লেখার স্বাধীনতা ও চ্যালেঞ্জ
এসএম তিতুমীর
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কত আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ আমাদের এ জীবন। তারপরও একটু স্বস্তি যে তার মর্মমূলে লেগে আছে স্বাধীনতা। যা মানব অস্তিত্বের অমিয় অহঙ্কার। তাই তো আমরা অন্তত মুক্তভাবে চিন্তা করতে পারি। আবার সেই চিন্তাপ্রসূত কথাগুলো বলতেও পারি এ-ওর সামনে। তাতে খুব একটা বিপত্তি আসে না বোধকরি। তবে হ্যাঁ, আমার জানার সাথে যদি তা না মিলে অথবা অকাট্যতা ভেদে তা না উৎরিয়ে যায় তাহলেই যত বিপত্তি। আর তার পরিণতি ভয়াবহ, বর্বর এবং অকল্পনীয়। তাই তো রক্তাক্ত হয় আমাদের বইমোলা প্রাজ্ঞজনের রক্তে। আজিজ মার্কেট থেকে ফকিরাপুলের পিচঢালা পথ হয়ে ওঠে আতঙ্কিত। উত্তাল শাহবাগে জেগে ওঠে প্রতিবাদ তারুণ্য। তাই বলে তো থেমে থাকতে পারে না জীবন! সে চলে তার আপন গতিধারায়। তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি আমাদের অন্তত চিন্তা করার স্বাধীনতা আছে। এখন তাকে প্রকাশ করে কে? সে ব্যাপারে একটু মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বে যেতে হয়। ঊমড় (অহং), ংঁঢ়বৎ ঊমড় (নিয়ন্ত্রক) আর ওফ (আবচেতন) মানুষের মানস-সংগঠন ও প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড মনের এই তিন স্তরকে দেখিয়েছেন এ আমাদের জানা। সুপার ইগোর নির্দেশে যখন মানুষ তার অহংকে ক্লিষ্ট ও সংকুচিত করে, তখন মানুষ তার স্বাভাবিক অধিকারগুলো গ্রহণ ও প্রকাশ করে ভীত হয়। তাহলে যা আমাদের মানসলোককে নিয়ন্ত্রণ করছে সে-ই দেখাচ্ছে যে, আমরা একসময় ভীত হই।
এবার আসিআইডি বা অবচেতনের কাছে। সে হচ্ছে মনের গভীরতম স্তর যা নির্জ্ঞানরূপে কথিত। আর এখানেই মানুষের আদিম অসামাজিক স্বপ্ন ও কামনাগুলো জমা হয়ে থাকছে। যার ফলে শিল্পজগতে সৃষ্ট কাব্য উপন্যাস নাট্যরূপ তাদের প্রকাশ এখান থেকেই ঘটছে। তাহলে সুপার ইগোকে পেছনে ফেলে অবচেতন মন তার অধিকার গ্রহণ করছে। আমরা প্রথমত লিখিত ও কথ্য-এ দুই রূপে মনের ভাবনাগুলো প্রকাশ করে থাকি। আর তা যে সব সময় সবার কাছে ভালো লাগবে তা না। আবার অজ্ঞানতার ক্ষুব্ধতায় সে প্রকাশ বিলীনও হয়ে যেতে পারে। আমার কাছে এ লেখা লিখতে গিয়ে কেনো জানি কাগুজে প্রকাশের কথায় বেশি আসছে। সেখানে স্বাধীনতা নেই তা নয়, তবে তা সতর্কতার সাথে সম্পাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকাশক, যিনি তার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয় থেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তা করে থাকেন। খুঁটিনাটি দেখে নেবার দ্বায়িত্ব তার ওপরো বর্তায়। ভুল-ভ্রান্তি হলেই বাধে বিপত্তি। একজন কবি বা লেখকের মনে ‘নির্জ্ঞান’ স্তরে অদৃশ্য হয়ে থাকে যেসব অভিজ্ঞতা ও অনুধ্যান তা কখনো অতীতের নিষ্ক্রিয় উপাদান হয়েই থাকে না, এর মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে ভবিষ্যতের জীব। যুগে যুগে লেখকদের ওপর আক্রমণ হয়েছে আবার সেই তত্ত্বই পরে সিদ্ধ হয়েছে। হেমলক পানে প্রাণ দিতে হয়েছে সক্রেটিসকে, আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছে গ্যালিওকে, শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে ক্রোধের মুখে পড়তে হয়েছে নজরুলকে। শামসুর রাহমান প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে বইয়ের ‘সময়ের লালা’ কবিতায় যখন বলছেন, ‘তাহলে এ-ও কি সত্য/কবিতা লাফিয়ে ওঠে ব্যাপক আঁধারে/চুমু খায় পুলিশের সাদা দস্তানায়/অথবা লেহন করে গণিকার পাইকারি উরু’ তখন স্ল্যাঙ আখ্যা দিয়ে তা এক ভুবন। সেখানে চ্যালেঞ্জ থাকবেই। নানা প্রতিকূলতা প্রতিহত করে তবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে প্রকাশ শক্তি।
ইন্দ্রিয়-গাঢ় কল্পনা, হৃদয়াবেগ-ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তা বলে কী কবিতা থেমে আছে! না থাকবে। ফ্রেসনেস, ইনটেনসিটি, ইভোকেটিভ পাওয়ার এসব নিয়েই মনোজাগতি সঞ্চারি গুণ ও পরিব্যপ্ত অনুভূতির দোলা দিয়ে আমরা যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করি তার জন্য ভীত হবার কিছু নেই। যারা আগে সচেতন হয়ে উঠেনি তারা নির্জ্ঞান থেকে উঠে আসতে পারে নতুন চিন্তা আর সৃষ্টিশীল ধারণা নিয়ে, মনোস্তত্ত্ববিদ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংয়ের এ মতামতে বোদ্ধামহল বেশ সাড়ম্বরে নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু ওই চ্যালেঞ্জ থেকেই গেল। আর তার সাথে সচেতনতা সজগা হয়ে উঠলো।
‘রাতের পাহাড় থেকে/খসে যাওয়া পাথরের মতো/অন্ধকার ধসে ধসে পড়ছে/দু’হাত দিয়ে সরিয়ে তাকে নির্বিকার নিরুত্তাপ মন এগুলো।’ অথবা করুণ স্বর-‘সারা শোক কাফনে আবৃত করি এবং ঘুমাই শান্ত হয়ে/যেমন দেখেছি/মৃতের গলিত শব শ্বেত বস্ত্রে নিজেকে লুকিয়ে...’ আহসান হাবীব এই যে চিত্রকল্প নির্মাণ করলেন তা তো ওই সুপার ইগোরই বাইরে ‘নির্জ্ঞান’। ওয়ল্টার হুইটম্যানের ‘লিভস অব গ্রাস’ টিএস এলিয়টেন ক্রিয়েটিভিটি সবই তো এসছে একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে। আসলে, আনতে হবে বুদ্ধির মুক্তি। ভাঙতে হবে মগজের কারফিউ। এই কারফিউ ভাঙার দলে স্বল্পসংখ্যকই আসে, কিন্তু আসে তো! আমি যা জানি না বা যা নতুন সৃষ্টি হলো তা গ্রহণ করতে কিছুটা সময় তো লাগেই। আর কট্টর সমাজ নিজর অজ্ঞতাটাকেই বড় করে সেই সৃষ্টিকে দমাতে চায়। বিষফোঁড়া তাহলে কি শুকিয়ে গেল! মুক্ত চিন্তা আন্দোলনের পুরোধা প্রবক্তা কাজী আব্দুল ওদুদের পাতায় অথবা আরোজ আলীর স্বশিক্ষায় প্রসারিত হয় আলোর মিছিল। শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ রশীদ করিমের ‘আমার যত গ্লানি’ বীভৎস সাবলাইম তাদের প্রকাশ শান্ত হৃদয়েও কম্পন তোলে। এবার দেখি যন্ত্রের ভূতকে। ঢাকার এক সাহিত্য সম্মেলনে অন্নদাশঙ্কর রায় আর ইলিয়াসের কথোপকথনে। বাংলাদেশের বইকে অগ্নিগর্ভ বলে প্রশংসার পাশাপাশি তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বললেন ‘হুঁ। ভুলভ্রান্তিতে ভরা’। তাহলে যন্ত্রের ভূত যে আছে তা ঠিক। তাই সম্পাদনা যদি না হয় তাহলে প্রকাশ থেকে যাবে ভুলে ভরা। আর সেটা কখনো কারোরই কাম্য হতে পারে না।
‘...আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভাসমান মাইন...’
বলার স্বাধীনতা যেমন তেমনই লেখার স্বাধীনতা। কবি নজরুল তাই বলেছেন এভাবে। তিনি ধৃষ্টতা ঔদ্ধত্য অমিত সাহস নিয়ে দেখিয়েছে প্রতিবাদের ছবি তাতেও রয়েছে পরিশীলন ছাপ। তাই যা মনে আসে তা আপন ডায়েরিতে লেখা যায়। তবে তা প্রকাশের ক্ষেত্রে তাকে পরিশীলিত করতে হয়। দিতে হয় শৈল্পিক শৈলী। আসলে প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ হলে রুদ্ধ হয়ে যায় উন্নয়নের পথ কারণ উন্নয়ের শ্বাস-প্রশ্বাসই হলো স্বাধীনতা। আমি মন যা চায় তা-ই লিখব এতে লিখার স্বাধীনতা আছে ঠিকই তবে তা প্রকাশের ক্ষেত্রে তার সম্পাদনা অবশ্যই দরকার। ইচ্ছামতো লেখা যায় কিন্তু প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পাদনা না করলে তা সমাজে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পরে। সমাজে চলে যেতে পারে ভুল তথ্য।
যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তা থেকে বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই প্রকাশ করার সময় অবশ্যই পরিমার্জন ও পরিশীলিতভাবে তা প্রকাশ করতে হবে। আর মুদ্রণ যন্ত্রের ভূত বলে একটা কথা এখনো আছে আর বোধকরি তা থেকেই যাবে অক্ষরে ছাপা প্রকাশের ক্ষেত্রে। সায্যাদ কাদিও, স্বকৃত নোমান, শোয়াইব জিবরান, শামীম সাঈদ, জাহিদ সোহাগ, শামস আরেফিনের পাশাপাশি মনিকা আলীর রচনা কিংবা ভ্যান গগ পাবলো পিকাসো মাইকেল অ্যাঞ্জোলোমুকবুল ফিদার চিত্র তা-ই মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। পড়তে হয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। লেখালেখির স্বাধীনতা ও চ্যালেঞ্জ দুটোকেই ধারণ করে এগিয়ে চলেছে আমাদের জীবন আমাদের সাহিত্য আর তা চলবেই। তাই জীবনের থ্রিলিংটাকে নিজের মতো উপভোগ করার আনন্দ অনবদ্য।