ঢাকা ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চিঠি পত্র

বাবা তোমাকে ভালোবাসি না

হাসান আলী
বাবা তোমাকে ভালোবাসি না

বাবা,

জন্মেই দেখেছি তোমার ভরপুর সংসার। নানান রকমের ফসল দিয়ে তোমার ছয়টি গোলাঘর ভরা থাকত। ফসল উঠামাত্র বিক্রি করার তাড়া ছিল না। বাজারে ভালো দাম পেলে বিক্রি করতে। পাড়া প্রতিবেশীরা ঠেকায় পড়ে তোমার কাছ থেকে কর্জ করতে চাইলে তুমি গোলার ধরে ফসল দিতে। তুমি যখন ফসল বিক্রি করতে চাইতে তখনকার বাজার দরে তারা ফসল মূল্য পরিশোধ করে দিত।

তোমার টাকা পয়সার হিসাব, নগদ টাকা, দলিল পত্র আমার হেফাজতে রাখতে দিয়েছিলে। তোমার কাছেই আমি লিখতে পড়তে শিখেছি। তালপাতায় আমার হাতে খড়ি। স্কুলে যাওয়া ছিল আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দের। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তুমি আমার পড়াশোনা বন্ধ করে সংসারের কাজে লাগিয়ে দিলে। বড় দুই ভাইকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছো। তারা ছুটিতে বাড়ি এলে গোলাঘর থেকে ফসল বের করে ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করে দিত। আমাদের নিষেধ করা হতো তোমাকে না জানানোর জন্য। মাঝে মধ্যে তুমি টের পেয়ে যেতে। তোমার কড়াকড়ি পাহারা ফাঁকি দিয়ে ওরা গোলা থেকে ফসল বের করে বিক্রি করে দিত। তোমার জীবিত ১২ জন ছেলেমেয়ের মধ্যে শেষের দিকের চারজনের সখ্যতা ছিল অনেক বেশি।

আমাদের চারজনের সাথে শেষ পর্যন্ত আরেকজন যুক্ত হলো মৃত বোনের মেয়ে জানু। উচ্চশিক্ষার জন্য আমার এক বছরের বড় ভাইটি চলে গেলে আমরা চারজনের ঝুটি হলাম। চারজনের মধ্যে তিনজন স্কুলে যেত আর আমি তোমার বিরাট সংসারের কিছু অংশের তদারকিতে থাকতাম। পাঠ্য বইয়ের বাইরে গল্পের বই, পুঁথি পড়ার শখ ছিল তোমার। আমি তোমার সংগ্রহে থাকা বইগুলো রাতে হারিকেনের আলোতে পড়তাম। অন্য বোনদেরকে ১১ থেকে ১২ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিলে। আমার বেলায় ১৬ পার করে বিয়ে দিলে পাকিস্তান এয়ারলাইনসে কর্মরত এক যুবকের সাথে। আমার স্বামী ছিল তোমার মেয়ে জামাইদের মধ্যে একমাত্র চাকুরে।

স্বামীর সাথে উড়োজাহাজে করাচি বিমানবন্দরে নেমে অবাক বিস্ময়ে চারদিকে তাকালাম। বার বছরের সংসার জীবনে চার সন্তানের মা হলাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৩৭ বছর বয়সি স্বামীকে হারালাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে করাচি থেকে দেশে ফিরে আসলাম। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অঝোরে কাঁদলাম। তুমি সান্ত¡নার হাত আমার পিঠে রাখলে। বাড়ি এসে মাকে জড়িয়ে অনেক কাঁদলাম। ছোট ছোট চার ছেলে মেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকা প্রায় অসম্ভব একটা বিষয় ছিল। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি একমাত্র পুত্র হারিয়ে শোকে কাতর।

তদপুরি ননদ এবং আত্মীয়স্বজনদের একটা অংশ নানান রকমের কুৎসা রটিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করে দিল। সবচেয়ে মুখরোচক প্রচারণা ছিল, আমি আমার স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছি। তুমি ঘোষণা দিলে, তোমার চার পুত্র এবং আমিসহ মোট পাঁচ পুত্র। এ রকম একটা ঘোষণায় ভাই ও ভাতৃবধূরা নাখোশ হয়ে পড়ল। পরিস্থিতি সামাল দিতে তোমার পরিত্যক্ত ১০টি বাড়ির মধ্যে একটিতে আমাকে পুনর্বাসনের কথা বললে। সেই সিদ্ধান্ত থেকে কেন তুমি সরে গেলে তা আজও আমার অজানা থেকে গেল! আমি তোমার সংসারে গলার কাঁটা হয়ে গেলাম। তুমি আমাকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন নিয়ে বৈঠক বসালে। তুমি প্রস্তাব দিলে, আমাকে বিয়ে দিবে, আমার ছেলে মেয়েদের ভাইদের সংসারে ভাগ করে দিবে অথবা এতিমখানায় পাঠিয়ে দিবে। আমার স্বজনরা এটিকে উত্তম প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনা করলো। আমি এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করলে তুমি আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললে। অনেক লড়াই সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় শ্বশুরের ভিটায় উঠার সুযোগ আসে। চুয়াত্তরের বন্যার সময়ে নৌকায় করে আমাকে চার সন্তানসহ শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিলে। আমাদের স্বাগত জানাতে কিংবা গ্রহণ করতে কেউ আসেনি। নৌকায় সারা পথ আমি তোমার মুখের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। পুরোটা পথ-ই তুমি নির্বাক ছিলে। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে বিসর্জন দিতে নিয়ে চলছো।

আমাকে রেখে আসার সময় তোমাকে বললাম, বাবা আমাকে দোয়া করো যেন ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারি। তুমি আস্তে করে ফি আমানিল্লাহ্ বলে চলে গেলে। আমি আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ছোট মেয়েটা কোল ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিল। সুযোগ খোঁজার লোক আর পাড়া প্রতিবেশীর যন্ত্রণা আমাকে কাহিল করে ফেলেছিল। জীবনে ঝড় তুফান মোকাবিলা করতে করতে আমার সাহস বেড়ে গিয়েছিল। ভয় জয় করার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। আর তুমি ভেবেছিলে আমি পরাস্ত হয়ে তোমার পায়ে কাছে এসে বসবো। তুমি বলতে, পুরুষ রাগ করলে হয় বাদশা আর নারী রাগ করলে হয় বেশ্যা। কি কদর্যই না ছিল তোমার মতো পুরুষ মানুষের মন! তুমি বেঁচে থাকতেই আমার বড় ছেলে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তুমি আমাকে বললে, তোর ছেলে বিএ পাস করলে নাতিন বিয়ে দেব। এটা ছিল আমার ছেলের কলেজে পড়া নিয়ে তোমার নিষ্ঠুর কৌতুক! তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে তোমার চার ছেলে মন্ত্রণা দিয়ে সব সহায় সম্পদ নিজেদের নামে লিখে নিল। চার ছেলের সুখের জন্য স্ত্রী ও পাঁচ মেয়েকে বঞ্চিত করতে তোমার বুক একটু ও কাঁপল না। এই তুমি সকল সময়ে ন্যায় অন্যায় বোধ, মনুষ্যত্ব নিয়ে আম জনতাকে নসিহত করতে। আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার এটা নিশ্চিত মনে করে তোমার মৃত্যু হলো। যাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল ভেবে তুমি পুলকিত ছিলে বেঁচে থাকলে এখন তাদের দুরবস্থা দেখতে পেতে। একমাত্র আমার মা ছিলেন পিঠে হাত রেখে সাহস জোগানো এক অসহায় নারী। মা তবু তার বাপের বাড়ি থেকে কিছু জমি জমা পেয়েছিলেন। সেই সম্পদ নানান কৌশলে তোমার নামে নিয়েছো। মা শেষ পর্যন্ত অবহেলা, চিকিৎসাসেবা যত্ন না পেয়েই মরে গেল। অথচ তুমি মৃত্যুর আগে চার ছেলে এবং পুত্র বধুদের অসিয়ত করেছিলে মার চিকিৎসা সেবা যত্নের যেন ঘাটতি না হয়। এসব অসিয়ত-নসিহত যে কোন কাজে আসে না তা তুমি ও বুঝতে।

আজ আমার ছেলে মেয়েরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আমার নাতি-নাতনিদের বিয়ে হয়েছে তাদের ছেলে মেয়ে দেখার সৌভাগ্য ও আমার হয়েছে। আমার ছেলেরা যখন তাদের মেয়েদের আদর করে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তখন আমার বুক ভেঙে কান্না আসে।

আমার মন বলে, তুমি কেন আমার ছেলেগুলোর মতো হলো না! আমার ছেলেরা শুধু তাদের মেয়েদেরই আদর করে না নাতিনাতনিদের জন্য অনেক বেশি ব্যাকুল। ৮০ বছর বয়সে উপনীত হয়ে আজো তোমাকে ভালো বাসতে পারছি না। পারছি না তোমাকে ক্ষমা করতে। অনেক সহায় সম্পদ অর্জন করেছিলে নিজের যোগ্যতায় কিন্তু ভোগ তো তেমন কিছু করতে পারলে না। দেশে বিদেশে ঘুরতে গেলে না, হজ্জ পর্যন্ত করলে না। তুমি শুধু ছেলেদের অনাগত ভবিষ্যৎ কন্টক মুক্ত করতে নিবেদিত ছিলে। কি লাভ হয়েছে নিজকে বঞ্চিত করে, স্ত্রী কন্যাদের ঠকিয়ে! মানুষ যখন বাবা দিবসে বলে, পৃথিবীতে কিছু পুরুষ খারাপ আছে কিন্তু একটি ও খারাপ বাবা নেই। আমার তখন হাসি পায়, প্রতিবাদ করে বলতে ইচ্ছে করে বাবা খারাপ ও হয়।

সন্তান লালন পালনে ন্যায় বোধ দ্বারা পরিচালিত না হলে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। মেয়েরা বাবাকে ভালোবাসে বলে যে গল্প হর হামেশাই শুনতে পাই তা অর্ধেক সত্য। আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে রাগিয়ে দেবার জন্য তোমার নামে বানিয়ে মিথ্যা গল্প বলে আমি রেগে আগুন হয়ে যাই। তোমার পক্ষ নিয়ে জানিয়ে দিই- আমার বাবা অনেক বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন। অথচ এই কথাটি আমি মন থেকে বিশ্বাস করি না। ভালো থেকো বাবা।

ইতি

তোমার মেয়ে

আমিনা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত