কামাল চৌধুরীর কবিতার রূপবৈচিত্র্য
আদ্যনাথ ঘোষ
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
‘কবি তো স্বপ্নের সমান বয়সি’- পঙ্ক্তিটিকে আরেকটু বাড়িয়ে যদি আমরা বলি; কবি স্বপ্নের চেয়েও অনেক বড়। ষাটের দশকের অন্যতম কবি কামাল চৌধুরীর ক্ষেত্রে এরূপ বাড়িয়ে বলা কোনো অত্যুক্তি হবে না। কেনো না কামাল চৌধুরীর কবিতায় মানুষের স্বপ্ন জাগরণ, বিষণ্ণতা, ক্ষোভ, জ্বালা, যন্ত্রণা, দ্রোহ, প্রেম, আনন্দ, দেশাত্ববোধ, রীরংসা, ক্ষেদোক্তি এমনকি দম্ভোক্তিও ফুটে উঠেছে। নির্মাণকলার দিক থেকে যদি কামাল চৌধুরীর কবিতার বিচার বিশ্লেষণ করি সেক্ষেত্রেও বলতে পারি কবি স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। কবি জীবনানন্দ দাশ ব্যক্ত করেছেন, ‘উপমাই কবিত্ব’। কামাল চৌধুরীর কবিতায় আমরা উপমার ব্যবহার যথাযথভাবেই দেখতে পাই। কামাল চৌধুরী কবি হিসেবে প্রেম ও সৌন্দর্যের অনুরাগী। প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক যেমন: ফুল, পাখি, নদী, চাঁদ, জ্যোৎস্না, প্রজাপতি, উদ্যান, লতাপাতা, জোছনার খেলা, জোনাকী প্রভৃতি দেখে তার কবিমন আকুলিত হন। স্মৃতির রোমান্টিকতায় ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে নিভৃতে, নিরালায়। কখনো তিনি বলে ওঠেন, ‘জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ে রাত্রির উদ্যানে’। আবার কখনো বলেন, ‘কোনোদিন যাই আকাশ অনেক দূর’। সত্যিই কবিমন অসীম দূরত্বের অবগাহনে উচ্ছ্বসিত। কোনো বাঁধন তাকে আটকাতে পারে না। কবি কিন্তু বাস্তববাদীর ছোঁয়ায় নতুনত্ব আনতে চান। পাঠক হৃদয়ের কাছে কবির মন সেই নতুনত্বের আস্বাদনের পুরোধা নাবিক হয়ে থেকে যেতে চান জ্যোৎস্নার মতো উদ্বেলিত হৃদয়ে। এ হৃদয় শুধুই মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য। মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখের কাঙাল হয়ে। কবি তার কবিতায় কখনো বলে ওঠেন- ‘এক বাজারে মাসের পকেট ফুটো/আর ক’টা দিন আশার বাণী খাই’। এমন বাস্তব চিত্র বা বাস্তবধর্মী পঙ্ক্তি অন্য কোনো কবির কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় কি না? প্রশ্ন রেখে গেলাম। আবার কামাল চৌধুরীর ‘ধান’ কবিতা থেকে আমরা এরূপ চিত্র দেখতে পাই। ধানকে তিনি সহোদর রূপে কল্পনা করেছেন। এ কবিতা থেকে আমরা সেই সময়ের অর্থনীতির বাস্তব চিত্রও ধরে নিতে পারি। আমাদের কতোদিন রুটি ও প্রেমিকা দেখে,/শুধু গন্ধ শুঁকে ফিরতে হয়েছে ঘরে/ কতোদিন, প্রিয় ধান তোমাকে দেখিনি। কামাল চৌধুরী তার কবিতায় প্রকৃতির যে অপরূপ চিত্র এঁকেছেন যা পাঠক হৃদয়কে বসন্তের মতো রূপ-রস-গন্ধ-রঙে শোভিত করে ও সকলকে আন্দোলিত করে। এতো নিখুঁতভাবে প্রকৃতির বাস্তব চিত্র কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় আমরা দেখতে পাই যা কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাড়া আর কোনো কবির কবিতায় এরূপ চিত্র খুঁজে পাই না। যেমন- তিনি বলেছেন, ‘পাতা নড়ে নিজের মর্মরে/ঝড়ো বাতাসের টানে।’ আবার- ‘রাতের বাতাসে কেঁপে পাতা নড়ে, শব্দ হয়/ডাকে পাখি, বুনো হাতি, চিতল হরিণ।’ প্রকৃতির এমন বর্ণনা, এমন আবেদন, কোন কবিই বা বলতে পারে? কবিমনের প্রকৃতির সাথে যদি সখ্যতা না থাকে তাহলে এমনভাবে এতো আকুলভাবে কোনো কবি তার কবিতায় প্রকৃতির চিত্র তুলে ধরতে পারে না। আমরা বলতে পারি, কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা উপমা নির্ভর। যে উপমাগুলো প্রকৃতির জীব ও জড় বস্তুর মিশ্রণে উদ্ভাসিত, উল্লসিত। কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় আমরা বিবেকের জয়গান দেখতে পাই।
তিনি তার কাব্যের নাম রেখেছেন- ‘এসেছি নিজের ভোরে’। কখনো তিনি কবিতায় বলে উঠেছেন- ‘আলিঙ্গন তীব্র হলে ভালোবাসা শ্বাসকষ্টে ভোগে।’ আজ মুগ্ধ বাতায়নে বসি/বুকের পাথর সব সরে যাক/যুবতীর নীল অন্তর্বাসে/কাম ও দংশন চিহ্ন মুছে গিয়ে সুন্দরের জয়ধ্বনি হোক...।’ এসব পঙ্ক্তির দিকে এক ঝলক চোখ ফেরালেই আমরা বুঝতে পারি, কবি বিবেকের তাড়নায় কতোটা জর্জরিত। কবি কামাল চৌধুরী ধলেশ্বরী নদীর কাছে বারবার ফিরে যেতে চান। তিনি ধলেশ্বরী নদীর বিচ্ছেদে বিবেকের কাছে ক্ষত-বিক্ষত। তার নিজস্ব ভাষা, মনন ও কবিতার স্বর কিছুটা হলেও আলাদা। তবে তার কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অলঙ্কার রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয় ‘চিত্ররূপময়’। কবিতায় উপমার ক্ষেত্রে কামাল চৌধুরী অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন; একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কামাল চৌধুরী কবিতা লিখেছেন। তিনি কবিতায় জাতির জনককে মানচিত্রের রোদ, রেসকোর্স মাঠ, বাঙালির জয়গান, বাংলার রাখাল রাজা, মুক্তি ও স্বাধীনতা উপাধীতে ভূষিত করেছেন। কখনো তিনি বঙ্গবন্ধুকে মহামুক্তির নায়ক, কখনো দুরন্ত প্রেরণা আবার কখনো তিনি প্রিয় কণ্ঠ, দুর্বার সাহস হিসেবে ভূষিত করেছেন। তাঁর ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’ কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো- টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো/তোমার সাহস নেবে/নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা (টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে কবিতা)। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেঈমান বিশ্বাসঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করে। আমাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে যায়। দেশকে এবং পুরো জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বা চেতনা থেকে বিচ্যুত করে। আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
কবি কামাল চৌধুরী তার শোকগাথা: পিতার জন্য কবিতায় ব্যক্ত করেছেন- ‘স্পষ্ট শুধু একটি কবর, উঁচু ঢিবি/জনকের স্বপ্নভরা দুই চোখ/এখন অন্ধকার রাত, বৃষ্টি হচ্ছে সন্তানের বুকে।’ অথবা, ‘তুমি হও আমাদের অশেষ প্রেরণা/আমি সব অতিক্রম করে/তোমার নৌকাকে নেব আকাঙ্ক্ষিত নদীর কিণারে।’ তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান স্মরণে রেখে পঙক্তিমালা বা কবিতা সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের প্রশস্তি গেয়েছেন। তিনি বীরমুক্তিযোদ্ধাদের বলেছেন- অমর কবিতা, বহমান জনধারা, নতুন সত্য, খোলা জানালা, নতুন দিন, নতুন সকাল ইত্যাদি রূপে। তিনি বীরদের কাছে অনেক আশা নিয়ে আবার বলে ওঠেন: যদি বা আবার হানাদার ফণা তোলে/প্রার্থনা করি তোমাদের পাব দেখা। বীরেরা কখনো মরে না। তারা অমর বা মৃত্যুঞ্জয়ী। তাইতো আমরা আশায় বীরদের কাছে এমন প্রত্যাশা রাখি। কবি কামাল চৌধুরী ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে যে পঙক্তিমালা চিত্রিত করেছেন তা পাঠকদের হৃদয়কে আবেগে বিমোহিত করে। তিনি ‘রক্তাক্ত পঙ্ক্তিমালা’ কবিতায় ব্যক্ত করেন- ‘শহিদ মিনারগুলো দেখো আজ বিষণ্ণ মলিন/কালো কাক এসে বসে থাকে স্মৃতির সভায়।’ কবি কামাল চৌধুরী তাঁর কবিতায় উপমা অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেছেন যেমন- দিগন্তের দীর্ঘ হাতঘড়ি, ওজন স্তরের ফুটো, বোনের আঁচল, অন্ধকার তেজস্ক্রিয়, মৃত এক নদী, অসীম রাত্রি, কোটি মানুষের ক্রোধ, ভালোবাসার শ্বাসকষ্ট, জাদুর কলম, মিছিলের সমান বয়সি, দালালের বিচিত্র মুখোশ, বিষাক্ত নিঃশ্বাস, ক্রাচের যুবক, বজ্রমুষ্ঠি আঁকা, হৃদয়ে বাহুতে শ্রমিক সাম্য, সাদা কবুতর, হেলমেটহীন ট্রাক, বিপন্ন চিৎকার, হিম নীরবতা, নিশির কুকুর, ভয়ার্ত বাছুর, চৌচির প্রান্তর, বারুদ যুদ্ধ, নিঃশব্দ জল, রক্ত বারুদ যুদ্ধের স্মৃতি, শ্রাবণ বিভোর ইত্যাদি।