নির্ঘুম রাতের গল্প

নূরনাহার নিপা

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মোবাইলে ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠতে ঘুম ভেঙে দেখে তখন সুবেহ সাদিক। একটা ঘোরের মধ্যে ঘুম ভাঙে নিমফুলের। আকাশটা এখনো ধবধবে ফর্সা হয়নি। ভোরের ঝাঁপসা আলো ঘুমের ঘোর কাটে না। লেপ্টে থাকা স্বপ্নের রেশ সঙ্গে কতকিছু আনাগোনা ভাবতে কিছুটা লজ্জায় বিমোহিত। নামাজ পড়ে ছাদবাগানে ফুলদের সাথে কিছুটা গল্প করা। গাছের সাথে বন্ধুত্ব করে,, তাদের কষ্টগুলো জানতে খুব কাছাকাছি আসে নিমফুল।

গাছের খিদে তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে আর্তনাদ জীর্ণ ঝরাপাতা ঝরে অকালে যখন তখন তাদের বুকে মারছে কোপ। যখন কোনো গাছ কেটে ফেলে, তখন মনে হয় তার বুকের উপর কুড়াল মারছে কেউ একজন। আহা কতো প্রাচীন বৃক্ষতল, বনজঙ্গল কেটে বড় প্রাসাদ গড়ে তখন ভাবে কবে তোরা মানুষ হবি। একদিন ইসকুলে... হরিনন্দনাথ স্যার প্রশ্ন করেন, নিমফুল নামকরণ অর্থ কি? নিম ছোট করে তার অনুভূতি প্রকাশ করল। স্যার, আমার জন্মের পর বাবা মাকে একটা নিমগাছ উপহার দিয়েছিল, মা তো ভীষণ খুশি। মা এমনিতেই গাছপাগল মানুষ। বাড়ির উঠানে যত গাছ সব মায়ের হাতের লাগানো। নিমগাছ, কাঁঠাল গাছ, নারকেল গাছ, পেঁয়ারা গাছ, আম গাছ, আনারস, বড়ই গাছ সব দল বেঁধে বাড়ির সৌন্দর্য যেন এক নিখাঁদ সবুজ, চিমচাম বাগান। মা বলতেন, শরীরের পিত্ত বেড়ে গেলে নিমফুল খেলে অনেক উপকার হয়। তাছাড়া ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগলে নিয়মিত নিমফুলের শরবত, ২ গ্লাস জলে ১ চামচ নিম ফুলের গুঁড়ো মিশিয়ে এতে সামান্য আদা কুচি আর কাঁচা আম কুচি, সামান্য গোলমরিচ গুঁড়ো আর গুড় মিশিয়ে পান করলে শরীরটা ভালো থাকে। তখন মা যতন করে নিমগাছটা লাগিয়ে ছিলো। আমার নাম রেখেছিল নিমফুল। সবাই নিম বলেও ডাকে! বেশকিছুদিন পর নিমগাছে ফুল ফোটে। নিমফুলের মধ্য অ্যান্টিসেপটিক গুণ রয়েছে। স্যার, মা বলতো? নিমফুলের শরবত রক্তকে পরিশুদ্ধ করে, ত্বকের সমস্যা কমে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় নিমপাতা, নিমফুল আয়ুর্বেদে পিত্তকে শান্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। বাবা বলতো? আমি নাকি নিমগাছের মতো সবার উপকার করতে ভালোবাসি। আমাদের আমগাছে এতো সুস্বাদু আম। দেখে মন ভরে, সুগন্ধে আর খেতে। মায়ের হাতে এমন জাদু আছে অমৃত গাছের সব ফল। স্যার - বাহ্ চমৎকার উপস্থাপন। তোমার মায়ের মতো সবাই যদি এইভাবে বৃক্ষ রোপন করতো তাহলে আমাদের চারপাশে সৌন্দর্য ও শান্তিরপরশ বিরাজ করতো? নিমের পেঁয়ারা গাছ ছিল খুব প্রিয়... পাকা, কাঁচা, পেঁয়ারা গাছের ডালে বসে রোজ পেঁয়ারা খেতে বেশ ভালো লাগে নিমের।

আর ফুল গাছগুলো নিম নিজ হাতে লাগিয়ে ছিলো। বেশ যতন করে। ভোর বেলায় সব গাছে জল ঢেলে যেন পরম শান্তি পায় সে। ফল, ফুল গাছে দেখে মুগ্ধ মনেমনে, স্রষ্টাকে এতো সুন্দর পৃথিবী দেখার জন্য ধন্যবাদ জানাই। ব্রেকফাস্ট শেষ করে বেরিয়েই গাড়ির অপেক্ষা। চট্টগ্রাম কলেজ বাসা থেকে তেমন দূরে না। অনেক সময়, ঐশি, তানিশা, আরিয়া, সাথে থাকলে গল্প করতে করতে পথটা শেষ তখন বুঝতে পারে না। একি! এতো তার রাতে দেখা স্বপ্ন। চারপাশে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে। ডানে বাঁয়ে, সামনে তেমন কেউ নেই। পেছনে চকচকে লাল গাড়ি। সুন্দর চশমা পরা ম্মার্ট তরুণ। দূর থেকেও পারপিউমের ঘ্রাণ নাকে আসে তার গায়ের মোহময় সুবাস। নিঝর, কিছু বলতে নিম হাটাশুরু করলো। নিম, চিমটি কেটে দেখে,, সেকি স্বপ্নের রাজ্যে আহা জীবনের সিমটা এমনই। নিমণ্ড ক্লাসের সময় হলো। নিঝর- আমি বেশি সময় নিবো না প্লিজ। মনে যেন আনন্দ পড়ছে উচ্ছ্বাস। নিম বুঝতে পারে না। রাতের স্বপ্নটাই ফিরে এসেছে নাকি দিবাস্বপ্ন দেখছে সে! হুবহু এক, শেষ রাতের অধের্কটা সময় কিছু অপ্রিয়।

কলেজের টাইম ঘড়ির কাঁটা ছুঁই ছুঁই অথচ কোথায় গাড়ি, কৌতুহলী চোখে তাকায় নিম। আরো কাছে এসে ঠোঁট, কপাল, চুল ছুঁয়ে ইশারা ভাষায় কথা বলার মতো। এভাবে একটা দিন শুরু হলো। কবে প্রেমের স্মৃতি দরজায় কড়া নাড়ে। সে এক জীবনানন্দ। মনে হত সে নিজেই একটা জ্ঞানের বাতিঘর। কতজন বন্ধু যোগ হলো, বিয়োগ হলো, গুণ করতে গিয়ে ঘুণেধরা বুকের কোথাও আগন্তুকের আঙুলের ইশারায় স্পষ্ট ইঙ্গিত। সে সব কথা ডায়রীর পাতায় জমা, কত লাল গোলাপের পাঁপড়ি শুকিয়ে মরে চিঠির ভাজে আবার যতন করে রাখা ডায়রীর বুকে, আহা কতো কষ্ট। গোপন রঙ তার বুকে জমা সে গল্প অল্প অল্প লেখা ভাবতে অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলে নিঃশব্দ হাসি। জীবনটা ছোট হলেও... জীবনের ঘটে যাওয়া গল্পগুলো অনেক বড়। হুমায়ুন ফরিদীর একটি কথা মনে দাগ কাটে। ‘জীবনের পথ চলায় যারা একটু বেশি সরল তাদেরকে এই পৃথিবী সবচেয়ে বেশি আঘাত যন্ত্রণা দিয়ে ঠকায়!’ কাউকে ভালোবাসতে হলে এক বুক যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা তোমার থাকতে হবে, তবেই তুমি ভালোবাসতে পারবে। নিমকে- হতাশা যেন গ্রাস করে প্রতিনিয়ত।

সেদিন নিম, ভাটিয়ারী আত্মীয়র বাড়ি নিমন্ত্রণে গেল। মেহেদী প্রোগ্রামে রাতে সেখানে সবার সাথে আড্ডা আনন্দ গান হৈ চৈ করে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে নিঝর জানতে পারে.. নিঝরের কেমন জানি রাতটা শেষ হতে চাই না। এলোমেলো ভাবনাগুলো মগজের ভেতর চক্কর কাটে। নিঝর, ঠিক করে, ভোর হলে সে ভাটিয়ারী যাবে, নাফিজকে সাথে নিয়ে। যেহেতু নাফিজের পরিচিত।

নিঝর- ঠিক ভোর বেলায় ভাটিয়ারী চলে আসে নিমের সাথে দেখা করতে। নিঝর, ভাটিয়ারী লেকে অপেক্ষা করে নিমফুলের জন্য।

চম্পা নিমকে ঘুম থেকে জেগে তুলে, নিম ঘুমকাতুরে বলে, কই নিয়ে যাও চম্পা খালা, চম্পা সমবয়সী হলেও নিম তাকে সম্মান করে খালা বলে, তাদের আচারণ বন্ধুসুলভ। আরে এসো.. কে আসছে দ্যাখ। নিম তো অবাক... নিঝরকে দেখে। নিম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিঝরকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। - নিঝর, - ওই চেরী কতা কস না ক্যারে, নিম, বেবাক ভুল্লা গেছি তুমারে দ্যাহনে। বুক পকেটে গন্ধ শুকিয় নিঝর, হাচা কইতোছো? হ, মিছা কথা কমু ক্যান? এত প্রশ্নেও নিরুত্তর, নির্বিকার অবয়ব জটলায় উত্তেজনা অপেক্ষাকৃত ভেংচি কেটে খোঁচাতে শুরু করে, নিরুপায় পালাতে চাইলে -বৃত্তে আটকে যায় বারবার। নিস্তরঙ্গ লোকালয়ে তরঙ্গের বুদ্বুদ ওঠে। আচ্ছা নিঝর, তুমি কি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো? কৌতুহল নিয়ে তাকায়। যেমন তাকিয়েছিল একটু আগে আলিঙ্গনাবদ্ধ। নিঝর, কি মনে হয় তোমার? এখানকার পরিবেশটাকে অনুভব করো, ঝিমধরা এই প্রকৃতির বটবৃক্ষ সাক্ষী হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। দুনিয়ার সব মেয়েরা কি একি রকম? একি! মাটি দিয়ে তৈরি। নিম, মানেটা কি? যেমন করে এসেছে সে। চেনা নেই, জানা নেই তবুও এই লোকান্তরে। জিজ্ঞেস করলে অস্পষ্ট আঙুলের ডগায় মুখের উপর থেকে চুলের সৌন্দর্য কোথাও যেনো লুকিয়ে ছিল। তাহলে এখানে... এই সকালে, কি করে,, মাথাটা কি গুলিয়ে গেল! হয়তো তাই? ভোরের আগে একটানা ঘুম দিয়েছি। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন। স্বপ্নের মাঝখানে তুমি। স্বস্তির বাতাস ফিসফিস করে বলে তুমি ডাকছো? এই প্রশ্নের কোনো উওর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। নাফিজ এসে বলে, দোস্ত কেউ এসে যাবে।

- হা হা, যা বলেছিস শালা! তোরা সত্যি জিনিয়াস। নাফিজের গলায় কপট ধমকের স্বর। - শালা ন্যাকা। দুই ঘন্টা বিলম্বে চলছে বেটার হুশ নাই। - ওহহো, দোস্ত আমার, বোঝে না সে বোঝে না। পরিহাস করে ওঠে। চম্পা সুর মিলায় ওদের সঙ্গে।। ওদের কথার শেষটুকুর রেশ রয়ে যায় তার কানে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় নিম, নিঝর, ঠিক ভোরের আলো না ফোঁটার আগে চলে যেতো হাসপাতালে নিমকে দেখতে। যেন নিমরে বাড়ির লোকজন জানতে না পারে। নিঝরকে কেউ দেখতে না পায়। নিঝরকে দ্যাখলে আবার একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটবে। েিস ভোরবেলায় নাস্তা নিয়ে নিম যা খেতে পছন্দ করে সব নিমকে পাশে বসিয়ে খাওয়াতো? সে সব কথা মনে হলে নিমের চোখে ভরা জল আসে। নিঝর! নিঝর! চেঁচিয়ে ডাকে নিম, নিঝর তাদের দোকানের সামনে দাড়িয়ে ছিল। ইসকুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিন তারা সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো। স্কুলে যাওয়ার পথে নিমেরর চোখে পড়ত চিরচেনা মুখ। যেন পটে আঁকা চিত্র। সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে বসে আছে নিঝর! নিঝরের ইশারা আর উত্তেজিত ভঙ্গি নিমকে দেখে খুশ হৃদয়ে উচ্ছাসিত সঙ্গে ওঠে নামে তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস। নিম ভেবে পায়না কেন? তার মনে হচ্ছে এমন। কবেকার কথা! প্রতিদিন কম হলেও তিনবার নিঝর নিমদের বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটে নাফিজদের বাসায় আসতো। আরও কাছে এলে নিঝরকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু কোথায় সে। আরও জোরে চিৎকার করে ডাকে নিম। নিঝর কোন অজনায় ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে বর্ণিল সবুজ মায়ায়। নিমফুল হাসতে হাসতে উদাস দুপুরের গল্পে মিলিয়ে যায় অনেক কাল আগে যেমন পেয়েছিল সমুদ্রের কাছাকাছি ভাবনার করিডোরে। আগন্তুকরা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে নিমফুলের একেবারে কাছে। নিঝরের হাত ধরে হাসিমুখে হাঁটে স্বপ্নের রাজ্যে।