শেষ চোতের দিনগুলোতে প্রকৃতি বড্ড খামখেয়ালি! কখনও দুরন্ত বাতাস ধুলোবালি উড়িয়ে বসতবাড়ির আঙিনা- খোলামাঠে ছড়িয়ে দেয়। আজকাল প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই মেঘের প্রচণ্ড গর্জন-আকাশে গর্জন তোলে- বিদ্যুচ্ছটা চমক মারে! কখনো আকাশ ভরে যায় অন্ধকার কালোমেঘে। বেশিরভাগই মিথ্যা মেঘ। ক্ষয়িষ্ণু প্রেমের সম্পর্কের মতো। বৃষ্টি থাকে না তাতে। একটু পরেই মেঘ সরে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়। ধবধবে জোসনা ভরা চাঁদ ওঠে আকাশে। ফসলশূন্য মাঠে জোসনা খেলা করে। সেইসাথে দখিনা বাতাস নিত্যনতুন সুরে- তালে বয়ে যায়। কোনো কোনো বছর চোত মাসের শেষরাতে তীব্র শীতও জেঁকে বসে। মাঘ মাসের চেয়েও হাড়কাঁপানো সে শীত! এমনই শেষ চোতের এক শেষরাতে ঝড়ুমেকার স্বপ্ন দেখে, কুমোর গাড়ার বিলে সে মাছ ধরতে গেছে। বিলভরা মানুষ। কারো দিকে কারো খেয়াল নেই। সবাই নিজ নিজ পলো, ট্যাঁটা নিয়ে ঘোলা পানির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মাছেদের গতিবিধি নিরীক্ষণে মগ্ন। ট্যাটা কিংবা পলো যাদের নেই তারা বিলের কিনারে হাতড়ে হাতড়ে মাছ ধরে। ঝড়ু মেকারও হাতড়ে মাছ ধরছিল। মাছের রাশি বুঝি ভর করেছে ঝড়ু মেকারের হাতে। টপাটপ সে মাছ ধরছে আর খালুইতে রাখছে- পাবদা, পুটি, টেংরা, মাগুর, জীয়ল। পরপর দু’টো জীয়লমাছ খালুইতে রেখে পরবর্তী মাছটা ধরতে যেতেই, ‘মাগো!’ বলে ঝড়ু কুঁকিয়ে ওঠে। মাঘের শীতে জীয়লের কাঁটার দংশন! ঝড়ুর শরীর কাঁপিয়ে শীত করতে থাকে। সেইসাথে ডানহাতের মধ্যমার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা! স্বপ্নের মাঝেই ঝড়ুর মাছধরা, জীয়লের দংশন আর সেইসাথে শেষ চোতের কাঁপুনি ধরানো জাড়! চোখ না খুলেই ঝড়ু বিছানা হাতড়াতে থাকে। হাতে কোনোকিছুর স্পর্শ না আসায় ঝড়ুর মাঝে পুরোনো অভ্যাস ঊঁকিমারে, ‘ফজোর মা, আমার গা’র উপর কিছু এট্টা দেওদিনি- জাড় লাগজে!’ কোথায় ফজোর মা? ঝড়ুর শীতলাগা-কাঁপুনিধরা শরীরে ওমের ব্যবস্থা করতে কেউ এগিয়ে আসে না। শূন্যঘরে-শূন্যশয্যায় শীতের প্রকোপেই হোক কিংবা শেষরাতে টাটিঘরে যাবার দরকারেই হোক ঝড়ু চোখ মেলে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পায় না। বাইরের অন্ধকারের মতো তার চেতনার কুঠরিতেও তখন অন্ধকারের রাজত্ব। একসময় ঝড়ু বুঝতে পারে, তাকে কেউ দেখছে না। তার কথাও কেউ শুনছে না। যাকে উদ্দেশ্যে করে সে কথাগুলো বলল কুড়ি বছর আগেই সে জগতের মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। মরণের আগে ঝড়ুর সাথে তার বউয়ের প্রায়ই ঝগড়া লাগত। ঝড়ু প্রকাশ্যে বেশ ক’দিন স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছে। ঝড়ুর স্ত্রীও পা দাপিয়ে দাপিয়ে ঝড়ুর টাটকা মরণ কামনা করেছে। সত্যি সত্যি বউটা মরার পর থেকে ঝড়ু বড় অসহায় হয়ে গেছে।
শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ঝড়ু নিজের শরীরের নিচে লেপটে থাকা-যথাস্থানে না থাকা লুঙ্গিটা টেনেটুনে পুরো শরীর তার মধ্যে সেঁধিয়ে দেবার চেষ্টা করে। অর্ধচেতন অবস্থায় অন্ধকারে ঝড়ুর লুঙ্গিটার সর্বশেষ যে অবস্থা হলো তা সে মুহূর্তে কেউ দেখলে বুঝতে পারত, ঝড়ু যথেষ্ট আব্রুর মধ্যে নেই।
২
তাহেরপুর বাজারের তিনতলা মার্কেটের পাশে পুরোনো টিনের চালের দোকানটা ঝড়ু ওরফে ঝড়ুসেখের। ঝড়ু সেখকে এলাকার অনেকে বিবিসি ঝড়ু বলেও চেনে। দোকানের টিনের চালে জংধরা। দুয়েক জায়গা ফুটো হয়ে বৃষ্টির ফোঁটা বিনা অনুমতিতেই ঢুকে পড়ে। তিনতলা মার্কেটের পাশে পুরোনো টিনের চালের এই দোকানটা বড্ড বেমানান-অনেকটা ঝড়ু সেখের মতোই! বাজারের সব দোকানই এখন চকচকে। দোকান মালিক-সেলস্ম্যান কর্মচারীর কেউই ঝড়ুর বয়সি নয়। আর এ বয়সে কেই বা ব্যবসাপাতি কিংবা দোকান সামলায়? ঝড়ুর এই দোকান এখানে বেমানান ঘোষণা করে বেশকয়েকবার বাজার কমিটির সেক্রেটারি জানিয়েছে। শুধু বাজার কমিটির সেক্রেটারি কেন তার দুই ছেলেও বাপকে বলে বলে ব্যর্থ হয়েছে, বাজারে এমন পজিশনের জায়গায় এখন রেডিও-টেলিভিশন-সাইকেল মেকারের দোকান চলে? আট শতাংশ জমির উপর মার্কেট বানিয়ে দোকান ভাড়া দিলেও ঝড়ুর ইনকাম হতো কমপক্ষে মাসে লাখ টাকা। কিন্তু ঝড়ুর এক কথা, ‘তুমাগের জমিতি তুমরা মার্কেট বানাওগা, লাকোপতি হওগা- কোটিপতি হওগা! আমি বাঁইচে থাকতি এই দুকান এইরামই থাকপে!’ পাকিস্তান আমলে ঝড়ু এই আট শতাংশ জমি চারশো টাকায় কিনেছিল। ঝড়ু শুনেছে, এখন বাজারে নাকি এক শতাংশ জমির দামই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা। তাতে ঝড়ুর কী? ঝড়ুর অত টাকার প্রয়োজন নেই! জমিটা কেনার পরে ঝড়ু মেকার প্রথমে এখানে সে ছনের ছাউনি দেওয়া দোচালা ঘর তুলে একটা সাইকেল সারানোর দোকান করেছিল। ক্রমে ক্রমে সে সাইকেল মেকার থেকে রেডিও সারানোর মেকার হয়েছে। পাশাপাশি হ্যাজাকবাতি, টিউবওয়েল, আখ মাড়াইয়ের কল- এসবও মেরামতের জন্য এলাকায় সে স্বনামধন্য মেকার। আজকাল টেলিভিশনই কেউ দেখতে চায় না- রেডিও তো দূরের কথা। তবু সন্ধ্যা হলে নিয়মিত ঝড়ু বিবিসির খবর শোনে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তার দোকানে বিবিসি আর আকাশবাণীর খবর শোনার জন্য অনেকেই তার দোকানের ঝাঁপের নিচ দিয়ে গোপনে ঢুকত। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধার অদম্য সাহস আর কার্যকলাপে মুগ্ধ ছিল ঝড়ু। তার কাছ থেকে একাত্তরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা রেডিও ধার করে নিয়ে যেত। সেসব রেডিও নতুন না- পরিত্যক্ত ঘোষিত, কাস্টমারদের ছেড়ে যাওয়া রেডিও দক্ষ মেকার ঝড়ু চালানোর উপযোগী করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতো। ডজন ডজন হক আর চান্দা ব্যাটারি ঝড়ু নিজের টাকায় কিনে মুক্তিযোদ্ধাদের রেডিওতে লাগিয়ে দিতো। এছাড়া ঝড়ু মেকার একব্যান্ডের রেডিওকে দুই ব্যান্ড বানিয়ে বিবিসির খবর শোনার উপযোগী করে দেবার ওস্তাদ। বাজারের পাশে স্কুলঘরে পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প হয়েছিল। দুই-তিন দিন ক্যাম্পের মেজর সাহেব নিজে এসে ঝড়ুর কাছে বলেছে, ‘ইয়ে ঝড়ু সাহাব হামারা রেডিওমে স্বাধীন বাংলা আয়েগা কিয়া?’ ঝড়ু মেকার মেজর সাহেবের রেডিও খুলে এ পার্টস ও পার্টস একটু টিউন করে শেষ পর্যন্ত বলেছে, ‘এ্যায়সা মাফিক রেডিও সেটমে স্বাধীন বাংলা নেহি আয়েগা। স্বাধীন বাংলা শুননেকে লিয়ে দুই ব্যান্ড রেডিও চাইয়ে।’ অথচ সত্যি কথা বলতে কী-ওই কর্মটা ঝড়ুর কাছে এক টিপ নস্যি মাত্র! কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের জন্য সে কাজ করবে কেন?
ঝড়ুর কথা শুনে মেজর সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের উপর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বিষোদ্গার করে, ‘শালে মুক্তি! কিয়া রেডিও স্টেশন বানায়া ওভি একব্যান্ড রেডিওমে নেহি শুন সাকতে! শালে গিধধড় কি আওলাদ!’
৩
দোকানে বসে ঝড়ু মেকারের চেখে ঝিমুনি আসে। ফজোর মা’র মুখখানা কতকাল তার মনের পর্দায় আসে না। অথচ নামটা উচ্চারণ করলে এখনও ঝড়ুর মনে হয়, ফজোর মা এই এলো বলে- বাপের বাড়ি গেছে।
এখন আর ঝড়ু মেকারের দোকানে খদ্দের তেমন আসে না। ব্যাটারি ব্যবহারের ফলে ভ্যানরিকশাগুলোও আর আগের মতো নষ্ট হয় না। গ্রামের রাস্তাও এখন আর এবড়ো থেবড়ো নেই। ভ্যান রিকশার চাকাও আর আগের মতো নষ্ট হয় না। গ্রামাঞ্চলের সব খানেই যাতায়াতের জন্য পিচঢালা পথ। তাছাড়া রেডিও-ক্যাসেট কিংবা সাদাকালো টেলিভিশন এর যুগ সেই কবেই ফুরিয়ে গেছে। রঙিন টেলিভিশন নিয়ে ঝড়ুর কোনো আগ্রহ নেই। সে রঙিন টেলিভিশন সারাতে পারে না। এখনকার টেলিভিশনের ‘আইসি’ সম্পর্কে ঝড়ুর কোনো ধারণাও নেই। তবু খদ্দেরবিহীন দোকানে ঝড়ু বসে থাকে-সময় কাটায়। সিগন্যাল খারাপ থাকলে টেলিভিশনে দামি এন্টেনা থাকলেও অনেকসময় শব্দ আসে কিন্তু ছবি আসে না। আবার ছবি এলেও শব্দ শোনা যায় না। সিগন্যাল ও এন্টেনার ফ্রিকোয়েন্সি সমান হলেই কেবল ছবি ও সাউন্ডের সমন্বয় ঘটে। বেশ ক’বছর পরে গতরাতে মাছধরা, শীতলাগা ও ফজোর মা’র কথা মনে হওয়াতে ঝড়ু মেকারের মনের টেলিভিশনের পর্দায় নানা শব্দ আর ভাঙা ভাঙা ছবির আনাগোনা শুরু হয়েছে।
দোকানে বসে ঝিমুনির মাঝে ফজোর মা’র মুখটা ঝড়ু মেকারের মনের পর্দায় কাঁপতে কাঁপতে স্থির হলো। ঝড়ু দেখতে পায় ফজোর মা’র মুখ; শুনতে পায় ফজোর মা’র কণ্ঠ, ‘তুমার উ-তো পুঁচাশি বচ্ছোর বয়াস হয়ে গেলো- আর কতদিন থাকপা? দুকানের পিছনের নিমগাছের নিচি পুঁতে রাকা নিবারণের পিতলের ঘটি আর ঘটিভরা সোনা-দানার কতা ছেলে দুডোর বুলে দেও। দ্যাশ স্বাধীন হয়েচ্ কত বচ্ছোর হয়ে গেল! নিবারণ বাঁইচে থাকলি ইন্ডিয়াততে এ্যাদ্দিন কবে আইসে ওই ঘটি নিয়ে যা’তো। মুক্তিযুদ্ধোর বচ্ছোর তুমার কাচে নিবারণ ঘটি রাইকে গেলো। ওই ঘটির মদ্দি থাকা বড় হারখান তুমার কাচে আমি কত চাইচি, তুমি দেওনি। বুলোচো যে, উডা নিবারণের আমানত! সে ফিরে আইসে য্যাকোন চাবে ফিরিয়ে দিবা। কই পুন্চাশ বছোর পার হয়ে গেলো নিবারণ তো আ’লো না। তুমার এই দুকান, নিমগাছের নিচির ঘটি সপ ছেলেগের দিয়ে দেও, ছেলেগের বুলে দেও সপ কতা!’ ‘ফজোর মা, ও ফজোর মা!’- ঝিমুনিভরা স্বপ্নের মাঝেই ঝড়ু স্ত্রীকে সম্বোধন করে কেঁদে ওঠে। কেউ সাড়া না দেওয়ায় ঝড়ুর ঝিমুনি ছুটে যায়। দোকানের পেছনের নিমগাছটা ঝড়ে দুইবার ডালপালা হারালেও এখনও গাছটা ঝড়ুর মতোই সংসারের নানা ঝাপটার মাঝেও টিকে আছে। একাত্তর সালের সেই নিমগাছটা গায়ে গতরে এখন কত বড়! ঝড়ু মেকার দোকান ঘর থেকে বের হয়ে ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছটার শীর্ষে তাকানোর চেষ্টা করে। মুমূর্ষু রোগীর শরীরে হাত রাখার মতো অতি সন্তর্পণে নিমগাছটার গায়ে হাত বুলাতে থাকে।