আমন্ত্রিত অতিথি
জোবায়ের রাজু
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আজ বড় আপার বিয়ে। সারা বাড়িতে হইচই হইচই ভাব। দুপুর আসতে না আসতে সব আত্মীয়-স্বজন এসে হাজির। আয়োজন ব্যবস্থা খুব একটা বড় আকারের করা হয়নি। মোতাহার আলী এই প্রথম তার কোনো সন্তানকে বিয়ে দিচ্ছেন, তাই নিজের সাধ্যমতো একটু আয়োজনের ব্যবস্থা করেছেন। যদিও অনেক ধার-দেনা করতে হয়েছে। বন্ধুদের কাছেও সাহায্যের আবেদন রাখতে সবাই মোতাহার আলীকে ভালোই অর্থনৈতিক সাপোর্ট করেছে। বাড়ির বড় মেয়ে সালমার বিয়ে হচ্ছে। পরের সংসারে চলে যাবে আদরের মেয়েটা, এই ব্যথায় যেখানে বাড়ির সবাই ব্যথিত, সেখানে হেলাল খুশিতে আত্মমগ্ন। বড় আপার বিয়েতে সে আনন্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ফেলবে, এই স্বপ্নে বিভোর। বোনের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হতে না হতেই হেলাল দাওয়াত দিয়ে ফেলল খান বাড়ির আসিফকে। বয়সে বিস্তর ব্যবধান থাকার পরও আসিফকে বড্ড পছন্দ হেলালের। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আসিফের সৃজনশীলতা। গানে ভীষণ পারদর্শী আসিফ। পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে নিয়মিত গান গেয়ে মানুষকে মাতিয়ে রাখে। কবিতাও লিখে অসাধারণ। দেশের বড় বড় পত্রিকায় আসিফের কবিতা প্রকাশ হয়। বইও লিখেছে বেশ কয়েকটা। ছবি এঁকেও ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছে। জাদুকরী হাতে আঁকা ছবিগুলো ফেসবুকে শেয়ার করতেই তা রীতিমতো ভাইরাল। ফলে অল্প সময়ে সবার প্রশংসা কুড়াতে গিয়ে আসিফ আবিষ্কার করে সে একজন বহুমুখী প্রতিভাবান। আর আসিফের এসব প্রতিভায় মুগ্ধ হতে থাকে তার পাশের গ্রামের ছেলে হেলাল। ততদিনে ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় আসিফ জায়গা দিয়েছে হেলালকে। কিন্তু ফেসবুক আসার আগে থেকে হেলাল আসিফকে চেনে। যেহেতু পাশাপাশি গ্রামে তাদের অবস্থান, তাই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আসিফের প্রতিভার ঝলকানি হেলাল অনেকবার দেখেছে। সেই দেখাদেখি ব্যাপারগুলো ঘনিষ্ঠ আকারে রূপান্তরিত হলো ফেসবুকে এসে। হেলাল আসিফকে নিয়মিত ফেসবুকে ফলো করতে থাকে। বহুমুখী প্রতিবার কারণে আসিফকে নানান শ্রেণীর মানুষ তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন করতে ভুলে না। বিয়ে, আকিকা, জন্মদিন ম্যারেজ ডে সহ সেসব জমকালো অনুষ্ঠানে তোলা ছবিগুলো নেটে ছাড়তে কোনো প্রকার ভনিতা রাখে না আসিফ।
যেহেতু বোনের বিয়ে, তাই হেলাল আসিফকে ইনভাইটেশন মেসেজ দিয়ে লিখে পাঠায়, ‘আগামী শনিবার আমার বড় আপার বিয়ে, আপনি এলে খুশি হব।’ আসিফ ছোট্ট করে রিপ্লাই দিয়ে লিখে পাঠায়, ‘ওকে।’ খুশিতে বুক ভরে যায় হেলালের।
আসিফকে নিয়ে মনে মনে কল্পনায় ভাসতে থাকে। কল্পনার নজরে হেলাল দেখতে পায় আগামী শনিবারকে। নীল কালার এক দামি পাঞ্জাবি পরে আসিফ এসেছে হেলালদের বাড়িতে। চলনে বলনে, পোশাকে আশাকে আসিফ বাহ্যিক সৌন্দর্যে উৎরে গেছে সকল আমন্ত্রিত অতিথিদের থেকে। এবং সবার নজর আসিফের আনা ওই বক্সটার দিকে, যা কি না বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে এনেছে। কল্পনার পর্দা সরিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসে হেলাল। কিন্তু সে মনে মনে চায় আসিফ যেন বিয়েতে কোনো গিফট না এনে খাম ভর্তি নগদ টাকা দেয়। কম করে হলে অন্তত এক হাজার টাকা তো দেবেই। যদি তাই হয়, তবে সে টাকাটার কথা কাউকে জানাবে না। নিজের কাছে রেখে দিবে। গত ঈদে টিপুর বস্ত্রবিতান থেকে যে পাঞ্জাবিটি কেনা হয়েছে, টাকাটা এখনো শোধ করা হয়নি। আসিফের টাকাটা সে পাঞ্জাবি কেনার বাকি টাকা হিসেবে কাজে লাগাবে। দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে চলে। সমস্ত অতিথিদের আগমন শেষে নতুন বরও এসে গেছে। যাবতীয় নিয়মণ্ডকাননে বৈবাহিক লগ্ন চলতে থাকে, কিন্তু আসিফ আসে না। হেলাল অধীর এক প্রতীক্ষায় আসিফের আগমন কামনায় ব্যাকুল হতে হতে মেসেঞ্জারে কল দেয় আসিফকে। কিন্তু ওপার থেকে লাইন কেটে দেয়। তবু হেলাল মেসেজ লিখে পাঠায়, ‘ভাইয়া, আসেননি কেন? জলদি আসুন।’ কিছুক্ষণ পর অপার থেকে জবাব আসে, ‘আমি ভীষণ অসুস্থ ভাই।’ পাল্টা রিপ্লাই লিখে হেলাল, ‘কি হয়েছে ভাইয়া?’ কিন্তু ওপার থেকে আর কোনো জবাব আসে না।
২. বড় আপাকে নতুন বউ সাজিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাবার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বৈবাহিক অনুষ্ঠান। অতিথিদের সমাগম ভেঙ্গে যে যার বাড়ি ফিরে গেল। বাড়ির চঞ্চলা মেয়েটাকে বিদায় দিয়ে সারা বাড়িতে শোকের নীরবতা বইছে। মনোয়ারা বেগম শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। মোতাহার আলী দুয়ারে দাঁড়িয়ে বারবার চোখের জল মুছছেন। হেলালেরও মন খারাপ, কিন্তু সেটা বড় আপার জন্য নয়। আসিফের জন্য। আসবে বলেও আসিফ আসেনি। তার ভীষণ অসুখ। কি অসুখ সে কথা জানায়নি। হেলালের কৌতুহল বাড়তে থাকে। মেসেঞ্জারে আবার কল দেয়, কিন্তু ওপার থেকে এবারও লাইন কেটে দেওয়া হল। নিশ্চয়ই বড় ধরনের কোন অসুখ। না, হেলাল আর বসে থাকতে পারছে না। সন্ধ্যার পরেই রওনা দেয় আসিফদের বাড়িতে।
৩. খান বাড়িতে এসে পৌঁছে হেলাল। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় অপূর্ব এক তরুণী। - কে তুমি? - আমি হেলাল। আসিফ ভাইয়া কোথায়? - ভাইয়া তো বাসায় নেই। ওর বড়লোক বন্ধুর বোনের বিয়েতে। সকালে গেছে। - সত্যিই উনি বাসায় নেই? - মিথ্যে বলছি না। - উনি না অসুস্থ? - না তো। কে বলল? ভাইয়া মহাউৎসব নিয়ে তার বন্ধুর বোনদের বিয়েতে গেছে।
- ইয়ে মানে... - তুমি অপেক্ষা করবে? ভাইয়া পথে আছে, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। - আচ্ছা না থাক। আমি যাই তবে। সন্ধ্যার আবছায়া গায়ে মেখে বাড়ির পথে পা বাড়ায় হেলাল। আসিফ তার অসুস্থতার কথা তাকে মিথ্যে বলেছে, এ সত্য মেনে নিতে পারছে না হেলাল। তারা তো গরিব, তাই ধনীর দুলাল আসিফ এই গরিবের বিয়েতে না আসার ফন্দি করে অসুস্থতার ভান করেছে। হেলাল আসিফের এই অভিনব কায়দা বুঝে গেল। তবুও পকেটের মোবাইলটা বের করে আবার আসিফকে মেসেজ লিখে, ‘ভাইয়া, কোথায় আছেন এখন?’ কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে আসিফের রিপ্লাই, ‘তোমাকে কতবার বলব আমি অসুস্থ। আমি বাসায় আছি। সুস্থ থাকলে অবশ্যই তোমার বোনের বিয়েতে আসতাম।’ হেলাল বুঝতে পারল বেশ জেদ করে আসিফ জবাবগুলো লিখে পাঠিয়েছে। কিন্তু আসিফ জানে না তার মিথ্যে নাটকের চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে গেছে হেলাল।