ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন আল্লামা ইকবাল

ফিলিস্তিনি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন আল্লামা ইকবাল

বলা প্রয়োজন দুই হাজারের অধিক সময় ইয়াহুদিদের কোনো স্থায়ী আবাস ছিল না। এর মূলে তাদের জাতিগত বিশ্বাসভঙ্গের প্রবণতা, পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব। ফলে কেউ তাদের বিশ্বাস করত না। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের এক কংগ্রেসে ইয়াহুদিদের জাতীয়তাবাদী (জায়ানিস্ট) নেতৃবৃন্দ প্রথম ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পরিকল্পনা আঁকে এবং সেটা ওই সভায় ব্যক্ত করে। প্যালেস্টাইন তখনও উসমানীদের অধীনে। যদিও খেলাফতের পড়ন্ত বিকাল। তা সত্ত্বেও ইয়াহুদিদের ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের দাবিকে শত প্রলোভনেও কঠোরভাবে ফিরিয়ে দেন সুলতান আব্দুল হামিদ। পরবর্তীতে ব্রিটেনের সহযোগিতায় অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ ইয়াহুদিরা আরব বিশ্বের মুসলমান শাসকদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগে ফিলিস্তিনবাসীর পিতৃভূমি জবরদখল করে এক পর্যায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। যা আজও চলমান। নিজভূমে আজ ফিলিস্তিনিরা পরবাস। শত বছর আগে বিশ্ববরেণ্য উর্দু কবি আল্লামা ইকবাল ফিলিস্তিন নিয়ে ইসরাইলের হঠকারিরতা আঁচ করতে পেরেছিলেন। ফিলিস্তিনে ইয়াহুদিদের বসতির ঘোর বিরোধিতাও করেছেন বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে। তার এই বিরোধিতা তাকে ফিলিস্তিনের প্রবল সমর্থক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। চলমান গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর হামলায় আল্লামা ইকবালের কবিতাটি সামনে এনেছে পাকিস্তানের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দি ডন অনলাইন। কবিতাগুলো উর্দু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সৈয়দ আবদুল ওয়াহিদ।

ইসরাইলের ওপর ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক দাবির প্রবল সমর্থক ছিলেন উর্দু সাহিত্যের পাকিস্তানের বিশ্ববরেণ্য কবি স্যার আল্লামা ইকবাল। জারব-ই-কালীমে অন্তর্ভুক্ত তার শাম-ও-ফালাস্তিন (সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন) কবিতায় আল্লামা ইকবাল বেশ জোরালভাবে এমন সমর্থনে বলেছেন- ‘ফিলিস্তিনের ওপর ইয়াহুদির অধিকার/ স্পেনের ওপর আহলে আরবদের কোনো অধিকার নেই কেন?’

ইকবালের মতে, ‘ফিলিস্তিন আরবদের অন্তর্গত। যদি কেউ ফিলিস্তিন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত হওয়ার কারণে ফিলিস্তিনের জমিতে তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলে, আরবদেরও স্পেন থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। তাহলে সেই দাবি নিয়ে স্পেনের ওপর আরবের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত।’ ফিলিস্তিন মুসলমানদের প্রতি ইকবালের গভীর সহানুভূতি ছিল। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ইসলাম সকল জাতি, অঞ্চল এবং সীমানা অতিক্রম করে শান্তির বার্তা বহন করে। উল্লেখ্য যে আল্লামা ইকবালের মৃত্যুর ১০ বছর পর ব্রিটেনের সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্ব শুরু হয়। মৃত্যুর দুই দশক আগে থেকেই ইকবাল মধ্যপ্রাচ্যের উন্নয়ন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো ঘিরে ব্রিটেনের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের ভূ-রাজনীতি জমে উঠেছে। তৎপরতা আর অপতৎপরতার ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত হয়েছিল পুরো আরব। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের পরাজয়ে পশ্চিমা নিলামে উঠেছিল আরব বিশ্ব।

এই সুযোগে পশ্চিমা দেশগুলি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জমি দেওয়ার জন্য ঝুঁকছিল। সমন্বিত আলোচনার মুসলিম বিশ্বকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ধীরে ধীরে অস্বীকার করতে শুরু করে যা পরবর্তীতে দৃশ্যমান হতে থাকে। তাই বশির আহমেদ দার তার আনোয়ার-ই-ইকবাল গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর লাহোরের বিখ্যাত মোচি গেটের বাইরে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় ইকবাল ব্রিটিশ সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার দাবিতে পাল্টা একটি প্রস্তাব পেশ করেন। মুসলমানদের মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ভূখণ্ড নিয়ে পূর্ণতা পূর্ণ হোক। তিনি জোর দিয়েছিলেন- ‘যে কোনো মুসলিম জমির কোনো অংশ অন্য কোনো পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা উচিত নয়।’ ওই সময় প্যারিস শান্তি সম্মেলনের পর বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়।

ফলস্বরূপ ১৯২০ সালে লীগ অব নেশনস গঠিত হয় যেটা জাতিসংঘের আদিরূপ। দুর্ভাগ্যবশত বড় শক্তিগুলো লিগ অব নেশনস-এর বিষয়গুলির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে সংস্থাটিকে বিতর্কিত করে।

ইকবাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং লীগ অব নেশনস গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের প্রতি যে বৈষম্য হয়েছিল তা দেখে কার্যত হতাশ হয়েছিলেন। তিনি লিগ অব নেশনসকে ‘কাফন দুজদে চাঁদ’ বা কবর থেকে কাফন চুরির সংস্থা বলে চার লাইনের ব্যঙ্গাত্মক রচনা লিখেছিলেন। ১৯২৩ সালে ফার্সি ভাষায় রচিত পেয়াম-ই-মাশরিক বা প্রাচ্যের বার্তা শিরোনামে কবিতার সংকলনে এমন উদ্ধৃতি পাওয়া যায়।

বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এমন- ‘অধিকার সংরক্ষণের নামে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে / বিশ্বের শুভাকাঙ্ক্ষীরা নতুন সংস্থার বিবর্তন করে; কিন্তু আমি জানি এটা কাফন-চুরির মতো সবার মাঝে কবর বিতরণের জন্য লীগ গঠন করেছেন।’ ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে, ইকবাল ব্রিটিশদের দ্বারা অনুসরণ করা ইহুদিপন্থী নীতির সমালোচনা করে একটি বক্তৃতা দেন। যা মুহাম্মদ রফিক আফজাল তার বই গুফতার-ই-ইকবাল-এর ৯৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন।

‘তুর্কিরা ইয়াহুদিদের প্রতি অসাধারণ সহনশীল মনোভাব দেখিয়েছে। তারা তাদের বুরাক প্রাচীরের সামনে স্বল্প পরিসরে ধর্মীয় আচারের সুযোগ দেয়। সে কারণেই এটি ওয়াইলিং ওয়াল নামে পরিচিতি লাভ করে। ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী আল-আকসা মসজিদের পুরো আদালত এলাকাটি ‘ওয়াকফ’ বা এনডোমেন্ট। ইহুদিরা এর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার দাবি করে কিন্তু আইনগত ও ঐতিহাসিকভাবে তাদের কোনো অধিকার নেই।’

লিগ অব নেশনসের সদর দপ্তর ছিল জেনেভা, সুইজারল্যান্ডে এবং ব্রিটেন ইয়াহুদিদের সমর্থন করছিল। তাই ইকবাল তার জারব-ই-কালীমের ফালাস্তেনি আরব সে কবিতায় ফিলিস্তিনি আরবদের উদ্দেশে ইঙ্গিত করেছেন এই বলে যা বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘তোমাদের চিকিৎসার ওষুধ জেনেভাও নয়, লন্ডনেও নয়, কারণ পশ্চিমের শিরা ইয়াহুদিদের খপ্পরে রয়েছে।’

মুহাম্মদ হামজা ফারুকী তার একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন- আল্লামা ইকবাল ১৯৩১ সালের শেষ কয়েক মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় গোলটেবিল সম্মেলনে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের দাবি অনুযায়ী বৃহত্তর স্ব-সরকারের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করার জন্য অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই দিনগুলিতে, মোতামার আল-আলম আল-ইসলামী বা বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেস, ইয়াহুদিবাদী হুমকি নিয়ে আলোচনা করার জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করছিল। পরে লন্ডন সম্মেলন ত্যাগ করে ইকবাল সম্মেলনে যোগ দিতে জেরুজালেমে যান।

আরো অনেক অনুষ্ঠানে ইকবাল ফিলিস্তিনকে সমর্থন করেছিলেন। এমন একটি নজির পাওয়া যায় ১৯৩৭ সালে ৭ অক্টোবর মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে সম্বোধন করে লেখা চিঠি থেকে। তিনি ওই চিঠিতে লিখেন- ‘ফিলিস্তিন প্রশ্নটি মুসলমানদের মনকে আন্দোলিত করছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই এই প্রশ্নে লীগ একটি শক্তিশালী প্রস্তাব পাস করবে। তাই এই অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যেখানে জনসাধারণ বিপুল সংখ্যায় জনগণ অংশ নিতে পারে। এটি একযোগে লীগকে যেমন জনপ্রিয় করবে, তেমনি ফিলিস্তিন আরবদের সাহায্য করতে ভূমিকা রাখবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন একটি ইস্যুতে জেলে যেতে আপত্তি করব না; যা ইসলাম এবং ভারত উভয়কেই প্রভাবিত করে।’

অর্থাৎ ফিলিস্তিনের জন্য তার সমর্থন এতোটাই প্রবল এবং অকাট্য ছিল যে, প্রয়োজনে জেলে যেতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু বিধিবাম অসুস্থতার কবলে পড়ে এর ছয় মাসের মাথায় আল্লামা ইকবাল মৃত্যুবরণ করেন! আর এর সঙ্গে একজন বিশ্ববরেণ্য ফিলিস্তিনি নির্যাতিত বন্ধুর তৎপরতা থেমে যায়, কিন্তু তার লিখে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণী যেন মুক্তা দানার মতোই নিপীড়নের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত