা আপনে আমার শাড়ি উঠাইছেন ঘরে? নীরুর মা বলে- না তো। শুরু হলো লাল শাড়িটির খোঁজাখুঁজি। রাতে পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পড়ল; নীরুর লাল শাড়িটি পাওয়া যাচ্ছে না। আনন্দমুখর পরিবেশে নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে বিষাদের আবহ। সকালে উঠে শুরু হয় ব্যাপক খোঁজাখুঁজি। কারণ মেয়ের বিয়ের শাড়ি হারিয়ে যাওয়া খুব অমঙ্গলের কথা। তাছাড়া দাদা বাড়ি এসে শাড়ি হারালে নীরু-জামিলের কাছে মুখ দেখাবে কী করে! শুরু হয় ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ। সবার আগে জিজ্ঞেস করা হয় বড় চাচার কাজের মেয়ে সকিনাকে। ওকে বলা হয় তোকে দুইটা শাড়ি কিনে দেয়া হবে তুই ভুলে লুকিয়ে রাখলে দিয়ে দে। সকিনা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলে বড়াপার শাড়ি মুই ক্যা নিমু? মুই কোনোদিন কিছু নিছি? আর আব্বায় মোরে নিজের মাইয়ার মতো ভালোপায়। মুই কোনোদিনও এইরহম কাম করতে পারি না। এরপর জিজ্ঞেস করা হল সোনাচাচা আর সোনাচাচিকে তাদের একটাই উত্তর- গরিব অইতে পারি, খাইট্টা খাইতে পারি কিন্তু মোরা চোর না। লাগলে মোগো বিছানা-বালিশ সব তালাশ কইররা দ্যাহেন।

৪. বাড়ির ওপর বসবাস করা বংশীয় ফুপু বল্ল; এক কাম কর স্কুল ঘরের মসজিদের হুজুররে বোলাইয়া আইন্না বাডি চালান দেও। বাডি ঘোরতে ঘোরতে যাইয়া চোরের ধারে থামবে। আনা হলো হুজুরকে। বাড়ির ফুটবল মাঠের মতো বিশাল উঠানে দাঁড় করানো হলো ছোট বড় সবাইকে। ভয়ে, উত্তেজনায় সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। কার কাছে গিয়ে বাটি থামবে! বাটি কেবল ঘুরতেই থাকল; থামলোনা কোথাও। হুজুর বললেন; চাল আনো চাল পরা দেই। চাল মুখে নিলেই চোরের মুখ থেইকা রক্ত বাইর অইবে। সবাই ওজু কইরা আইয়া সবাই বিসমিল্লাহ কইয়া চাউল মোহে দেবে। নাতিদীর্ঘ, ছাগল দাড়িওয়ালা গোলগাল মুখের হুজুর একদম ধ্যানমগ্ন হয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন বড় এক গামলা চালে। হুজুর বললেন, বাড়ির কেওরে বাদ যেওন যাইবে না। ছোটরা এবার প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে, যদি মুখ থেকে রক্ত পড়ে! মুখ শুকিয়ে কাঠ শিশু-কিশোরদের। ছোটদের বোঝানো হলো, তোমাদের কিছু হবে না। কারণ তোমরা তো নাওনি। বাড়ির সবাই চাল পরা খেল কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মেজ চাচা খেলেন না। ওনার এক কথা এসব বুজরুকিতে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমি কী চোর!

৫. দুপুরের পর এক ভীষণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা শুরু হলো! মেজ চাচা সোনা চাচা আর সোনা চাচিকে প্রহার করা শুরু করলেন। শুধু বলছেন; স্বীকার কর যে, তোরা শাড়ি নিছিস। স্বীকার করলে ছাইড়া দিমু, কিছু কমু না। কিন্তু স্বীকার করতে অইবে। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা মেজ চাচার বই পড়া আর দুর্বলকে অত্যাচার করা দুইই খুব প্রিয়। অবশ্য গরিব সুন্দরী নারীদের তিনি সাহায্য নিতেও আহবান জানান। যদিও চাচিকে পাঁচ মেয়ে আর দুই ছেলের সংসার অনেক সময়ই ধনী বাবার বাড়ি থেকে চাল-ডাল, টাকা-পয়সা এনে সামলাতে হয়।

প্রহার করতে করতে যখন নিজেই ক্লান্ত হয়ে যান তখন সোনা চাচা, সোনা চাচি বসে কাঁদেন। এরশাদের আমলে ছিল সর্বহারাদের দাপট। আর মেজ চাচা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। এলাকার সবাই তাকে সমীহ করত। তাছাড়া অন্য ভাইয়েরা তার বদমেজাজ সম্পর্কে জানত। তাই যে কেউই তার সামনে যেতে বিরক্ত বোধ করত। চিকন লাঠি দিয়ে দিয়ে মেরে কয়েকটা লাঠি ভেঙেছেন। এরপর বাঁশ দিয়ে বাড়ি দিলে সোনা চাচির কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। এবার ক্ষেপে যান বড় চাচা। ধমক দিয়ে বলেন তোরে কেডা কইছে শাড়ি উদ্ধার করতে? আমি নীরুকে তিনটা লাল শাড়ি কিইন্না দিমু। জামিলও এসে বলেন, চাচা গরিবকে এইভাবে অত্যাচার করে! কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে ওনারাই শাড়িটি নিয়েছেন? সবাই প্রতিবাদে ফুসে উঠলে মেজ চাচা লাঠি ফেলে ঘরে চলে যান। সোনা চাচা আর চাচিও বেরিয়ে যান নীরুর দাদা বাড়ি থেকে। বাড়ির ছোটদের খুবই মন খারাপ হয় সোনা চাচা আর চাচির জন্য। বড়দের মনেও বেশ দাগ কাটে ঘটনাটি। সোনা চাচা আর চাচির সঙ্গে রাস্তা ঘাটে দেখা হলে ছোটদের সঙ্গে কথা বলত। এলাকায় বেশ একটা চাপা ক্ষোভ সবার ভেতরেই ছিল। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কেউই কিছু বলতে সাহস করেনি।

৬. এর এক বছর পর নীরুর সেজ চাচা হাফিজ চৌধুরীর বড় মেয়ের বিয়ে। হাফিজ জন্য দাওয়াত দিয়ে যায় মেজ চাচার বড় মেয়ে এষার স্বামীর বাড়ি সাগরদিতে। এষার বাড়ির উঠানে একটা লাল শাড়ি ঝোলানো। শাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে হাফিজ চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে যান। তার চোখে ভেসে ওঠে সোনা চাচির ফাটা কপাল থেকে ঝরে পড়া রক্ত, শাড়িটি পরিহিত নীরুর খুশি খুশি মুখচ্ছবি। আবার আকাশ-পাতাল ভাবেন একইরকম শাড়ি তো হতেই পারে! এমন সময় বেরিয়ে আসে এষা। হাসিমুখে বলে, আরে সেজকাকু আসেন। বাড়ির সবাই ভালো আছে? হাফিজ চৌধুরী বলেন হ্যাঁ মা ভালো। তোমরা ভালো আছ? এষা বলে শুকরিয়া কাকু। আপনি বসেন, আমি একটু চা বানাই। সদর দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এষা চলে যায়। ফিরে আসে কাজের মেয়ে কয়েকরকম মিষ্টি, ফল, কেক, দামি বিস্কুট ইত্যাদি নাশতা নিয়ে। এষা বলে, কাকু আইজ বেড়াইয়া যাইবেন। আপনার জামাই আসতেছে। চইলা গ্যালে আমারে বকা দেবে খুব। হাফিজ চৌধুরী পুরো ঘরে চোখ বুলান ; ঘরে দামি সোফা, টিভি, ফ্রিজ আসবাবপত্র সবই আছে। হাফিজ সাহেব আলোর জন্য বা কী ভেবে খুলে দেন সদর দরজা। কিন্তু লালশাড়িটি দেখা গেল না। দ্বিতীয়বার অন্তর্ধান হলো লাল শাড়িটি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত