আবুবকর সিদ্দিককে যেমন দেখেছি
মামুন মুস্তাফা
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গত বছরের শেষ লগ্নে অর্থাৎ ২০২৩-এর ২৮ ডিসেম্বর কবি ও কথাকার আবুবকর সিদ্দিকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতাযাত্রার পথিকৃৎ কবি হিশেবে চিহ্নিত পাঁচের দশকের শেষ পালকটিও ঝরে গেল। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার গল্প-কবিতা, গণসংগীতসহ সাহিত্যের বেশকিছু বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ আমি বলব আমার সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই মহীরুহের আশৈশব যে সম্পর্ক এবং আড্ডার ভেতর দিয়ে যেসব টুকরো টুকরো বিষয় আমি জেনেছি তার দুয়েকটি মাত্র। পিতার বন্ধু হিসেবে শৈশব থেকে দেখা আসা আবুবকর সিদ্দিকের মানসগঠনটি কেমন ছিল? এ কথাও অনস্বীকার্য যে, কবিতা কেমন হওয়া উচিত, গদ্যসাহিত্য কি, কার কার লেখা পড়তে হবে ইত্যাদি উপদেশ দিয়ে তিনি কবি মামুন মুস্তাফার ভেতরের সত্তাটিকে তৈরি করে দিয়েছেন। আবার আবুবকর সিদ্দিকের মতো একনিষ্ঠ পাঠকও আমার চোখে পড়েনি। তিরিশের অন্যতম প্রধান কবি বিষ্ণু দে-র সঙ্গে তার সখ্য, চিঠির আদান-প্রদান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুতা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু; এদেশে সিকানদার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান- এদের সঙ্গে তার কথোপকথনের বিষয় ও আড্ডা কবি আবুবকর সিদ্দিকের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বলা আবশ্যক, বরাবরই আমার ভেতরে একটা দ্বিধা-সংকোচ কাজ করত। ফলে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথিতযশাদের সংস্পর্শ থেকে আমি দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। আজও অনেক অগ্রজই বলে থাকেন, তোমার লেখার সঙ্গে পরিচিত কিন্তু তোমার সঙ্গে তো পরিচয় নেই। এমনকি আমার সমসাময়িক কবি-লেখকদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ও কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মুজাহিদী, ড. মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন, শিহাব সরকার, নাসির আহমেদ, সৈয়দ হায়দার, তারিক-উল ইসলাম, ফারুক মাহমুদ প্রমুখসহ আমার সময়কার অনিকেত শামীম, ওবায়েদ আকাশ, শামীম রেজা, ব্রাত্য রাইসু ও শহীদ ইকবাল- এদের সবার সঙ্গে যোগসূত্রের সাঁকো হচ্ছেন আবুবকর সিদ্দিক। পরবর্তীতে এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছিল আবুবকর সিদ্দিক তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে ঢাকাতে আবাস গেড়েছিলেন বিধায়। তবে বিশেষণের পরে বিশেষণ দিলেও এই ব্যক্তির অধ্যাপনার গুণকীর্তন কিংবা লেখকসত্তার ধী-শক্তি বর্ণনা করা সম্ভব হবে না। তার ছাত্র, সমকালীন চিন্তক ও প্রাবন্ধিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শহীদ ইকবাল এক সাক্ষাৎকারে আবুবকর সিদ্দিক সম্বন্ধে বলেছেন, ‘সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে তার নখাগ্র স্পর্শ; কল্পনা ছাড়া আমার জন্য আর কিছু নয়’। এই মানুষটিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি ছেলেবেলা থেকে। প্রথম জীবনে বর্তমান বাগেরহাটের সরকারি প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে আমার পিতার সহকর্মী ছিলেন তিনি। ওই কলেজে আমার পিতা মুহম্মদ গোলাম রসূল ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক আর কবি ছিলেন বাংলার। তবে তারও আগে পাঁচের দশকে আব্বা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে এলেন, থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তথা আজকের এসএম হলে। তখন আবুবকর সিদ্দিক বাংলা বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। আমার পিতার ৩/৪ বছরের সিনিয়র। ওই এসএম হলেই তাদের পরিচয়, সাক্ষাৎ। পরবর্তীতে চাকরিসূত্রে, সহকর্মী হিসেবে সে সম্পর্ক রূপ নেয় বন্ধুত্বে- গাঢ়, অন্তরঙ্গ, হরিহর আত্মা। পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহ, আধুনিক কাব্যধারার অন্যতম কবি আবুবকর সিদ্দিকের যাতায়াত আমাকে ওই বালক বয়সে কবি হওয়ার পথে ডেকে নেয়। কী মোহন বাঁশি ছিল সেটি! জানি না, কিন্তু তখনও আবুবকর সিদ্দিকের একখানাই কাব্য ধবল দুধের স্বরগ্রাম না বুঝেই পড়ে চলতাম অহোরাত্র। তবে এটা বুঝেছি পারিবারিক বন্ধু তিনি। তখন তিনি রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে বাংলার অধ্যাপক। জন্মসূত্রে বাগেরহাটের মানুষ। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের বৈটপুরে। যখনই বাগেরহাটে আসতেন, প্রায়ই সময় আমাদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করতেন। সে রাতে দুই বন্ধু- আব্বা ও সিদ্দিক চাচা (চাচা বলেই ডাকতাম) সাংসারিক জীবন থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্য, বিশ্ব সাহিত্যকে নামিয়ে আনতেন দুজনের শয়ন-শিয়রে। বালক আমি চুপচাপ বসে বসে শুনতাম, আর নিজেকে গড়ে নিতাম। আমি লিখি জেনে একবার তিনি আমার জন্য কিছু ছড়া লিখে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের দুপুরের আহার শেষে তিনি প্রথমে আমার কবিতা শুনতে চাইলেন। কিন্তু আমার লেখা কবিতা শুনে তিনি বললেন, ‘চাচু, তুমি তো বড়োদের কবিতা লেখো। আমি যে ছড়া লিখে নিয়ে এসেছি।’ আমি তখন সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সেই প্রথম তার সঙ্গে আমার কবিতা বিনিময়।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার লেখা ‘মা’, ‘ট্রেন’সহ আরও কিছু কবিতা আবুবকর সিদ্দিক নিয়ে গেলেন এবং তারই হাত দিয়ে রাজশাহীর তৎকালীন দৈনিক বার্তা, ছোটদের পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত নবারুণ ও কিশোর কথা’য় প্রথম প্রকাশ পায়। আব্বা তখন খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজে। আব্বার কলেজের ঠিকানায় সিদ্দিক চাচা পাঠালেন। সেই প্রথম কাগজে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম, নিজের লেখা দেখে যে আনন্দ, সেই অনুভূতি প্রকাশ করার নয়। লেখকমাত্রেই তা সবাই অনুধাবন করতে পারেন। এ ভাবেই আবুবকর সিদ্দিক হয়ে উঠলেন আমার জীবনের অনুষঙ্গ। পরবর্তীতে আর আব্বা নয়, আমাকেই তিনি তার প্রকাশিত প্রতিটি নতুন বই পোস্ট করে পাঠাতেন। তার আনেক লেখাই তখন আমার জন্য বোধগম্য ছিল না। তবু প্রিয় মানুষের বই অন্য আনন্দ বয়ে আনত। আব্বা বলতেন, ‘সিদ্দিক ভাই, তিরিশের সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশের সংমিশ্রণ। তার কবিতার ধার বাংলাদেশে বোঝার মতো সমালোচক গড়ে ওঠেনি। যেমন- সব এমএ পাসই রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারে না।’ তাই বুঝি বাংলাদেশের সাহিত্যে যেভাবে তাকে নিয়ে আলোচনা হবার কথা ছিল, তা হয়নি। তার উইট, ধী-শক্তি বোঝার ক্ষমতা কার আছে? আবুবকর সিদ্দিক- আপাদমস্তক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটির সাহিত্যকৃতির বোধ ও বোধিকে ছুঁয়ে দেখার সক্ষমতা তৈরি হয়নি এই পাঠককুলের। আবার তিনি নিজেকে বাজারচলতি করেননি কখনো। সে স্পর্ধাও নেই আজকের মিডিয়াবাজদের। তিনি বহুপ্রজ নন, বিরলপ্রজ। যা লিখেছেন, তাই এপিক। কী কবিতা, কী কথাসাহিত্য! তা না হলে, যখন আবুবকর সিদ্দিকের কোনো বই-ই প্রকাশ হয়নি, সেই তখন ষাটের দশকে তিরিশের পঞ্চপা-ব হিশেবে খ্যাত কবি বিষ্ণু দে তাকে কেন বই উৎসর্গ করবেন? বাংলা সাহিত্যের অনন্য শীর্ষ কবি বিষ্ণু দে তার সংবাদ মূলত কাব্য কবিতাগ্রন্থটি আবুবকর সিদ্দিককে উৎসর্গ করলেন, সঙ্গে শামসুর রাহমান। আমাদের কাব্যযাত্রার এ এক দুর্লভ ইতিহাস। বাংলাদেশের অন্যতম যশস্বী কবি নির্মলেন্দু গুণ আবুবকর সিদ্দিকের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘কবি আবুবকর সিদ্দিক সম্পর্কে এখানে আমি কিইবা বলতে পারি। যাকে বিষ্ণু দে বই উৎসর্গ করেন, তাকে নিয়ে বলার কিছু নেই।’ আমাদের দুর্ভাগ্য, জাতি হিসেবে আমরা আমাদের প্রকৃত গুণীদের মূল্যায়ন করতে জানি না। এ কথা সত্য যে, জাতি হিশেবে আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ, অকৃতজ্ঞ এবং আত্মঘাতী। সেই মানুষই কেবল অন্যের গুণপনাকে মুক্ত মনে স্বীকার করতে পারেন, যিনি নিজে একাধিক বিষয়ে গুণময়। দুঃখদায়ক সত্য এই, আমাদের চারপাশে এমন মানুষের বড়ো আকাল। এই চাটুকারতাড়িত সমাজে এটুকুই আশার কথা যে, মিডিয়া কবি আবুবকর সিদ্দিককে নিয়ে ব্যবসা করতে চায়নি কিংবা পারেনি। এমনকি আবুবকর সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ ছাত্ররাও তার কাছ থেকে মধু আহরণ শেষে নিঃশব্দে কেটে পড়েছেন আড়ালে। তারা জেনে গেছেন, এই প্রত্যয়দীপ্ত ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে অমূলক, অনির্ণিত, অশোভন কিছু পাওয়া যাবে না, যা তাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করে দিতে পারে। অতএব তারা চাটুকারতাড়িত সমাজের মাথায় ঘি ঢালতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কবিরা তাঁকে এড়িয়ে গেছেন তার কবিত্বশক্তির কারণে, গদ্যকাররা কাছে টেনে নেননি তার কথাসাহিত্যের ভাষারীতি ও অমিয় তেজের কারণে।
এই ঢাকা নগরীতে তিনি ছিলেন বেশকিছুকাল। কখনো তেজকুনিপাড়া, শাহজাহানপুর, কখনো হাজীপাড়া, সবশেষে ছিলেন মালীবাগ চৌধুরীপাড়ার মোড়ে একটি বাড়ির চিলেকোঠায়। সবখানেতেই আমি গিয়েছি; কথা হয়েছে সহিত্য প্রসঙ্গে, তার জীবনের নানা দিক নিয়ে। আমি আবিষ্কার করেছি তার ভেতরের একজন খাঁটি দেশপ্রেমিককে, দেখেছি সহজ-সরল একটি শিশুসুলভ মন। মানুষকে বিশ্বাস করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার যন্ত্রণা। সহকর্মী ও সহযাত্রীদের শঠতা-কৃতঘতা। অথচ অধ্যাপনা এবং সাহিত্য- এ দুয়ের ভেতরে কোনো চালাকি ছিল না তার। আর তাই আবুবকর সিদ্দিক বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যমোদিদের কাছে এক পূজনীয় নাম। ২০১৫ সালে আমি শুরু করি ছোটকাগজ লেখমালা সম্পাদনা। সে-বছরই কবির ৮০ বছর পূর্ণ হয়। লেখমালা তাকে নিয়ে যৎসামান্য একটি সংখ্যা করে। লেখমালার ওই সংখ্যায় আমি আমার পিতাকে আবুবকর সিদ্দিক সম্পর্কে লিখতে বলি। যার সাবহেড করেছিলাম ‘সহকর্মীর চোখে’। আব্বা তার সহকর্মী আবুবকর সিদ্দিক সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখেন, কিন্তু তার অধ্যাপনার গুণপনা সম্বন্ধে বলেন: ‘অধ্যাপনা জীবনে কবির মধ্যে অনেক গুণের সমাবেশ দেখেছি। যদি কোনো অনুষ্ঠানে ছাত্রদের মধ্যে অস্থিরতা বা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেছে বা তাদের মধ্যে সোরগোল শুরু হয়েছে, আমরা কবিকে (আমাদের সিদ্দিক ভাইকে) দাঁড় করিয়ে দিতাম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। তিনি চমৎকারভাবে তার ভাষার মহিমা ও বাচনভঙ্গি দিয়ে শান্ত করেছেন ছাত্রদের। এ যাদুবিদ্যা হলো তার বাংলা ভাষার উপর অগাধ স্বাচ্ছন্দ্য ও পাণ্ডিত্য। তার ভাষার সুললিত শব্দমাধুর্যের এক চিত্তাকর্ষক তরঙ্গ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মন্ত্রমুগ্ধ ও নীরব করে রাখতো। তখন মনে হয়েছে ইংরেজ কবি সুইনবার্নের কথা। এ ইংরেজ কবির রচনার বিষয়বস্তু ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের বুঝতে কষ্ট হলেও তাঁরা বুঝতে পারেন কবির গীতিময়-ছন্দময় ভাষার শিল্পনৈপুণ্য। আবুবকর সিদ্দিকের মধ্যে সুইনবার্নের ওই গুণাবলি আমরা লক্ষ্য করি। আর এ কারণেই ক্লাসের পাঠদানে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আবুবকর সিদ্দিক ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় এক শিক্ষক, আবার একই কারণে কোনো কোনো সহকর্মীর চোখে ঈর্ষাপরায়ণ।’
এই ঈর্ষাপরায়ণতার অনেক ধরনের সাক্ষী তিনি হয়েছেন- কি পেশাগতভাবে কি সাহিত্যকৃতির জন্য। বিষ্ণু দে যখন কাব্য উৎসর্গ করলেন, তখন প্রয়াত কানাডাপ্রবাসী কবি ইকবাল হাসান আবুবকর সিদ্দিকের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। যেহেতু ওই কাব্য শামসুর রাহমানকেও উৎসর্গ করা ছিল। তাই ইকবাল হাসান শামসুর রাহমানেরও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলেন। কিন্তু এরপরই আবুবকর সিদ্দিককে এড়িয়ে চলেন। তবে কানাডা চলে যাবার আগ মুহূর্তে আমাদের সাহিত-সংস্কৃতির কোনো এক অদৃশ্য নগ্ন খেলার কারণে তিনি যে আবুবকর সিদ্দিকের সাক্ষাতকার নিতে পারেননি, সে জন্য কবির কাছে ক্ষমা চেয়ে যান। এই ঈর্ষাপরয়ণতার শিকার তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুবার হয়েছেন। অথচ আবুবকর সিদ্দিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার পরে বাংলা বিভাগের পাঠ্যক্রম থেকে তিরিশের কবিদের পড়ানো বন্ধ ছিল বেশকিছু কাল। কেননা ওই বিষয় পড়ানোর মতো শিক্ষক সেখানে ছিল না।
তবে এদেশে আবুবকর সিদ্দিকের উইটকে ঠিকই ধরেছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, শওকত ওসমান, শওকত আলী প্রমুখজন। সিকান্দার আবু জাফর সেই পাঁচের দশকে সম্পাদনা করতেন সাহিত্য পত্রিকা ‘সমকাল’। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। এই ‘সমকাল’ নামে সিকান্দার আবু জাফরের একটি প্রকাশনাও ছিল। তিনি বহুবার আবুবকর সিদ্দিককে কবিতার পাণ্ডুলিপি দেবার কথা বলেছিলেন, তাঁর ‘সমকাল’ প্রকাশনী থেকে বের করবেন। কিন্তু পালিয়ে গেছেন আবুবকর সিদ্দিক। কবিতার বই, দুঃসাহস! আর আজ আমরা দু’কলম না লিখতেই অস্থির হয়ে উঠি বই প্রকাশে, কবি সাজতে! ১৯৫৭ সনে দুরু দুরু বক্ষে আবুবকর সিদ্দিক দুখানি কবিতা ‘সমকাল’ দপ্তরে হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে দিয়ে আসেন। রাশভারী হাসান ফিরেও তাকাননি কবির দিকে। অথচ পরের সপ্তাহে প্রকাশ পেল সমকালে তার দুটি কবিতাই। এই হাসান হাফিজুর রহমানই গদ্য লিখতে উৎসাহ দিয়েছেন আবুবকর সিদ্দিককে। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে হঠাৎ পথচলতি পথে নীলক্ষেতে বলাকা সিনেমা হলের সামনে আবুবকর সিদ্দিকের সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমানের দেখা। তিনি আবুবকর সিদ্দিকের হাত ধরে বেশি বেশি গল্প-গদ্য লিখতে পরামর্শ দেন। তাঁর এই পরামর্শ ও উৎসাহ আমাদের কথাসাহিত্যে একজন অদ্বিতীয় কথাকার আবুবকর সিদ্দিককে উপহার দিয়েছে নিঃসন্দেহে। একবার বাগেরহাট শহরের রাস্তায় আমি আর সিদ্দিক চাচা হাঁটছি, সাথে আরও দুয়েকজন ছিলেন। আশির দশকের শেষদিকে, আমি তখন কলেজে পড়ি। এমন সময় রাস্তা দিয়ে পালকি বহনকারী বেহারা হুনহুনাহুন শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে। আবুবকর সিদ্দিক দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখলেন সেই পরিবেশ, বেহারাদের চলার ছন্দ, উপলব্ধি করলেন হুনহুনাহুন সুরধ্বনির দ্যোতনা। একজন বলিষ্ঠ কথাকার এভাবেই আহরণ করেছেন কথাশিল্পের রসদ।
আবুবকর সিদ্দিকের সঙ্গে আমার ঘটনার ঘনঘটা কম নয়, তা একলেখায় শেষও হবার নয়। ১৯৯৮ সালে আমার প্রথম কবিতার বই বিশাকা থেকে প্রকাশিত সাবিত্রীর জানালা খোলার শেষ প্রচ্ছদে তিনি আমার সম্পর্কে দু-চার কথা লিখে দিয়ে সেই প্রথম বাংলাদেশের সাহিত্যের পঙ্ক্তিতে আমাকে জায়গা করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত তার ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ আমাকে উৎসর্গ করে সাহিত্যের বনেদি জগতে স্থান করে দিয়েছেন। এ ঋণ কখনো শুধবার নয়। আমার পিতার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচের দশকে তার সাক্ষাৎ। সেই থেকে শুরু- দিনে দিনে সেই সম্পর্ক রূপ নিয়েছে অমলিন বন্ধুত্বের। পরবর্তীতে তাদের সেই সম্পর্ক সূত্র বয়ে নিয়ে চলেছি আমি। আজ দুই বন্ধুই পরলোকে। অনেক চিঠি তিনি আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু তা ধরে রাখতে পারিনি। শুধু আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে কবি একটি দীর্ঘ চিঠি আমাকে লিখেছিলেন। মমতাভরা লেখা সে চিঠি আজও আমি সংরক্ষণ করি। সেখানে তিনি বলেছেন- ‘তুমি শুধু রসূলের পুত্র নও, আমার মানসপুত্র’। সেই বাঁধন, সেই সম্পর্কসূত্র আমৃত্যু আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে, এটাই নির্মম সত্য।