পাঠ আলোচনা
জন্মান্ধ ঘোড়া : সমাজের নিখুঁত চিত্রকল্প
নুসরাত সুলতানা
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গ রাখাল দ্বিতীয় দশকের প্রতিশ্রুতিশীল কবি। নিয়মিত লিখছে লিটল ম্যাগ, জাতীয় পত্রিকা এবং ওয়েব ম্যাগে। ‘জন্মান্ধ ঘোড়া’ রাখালের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। স্বল্পভাষী এই কবি চিন্তায় বেশ পরিণত এবং লেখায়ও তার ছাপ স্পষ্টতর। কবিতা অনুবাদ করে ক্ষুধা, স্বপ্ন, হাসি, কান্না, প্রেম-অপ্রেম, রাগ- ক্ষোভ, ঘৃণা-শ্রদ্ধা সমেত সকল মানবীয় অনুভূতি। কিন্তু এই অনুভূতি প্রকাশিত হতে হয় শিল্পকে আশ্রয় করে, যা কিছুটা হলেও আড়াল বা আবডাল দাবী করে। চলুন পাঠক কবি বঙ্গ রাখালের কাব্যগ্রন্থ জন্মান্ধ ঘোড়া’র পাঠোদ্ধারে সচেষ্ট হই নিবিড় পাঠক হিসেবে। ‘কতদিন ইচ্ছে করে আছি- গণিতের কবিতা লিখে পাঠক বাড়াব। হিহি.. কিকি.. কিটকিট লিখে কবিতার নতুন আবিষ্কারক বলে- ভুষিমাল চালিয়ে দেব সাড়া নেই। সবাই এখন আবিষ্কারক, গণিত-বিষয়ক কবিতা। কামকলায় আর কতকাল’ (গণিত কবিতা, পৃষ্ঠা-৫২)। যুগে যুগে কবিতা নিয়ে চলেছে বহু স্ট্যান্টবাজি। আর তাকেই কবি বঙ্গ রাখাল তীব্র্র কটাক্ষ হানলেন উক্ত কবিতায়। ‘ফোঁস ফোঁস করে অনেক দিন বসে আছি/ কেউ একজনকে বলিনি শালটাও.../ এমন বোকা আমি ছুরি বসিয়েও বুকে/ আছি মহাসুখে... গ্রহণযোগ্যতা পাব বলে’ (বোকা, পৃষ্ঠা ৪০)
প্রকৃত পক্ষে বোকারাই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করে এসেছে আজন্ম। বোকাদের প্রচেষ্টায়ই পৃথিবী ঐশ্বর্যবান হয়েছে। সেই বোকাদের দলে যেমন বৃক্ষ, ফুল, পাখি আছে। তেমনি আছে কবি, বাউল এবং শিল্প নিবেদিত প্রাণকূল। আধুনিকতাবাদী কবিতা তার ভাষার উদ্ভাবনী ব্যবহার, ইঙ্গিতের ব্যবহার এবং কণ্ঠের স্তরবিন্যাস, কাব্যিক ঐতিহ্যকে ভেঙে নতুন, ‘আধুনিক’ ছন্দ ও বাগধারাকে কবিতায় প্রতিষ্ঠা করার আগ্রহের জন্য উল্লেখযোগ্য। লেখকরা, যুদ্ধ এবং বিপ্লবের ঐতিহাসিক আঘাতের সাথে সাথে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং নতুন বিজ্ঞানের উত্তেজনার সাথে কথোপকথনে, তাদের প্রজন্মের গভীরতম অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলতে পারে- এমন একটি কবিতা বিকশিত করার জন্য শব্দভাষা এবং ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা করার অভিজ্ঞান দাবী করে আধুনিক বা ধ্রুপদী কবিতা। চলুন পাঠক এই বৈশিষ্ট্যর আলোকে নিরীক্ষা করে দেখি ‘জন্মান্ধ ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোকে। ‘রাষ্ট্রের ঘাপটি মারা রাজনীতি- আড়ালে গণিকা পোষে/ ঘোড়া প্রতিনিয়ত দাপিয়ে ফেরে- উন্নয়ন স্বদেশে/ এ প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে/ গলি পথে অচেনা পথিক/খুঁজে ফেরে হারানো দীর্ঘশ্বাস’/(জন্মান্ধ ঘোড়া, পৃষ্ঠা-৩৪) উপরোক্ত কবিতায় কবি বঙ্গ রাখাল অত্যন্ত সফলভাবেই ইঙ্গিত, ভাব এবং ভাষায় নিখুঁত চিত্রায়ণ করেছেন সময়, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র। ‘তাড়িত- মোথিত হয়েই আমি/ স্বচ্ছ গণতন্ত্র চাই না/ চাই সঙ্গীহীন গণতান্ত্রিকতা/ যেখানে আমি স্থপতি- তোমরা নির্বাসিত’/ (নির্বাসিত, পৃষ্ঠা-২১)। এই কবিতার বিশ্লেষণ বহু অভিজ্ঞান দাবি রাখে যদিও বা। তারপর ও আমরা সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের চিত্রায়ণ দেখতে পাই এ কথা নিঃসংকোচেই বলা যায়। কবিতার শরীর এবং শব্দচয়ন : কবিতার বিনির্মাণেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। বইটিতে দুই পৃষ্ঠার কবিতা যেমন আছে তেমনি পাঁচ লাইনের কবিতাও আছে। কবিতার শব্দচয়নে বেশ চমৎকারিত্ব রয়েছে। চলুন দেখি কিছু উদাহরণ- বালিয়াড়ি মেঘ, রক্ত চন্দন, ছিমাছি খেলা ইত্যাকার দারুণ সব শব্দচয়ন গ্রন্থটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। ‘জন্মান্ধ ঘোড়া’ বহু অভিজ্ঞান লব্ধ, বহুমাত্রিক কাব্যগ্রন্থ হলেও সময় ও সমাজের নিখুঁত চিত্রকল্পও সমানভাবে গ্রন্থটিতে বিদ্যমান। কবিতা সেই দেবী যে পুজা চায় গভীর ভক্তি যোগে। যেনতেন পুজায় তিনি ধরা দেন না। আর আমাদের নিমগ্ন কবি বঙ্গ রাখাল যথোপযুক্ত সাধক। তিনি কবিতাকে ধান-দুর্বা-সাতরকম পাতা সব দিয়ে তবেই পুজা করছেন। বাংলা কবিতা বঙ্গ রাখালের হাতে একটি নতুন মাত্রা পেয়ে নতুন দিগন্তে পৌঁছাবে সেটা একজন সতীর্থ কবি এবং নিবিড় পাঠক হিসেবে একান্ত প্রত্যাশা। সেই সাথে ‘জন্মান্ধ ঘোড়া’ বহুল পঠিত হবে এমন আকাঙ্ক্ষা তো করতেই পারি অবলীলায়।
বইটির প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন এবং প্রচ্ছদ করেছেন তৌহিদ হাসান।