বৃদ্ধাশ্রম

আজহার মাহমুদ

প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জন্মের ৩ বছরের মাথায় রনির মা মারা যায়। রনির বাবা আর বিয়ে করেননি। রনিকে নিয়ে জীবন পার করছে। রনিও তার মায়ের অভাবটা টের পেতো না। এর কারণ, বাবা হিসেবে আশরাফ আলী বেশ দায়িত্বশীল ছিলেন। রনির জন্য আশরাফ আলী করেন নাই এমন কিছু নাই। মা মরা ছেলের জন্য নিজের দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা কখনও ভাবেননি তিনি। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে অফিসের কলিগ সবখানেই বিয়ে নিয়ে কম চাপে পড়েননি, তবুও কারও কথা কানে নেননি।

আশরাফ আলীর জীবনে তার ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলের কথা ছাড়া আর কারও কথা তিনি ভাবেননি। দিনে দিনে রনি বড় হয়েছে। এখন সে ভার্সিটিতে পড়ে। প্রায় দেড় দশক ছেলেকে বুকের মাঝে আগলে রেখে বড় করেছেন আশরাফ আলী। রনি যেদিন নর্থ-সাউথে ভর্তি হলো সেদিন আশরাফ আলীর দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে। এটা কষ্টের নয়, সুখের জল। আশরাফ আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে কি যেন বললেন। রনি বললো, বাবা এসব কি? কার সাথে কথা বলো? আশরাফ আলী বলেন, তোর মায়ের সাথে কথা বলি। তাকে বলি, তোমার ছেলেকে ভার্সিটি পর্যন্ত এনে দিলাম। রনি বললো, এসব কথা কেন বাবা? চলো বাসায় যাই। আমার ভর্তির কাজ শেষ। এভাবে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। আশরাফ আলীও বেশ সুখি। নিজেকে এখন সফল মনে করেন তিনি। বাবা হিসেবেও সবার কাছে তিনি এখন উদাহরণ। তবে আশরাফ আলী যখন চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হয়ে পড়েন তখন আশরাফ আলীর জীবনে এক অন্যরকম অধ্যায় শুরু হয়। রনি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে মাস ছয়েকের মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাবার সাথে তার দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হয় না। সারাদিন ব্যস্ত থাকে। ভর্সিটির দুই বছরের মাথায় আশরাফ আলী চাকরি থেকে অবসরে যান। এরপর আশরাফ আলী ঘরের মধ্যেই সময় বেশি কাটান। এসময় তিনি ছেলেকে খুঁজেন। তবে ছেলে যে আস্তে আস্তে খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে গেছেন সেটা বুঝতে পেরেছেন। ছেলের জন্য খাবারের টেবিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও ছেলের দেখা পান না। অনেক সময় দেখা যায় রনি বাইরে থেকে খেয়ে আসে। আশরাফ আলী এসব দেখে মাঝে মাঝে কষ্ট পান। এরইমধ্যে রনিও বেশ কয়েকবার তার বাবাকে খাবারের জন্য অপেক্ষা না করতে বলে দিয়েছে। কিন্তু আশরাফ আলীর এটা পুরোনো অভ্যাস। দীর্ঘ দিনের এই স্বভাব তিনি সহজেই ছাড়তে পারেন না। ছেলেকে সামনে রেখে তিনিও খেতেন, ছেলেকেও খাওয়াতেন। ছেলে বড় হয়ে গেছে এটা আশরাফ আলী মানতেই পারছেন না। আশরাফ আলীর এইসব ভালোবাসা, ছেলের রুমে মাঝে মাঝে যাওয়া এসব রনির কাছে এখন বিরক্তকর লাগে। রনি এখন ব্যক্তিগত সময় চায়। বাবাকে দেয়ার মতো সময় তার নেই। আশরাফ আলী মাঝে মাঝে দেখেন, মাঝ রাতেও রনি ফোনে কার সাথে যেন চুপিচুপি কথা বলে। অথচ তার সাথে তার ছেলের দুই মিনিট কথা বলার সময় হয়ে ওঠে না। আশরাফ আলী যখন চাকরি করতো তখন তার অপরাধী অপরাধী মনে হতো। ছেলেকে সময় দিতে না পারার অনুশোচনায় তিনি সবসময় পুড়তেন। এজন্য চাকরির মেয়াদ দশ বছর থাকার পরেও তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। ছেলেকে নিয়ে একটু ভালো সময় কাটাবেন বলে। কিন্তু এখন যে আশরাফ আলী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসহায়দের একজন। খবরের কাগজ পড়া আর ছেলের সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করাটাই যেন এখন আশরাফ আলীর কাজ। সারা দিন ছটফট করতে থাকেন কবে আসবে ছেলে। একটু যদি কথা বলতে পারতেন। তবে সেই চাওয়া রোজ মাটি হয়ে যেতো। আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরেছে রনি। বাবাকে খুব আদর দিয়ে কথা বলছে। আশরাফ আলী রনির এমন সুর চেনেন। রনি কিছু চাইবে। রনি বললো, বাবা আমি একজনকে পছন্দ করি। রনির কথা শুনে আশরাফ আলী কোনো রিয়েক্ট করেননি। বললেন ঠিক আছে। ছেলের সব ইচ্ছেই আশরাফ আলী পূরণ করেছেন। এটাও তিনি বাদ রাখলেন না। রনি আর তার প্রেমিকা দুজনেই একই ডিপার্টমেন্টে পড়তেন। অনার্স শেষ কওে দুজনই চাকরি শুরু করেন। এবং ধুমধাম করে বিয়ে করেন তারা। আশরাফ আলী তার ছেলের জন্য নিজের জমানো সব সঞ্চয় ঢেলে দিলেন। বিয়ের পর রনিকে আশরাফ আলী আরও হারিয়ে ফেলেন। রনিও বাবার খোঁজ নেওয়ার সময়টুকু পায় না। মাঝে মাঝে রনির মনে হয় তার জীবনে এখন তার বাবা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার বাবার জন্য পার্সোনাল কোনো স্পেস সে পাচ্ছে না। একদিন রনি বলেই বসল, বাবা আমরা আলাদা বাসায় উঠছি। তুমি এখানে থাকো। আমরা দুজন একটু আলাদা থাকতে চাচ্ছি। আশরাফ আলী এই কথা শুনে বেশ মর্মাহত হন। তবে তিনি নিজেকে বেশ শক্ত রেখেছেন। এবং ছেলেকে উত্তর দিলেন, তোরা কেন যাবি? আমি যাবো। তোদের এই বাড়িটা দিয়ে দিলাম। রনি বললো, তুমি কই যাবা? আশরাফ আলী বলেন, আমি না হয় কোথাও ভাড়া থাকলাম। আজকাল অনেক বৃদ্ধাশ্রমও আছে। সেখানেও বেশ ভালোভাবে থাকা যায়। রনি বললো, এটা মন্দ না। তুমি যেহেতু মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করো তাহলে বৃদ্ধাশ্রমেই ভালো হয়। সেখানে তোমার বয়সের অনেকেই আছেন। বেশ ভালো সময় কাটাতে পারবা। রনির এমন সাবলির কথা শুনে, আশরাফ আলীর কলিজার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। কার জন্য জীবনের এতোটা সময় নষ্ট করেছেন তিনি সেটাই বুঝতে পারছেন না। আশরাফ আলী তবুও ছেলে কষ্ট পাবে এমন কোনো কথা বলেননি। আশরাফ আলীর একটা বৃদ্ধাশ্রম ছিলো। যেটা একটা সংগঠন চালায়। তবে জায়গা আর আশ্রমটা আশরাফ আলী নিজের টাকায় কিনেছেন। আশরাফ আলী সেখানেই থাকেন এখন। আশরাফ আলী বৃদ্ধাশ্রমে বাস করছেন প্রায় ৩৫ বছর হয়ে যাচ্ছে। ছেলের সাথে আর যোগাযোগ নেই। ছেলেও তেমন একটা খোঁজ নেননি। এমনি লোক দেখানো কয়েকবার খোঁজাখোজি করেছেন। আশরাফ আলীর বয়স এখন ৯৫ বছর। কানে একটু কম শুনলেও চোখ জোড়া বেশ ভালো এখনও। একদিন আশরাফ আলীকে একটা ছেলে এসে বললো, এই বৃদ্ধাশ্রমে কি একটা সিট পাওয়া যাবে? আশরাফ আলী বলেন, একটা না, একশ’টা পাওয়া যাবে। ছেলেটা বললো, তাহলে কাল একজনকে নিয়ে আসব। কাল থেকেই থাকবেন। আশরাফ আলী বলেন, ঠিক আছে। ছেলেটা পরেরদিন ঠিকই এক বৃদ্ধ লোককে নিয়ে আসলেন। আশরাফ আলী একটু হাঁটতে বের হয়েছেন। তাই কেয়ার টেকার আশরাফ আলীর রুমেই বৃদ্ধ লোকটাকে বসালেন। বৃদ্ধ লোকটাকে রেখেই ছেলেটা চলে গেল। বাইরে হাঁটাহাঁটি শেষে আশরাফ আলী তার রুমে প্রবেশ করে দেখছেন এক বৃদ্ধলোক বসে বসে কান্না করছেন। বয়স ৬০-৬৫ হবে। আশরাফ আলীর দিকে চোখ পড়তেই লোকটা উঠে দাঁড়ালেন। লোকটা আর কেউ নন, আশরাফ আলীর ছেলে রনি।