কালো বিড়াল

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তোমার কালো বিড়ালটা আমাকে দেখাতে পারবে? না। কেন? কারণ ও তো সব সময় আসে না। মাঝে মধ্যে আসে। তাও আবার সবাই যখন থাকে তখন আসে না। এসেই আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেন? জানিনা স্যার। বোকার মতো প্রশ্ন করছেন কেন? আশ্চর্য ব্যাপার স্যার জানেন, বিড়ালটা যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তখন আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না। কাউকে ডাকতেও পারি না। আশ্চর্য ব্যাপার না স্যার?

হু। এই বিড়াল দেখা মানে কি জানেন? কী? এই বিড়াল দেখার মানে হলো আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবো! আমি এক বইতেও এই কথা পড়েছি। আমার এক বান্ধবী আমার জন্মদিনে বইটা গিফট দিয়েছিল। এসব ফালতু কথা ভাববে না। তাছাড়া বিড়ালটা তোমার কল্পনা। এই বিড়াল তোমার কল্পনায় কীভাবে এলো সেটা জানতে হবে। তারপর বিড়াল কীভাবে তাড়ানো যায় সেই ব্যবস্থা করবো।

পারবেন না, স্যার। আমার বড় বোনের বেলাতেও এমনটাই হয়েছিল। অনেক বড় বড় ডাক্তারও সেসময় বিড়ালটা যাতে আর ওর মনে না আসে সেই চিকিৎসা করেছিল। কিছুতেই কিছু হয়নি। কারণ বিড়ালটা তো সত্যিই আসে! আমার ধারণা কি স্যার জানেন? বল। আমার ধারণা হলো এই বিড়ালের সাথে আমাদের পূর্ব পুরুষের কোনো না কোনো পাপের সম্পর্ক আছে। শুনেছি আমার কোনো এক পুরুষ জমিদার ছিল। খেয়ালের বশে তারা কত কিছুই করেছে! তুমি কি শুধু কালো বিড়ালই দেখ? না সাদা বা অন্য রঙের বিড়ালও দেখতে পাও? শুধু কালো বিড়াল স্যার। স্যার আমি খুব তাড়াতাড়ি মরে যাবো? আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। সায়ন্তীনি আমার ছাত্রী। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে ভর্তি হওয়ার পর এই শহরে কোথায় থাকব সেই নিয়ে ঘুম হারাম হয়ে যায় আমার মা-বাবার। তারপর দীর্ঘ টেনশন শেষে গ্রামেরই একজনের বড়লোক আত্মীয়ের খোঁজ পায় যারা আমার মতো একজনকে খুঁজছিল তার মেয়েকে পড়ানোর জন্য। থাকা খাওয়া ফ্রি! একদিন সকালে আমার ট্রাংক নিয়ে চলে এলাম সায়ন্তীনিদের বাসায়। দরজা খুললো সায়ন্তীনি। কাকে চান? আব্দুর রহমান সাহেবকে? এটা তো ওনারই বাড়ি? জ্বী। ভেতরে আসেন। আমি ভেতরে বসে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। বসার ঘরের দেয়ালে অসম্ভব সুন্দর সব পেইন্টিংস। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আব্দুর রহমান সাহেব এলেন। সায়ন্তীনিকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দিনে দুইবেলা পড়াতে হবে। সায়ন্তীনিকেও খুব সহজ মনে হলো। যাই হোক আমি সেখানে থেকে বেশ আরামেই লেখাপড়া করতে লাগলাম। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় যদি থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয় তাহলে আর কিছু দরকার হয় না। অন্তত ছাত্রজীবনে। কয়েকদিন থাকার পর জানতে পারলাম সায়ন্তীনির একটা বড় বোন ছিল। মাত্র পাঁচ বছর আগে সে কি একটা অজানা অসুখে মারা গেছে। কিন্তু অসুখটা ঠিক কী ছিল সেটা জানতে পারলাম না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ঠিক আগে সায়ন্তীনির সমস্যা দেখা গেলো। পরীক্ষার দিন সাতেক আগে ওর বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি রুমে ঢুকেই দেখলাম তিনি রিভলভিং চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছে। আমাকে হাতের ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বললো। তুমি ইদানীং সায়ন্তীনির আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখত পাচ্ছ? ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন? আচরণের যে কোনো পরিবর্তন।

বিশেষ কিছু না। তবে ইদানীং সায়ন্তীনিকে প্রায়ই অন্যমনস্ক দেখছি। মাঝেমধ্যেই একদিকে তাকিয়ে কিছু একটা গভীরভাবেভাবে। ওর কী কারও সাথে সম্পর্ক টম্পর্ক আছে বলে জান? তুমি কিছু জানলে বলতে পার নির্দি¦ধায়। ওনার মুখ থেকে এ কথা শোনার পর বেশ লজ্জা পেলাম। একবার মনে হলো উনি কোনোভাবে আমাকে সন্দেহ করছেন নাতো! যাই হোক মুখে সেই ভাব প্রকাশ করলাম না। বললাম, আমার ধারণা প্রেম-ট্রেম না। কীভাবে বুঝলে? বুঝলাম, কারণ ওই সময় মানে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকার সময় সায়ন্তীনির মুখ থাকে বিষন্ন। যদি প্রেম হতো তাহলে মুখে উজ্জ্বলতা থাকতো। গুড অবজারভেশন। এবার তুমি যাও। ঘুমিয়ে পড়ো। সেই অবস্থাতেই সায়ন্তীনি পরীক্ষা দেয়। তবে পরীক্ষার পর ওর মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। সারা দিন প্রায় একা একাই থাকে। একাই কথা বলে। সাইকিয়াটিস্ট অনেক চেষ্টা করেও কালো বিড়াল রহস্য বের করতে পারলো না। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে আমার সিট হয়ে যাওয়ায় আমি চলে আসি। আসার আগে সায়ন্তীনির কালো বিড়াল রহস্য ভেদ করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আমার ধারণা সেই রহস্য লুকিয়ে আছে সেই উপহার পাওয়া বইয়ে। এই বই পড়ার পরেই ওর বড় বোনেরও একই অবস্থা হয়েছিল। আর একটা কথা সায়ন্তীনির বড় বোন আত্মহত্যা করেছিল ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। সায়ন্তীনিও ঠিক তাই করেছিল। পত্রিকায় পড়েছি। হলে সিট পাওয়ার মাস খানেক পর একদিন পত্রিকার পাতায় সায়ন্তীনির ছবিসহ আত্মহত্যার খবরটি দেখি। দেখেই ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। আমি এখনও বিশ্বাস করি সায়ন্তীনির মৃত্যু রহস্য লুকিয়ে আছে কালো বিড়াল সম্পর্কিত বইটিতে। সায়ন্তীনি আত্মহত্যা করার পর সেই রহস্য ভেদ করতে আর ইচ্ছা হয় না।