পাঠ আলোচনা : আনোয়ারা আলম, গল্পে যিনি ছবি আঁকেন সমাজের
‘উড়ো মেঘের ছায়া’
নূরনাহার নিপা
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যার মনটা কোমলমতি ছোট্ট শিশুর মতো, পাখির ডানায় চড়ে ছুঁতে পেরেছেন ইচ্ছার আকাশ। বাংলা সাহিত্যেকে সমৃদ্ধি করে চলেছেন তার মূল্যবান সৃষ্টি। চারপাশের অগনিত মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সুদীর্ঘকাল ধরে, তিনি সমাজের আলোকিত একজন সফল নারী। গল্পকার প্রাবন্ধিক শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম। তার সৃষ্টি মানুষদের কল্যাণের পথে, সুন্দরের প্রতি, তিনি একজন সচল লেখক। সাহিত্যজগতে তার আসন পাকাপোক্ত যার কলমের ডগায় জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রকৃতি, নৈসর্গ দেশপ্রেম, মানুষ, সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করে চলেছেন কম করে হলেও পাঁচ দশক ধরে। তার নানা গুণ। নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রসারিত করেছেন বিস্বস্ত চরাচরে, যিনি পাঠকের সবটুকু ভালোবাসা জয় করে নিয়েছেন। তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি শিশুদের জন্য তার লেখনি অনবদ্য। আনোয়ারা আলম সাহিত্যে নিমগ্ন থাকেননি। তিনি নারী ক্ষমতায়ন, অধিকার, সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন।
উড়ো মেঘের ছায়া- গল্পগ্রন্থে যাপিত জীবনের বাস্তবচিত্র নিয়ে লেখাগুলো। ভাষা সহজ ও গভীর সংবেদী যেভাবে গল্পকারকে খুঁজে পেলাম গল্পগুলোর মনোজগতে। - বিত্তশালী পরিবারের আদুরে নীপা নামের মেয়েটাকে ঘিরে এক হতাশার নীল যন্ত্রণার গল্প। যেখানে মা বাবার স্বেচ্ছাচারিতা বা কলঙ্কের কথা শুনে এই বড় হয়ে ওঠার পথটা ভারি যন্ত্রণার গ্লানিময়। কম বয়সের, আবেগ, সেটা তো কোনো যুক্তিও মানতে চায় না। কেবলই মৃত্যুর ইচ্ছা জাগে এক প্রচণ্ড অস্থিরতা, যন্ত্রণা আর হাহাকার, মেয়েটি কখনো ব্যথায় কাতর, কখনো ভালোবাসার জন্য শুধু অপেক্ষা, অপেক্ষা। জীবন একটাই এবং অদ্ভুতও। নিত্য ভাঙা গড়ার খেলা এখানে, যে বাঁচে নিজেই বাঁচে, নীপার প্রতি রাশেদের এক আকাশসম ভালোবাসা। ছাত্রজীবন। ভালো লাগা, ভালোবাসা, এক সময় কাছে এসেও কাছে আসা হয় না, সম্পর্কের ফুল যে বিকশিত হওয়ার আগেই ঝরে গেল। এই বেদনার বিষে নীল থেকে নীল হচ্ছে রাশেদ বেকারত্ব জীবনে এক দুর্গতি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে জীবনের চৌপাশ, নাকি খাঁটি সোনা- কে জানে। সময়ই বলে দেবে এর উওর। একটা সময় পর তো সেই যুবক একটি যোগ্য স্থানে পৌঁছায়, তখন তার ভালোবাসার মানুষটি অনেক দূরে, বহুদূরে, রাশেদের বুকের ভেতরের খামে নীপা যে এখনো জমা হয়ে আছে অদৃশ্য এক বন্ধনে, এই নীল যন্ত্রণা থেকে রাশেদ কি সত্যই মুক্তি পাবে। গল্পকার আনোয়ারা আলম- আমাদের চৌপাশে বিত্তশালী পরিবারে অনেক অজানা কাহিনি থাকে যা চক্ষুর আড়ালে এবং একজন বেকার ছেলের জীবন কীভাবে আলোকিত হয় গল্পটিতে জীবনের কাছে ফিরে আসেন বাস্তবতার আবেগের ছোঁয়া পাঠককে বিমোহিত করেছেন সমাজের একটি অসাধারণ বাস্তবতা চিত্র। তিনি নীল যন্ত্রণা গল্পতে তুলে ধরেছেন। নীল যন্ত্রণার মতো আরো কিছু অসাধারণ গল্প যেমন- আলেয়া, নিয়তি, চাঁদের আলো, আগন্তুক, ধূসর জীবন, অনন্ত বিষাদ, ক্যান্সারের সাথে বসবাস, স্মৃতি একাত্তর, বিশিষ্ট মেহমান, অদৃশ্য কারাগার। নিয়তি- মুনিয়া উচ্চশিক্ষিত মেয়ে একজন শিক্ষক তারপর ও তার গায়ের রঙ কালো, চেহারা মায়াবী হলেও কিছুটা মোটা।
বিয়ে নিয়ে মা-বাবা পরিবারের সবার দুঃচিন্তা মেয়েটার বিয়ের যখন পাত্রের আকাল, তখন নিজেই ভাবতেন- এজন্যই কি আল্লাহ শাস্তি দিচ্ছেন? নিয়তি গল্পের মতো আরো গল্প আমি পড়েছি নিয়তি গল্পতে গল্পকার গায়ের রঙ বয়স, পরকীয়া বিষয়টা ভালোভাবে নাড়া দিয়েছেন এই দৃশ্যমান সমাজে অহরহ। পরকীয়া মানে আমরা সাধারণত অবৈধ সম্পর্কে বুঝিয়ে থাকি। পরকীয়ার কারণে সমাজ নষ্ট হয় এবং মানুষের মনুষত্ববোধ নষ্ট হয়। মুনিয়ার মতো কত মেয়ের জীবন অকালে প্রাণ দিতে হয়। সবকিছু চলছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এক আলো ছায়ার খেলা। নিজেকে প্রশ্ন করে- এটা কি দাম্পত্য জীবন? ভালোবাসাহীন, কিন্তু রুটিনমাফিক একসাথে পথচলা। বহতা জীবনের গায়ে জড়িয়ে থাকা বয়স নামের একটি সংখ্যা আহা কালো রঙ! এজন্যই কি বাবা একগাদা টাকা দিয়ে জামাই কিনলেন। একসময় স্বামীর পরকীয়া ফুফাতো বোনের সাথে মুনিয়া বুঝতে পারে তাদের সম্পর্কটা বেশ মধুর। প্রথম সন্তানের জন্মের সময়েও কাছে না! এ কেমন দাম্পত্য সম্পর্ক। মুনিয়া ছোটবেলা থেকে শান্তপ্রকৃতির। মেনে নিয়েছে সব। নবজাতকে বুকে পেয়ে ভুলে যেতে চাইল সব অপ্রাপ্তির বেদনা। এইভাবে চারটি বছর কেটে যাচ্ছে এক সময় অত্যাচারে বাবার বাড়িতে চলে আসে সেখানে ও স্বামীর মিষ্টিকথায় মন ভুলায় মেয়েদের মন এমনতেই কোমল। কুয়াকাটায় বেড়াতে যাচ্ছে মুনিয়া। বিয়ের পরে যেখানে হানিমুনও হয়নি। স্বামীর ব্যবহারে মুগ্ধ সে ভাবে মানুষের পরিবর্তন হতে পারে। না অমানুষ কখনো মানুষ হয় না। মুনিয়ার চোখের ভুল বিশ্বাস এবার বদলে যাচ্ছে স্বামীর কণ্ঠসুর।
তখনই একটা বিপদের বার্তা এসব কি হচ্ছে! মুর্তিমান যমদূতের মতো দুজন লোক। মুনিয়া নামার চেষ্টা করতেই ছুরির তীব্র আঘাত ওর শরীরে বাঁচাও বাঁচাও। কোথাও কেউ নেই। সুনিপুণ পরিকল্পনায় একটি রোমহর্ষক হত্যাক- নেপথ্য ওর স্বামী এক পাষ- খুন করে, খাদের নিচে মুনিয়ার নিস্তেজ শরীর।
স্মৃতির একাত্তর- মুক্তিযুদ্ধের কিছু চিত্রকল্প নিয়ে গল্পটি- সুদীর্ঘ নয় মাসের এক করুণগাঁথা, কত বিপদের সম্মুখীন, কত প্রিয়জনদের হারানোর কান্না দূরের কাছের আত্নীয়স্বজনদের। নারীদের উপর যে নিযার্তন, তার বর্ণনাও একের পর এক। বীরাঙ্গনা উপাধি পাওয়া নারীদের প্রতি পরিবার ও সমাজের অবহেলা, উপেক্ষার কথাও আসছে কানে। শিউরে উঠছে বারে বারে। কীভাবে নিস্কৃতি পেল লিলি। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস! নারী! নারীর শরীরই তার নিয়তি। নারীদের উপর এক ধরনের যুদ্ধ এক বোবা অনুভূতিতে অবশ হয়ে আসছে শরীরটা ও মন লিলির মতো কত নারী লড়াই করেছে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধ নারীদের অবদানের কথা, রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান, অসাধারণভাবে নিখুঁত বর্ণনা, আবেগ স্পন্দিত স্তবক, মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্বের স্টাইলের মধ্য যাপন করেছেন, ইতিহাসের মধ্যে বাঙালিদের হৃদয়ের ইতিহাস গেঁথে দিয়েছেন। গল্পকার আনোয়ার আলমের গল্পগুলো পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। তিনি প্রতিটি গল্পে সমাজের বাস্তবতা, মানুষের সম্পর্কের রসায়ন বড় রহস্যময়। গল্পকার আনোয়ারা আলমের কৃতিত্ব এখানেই।