ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সে আর ফিরেনি

জোবায়ের রাজু
সে আর ফিরেনি

সেকান্দর আলীর শারীরিক অবস্থা এখন বিপদমুক্ত। অপারেশনে যতটুকু জটিলতা দেখা দেওয়ার কথা ছিল, ততটুকু সমস্যা হয়নি। তবে হাসপাতালে থাকতে হবে আরো সপ্তাহখানেক, ডাক্তার রাসেল এমনটি জানিয়ে গেলেন। ৩০৭ নাম্বার কেবিনে আসার পর মোমেনা বেগম স্বামীর সেবা যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেননি। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে স্বামীর সেবায় বেশ দক্ষ ভূমিকা পালন করলেন। দিনরাত হাসপাতালে নিরন্তর খেটেছেন। অথচ হাসপাতালকে চিরকাল ভয় মোমেনা বেগমের। হাসপাতালের গন্ধ তার কখনো সহ্য হতো না। অথচ স্বামীর অসুস্থতার পর নিজের সব অনুভূতিকে তোয়াক্কা না করে তিনি হাসপাতালে আছেন গত কয়েকদিন ধরে।

হাঁটুর টিউমার অপারেশন হয়েছে সেকান্দর আলীর। কেবিনে আসার পর বেশ স্বস্তিবোধ হচ্ছে। স্বামীর অবস্থার উন্নতি দেখে ভালো লাগছে মোমেনা বেগমেরা। একমাত্র মেয়ে নাসরিন ফোন করলে বারবার বাবার খবর রাখছে। নাসরিন স্বামী সন্তান নিয়ে শহরে থাকে। সেকান্দর আলীর স্ত্রী আর এই মেয়ে ছাড়া আপনজন বলতে আর কেহ নেই। স্বার্থের কারণে কাছের অনেক মানুষ একে একে দূরে সরে পর হয়েছে। সেসব দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা ভাবতে চাননা সেকান্দর আলী।

স্ত্রী মোমেনা বেগম ছাড়াও হাসপাতালে আরো একজন সেকান্দর আলীকে সেবা দিচ্ছে। সে সুলতানা। সুলতানার পরিচয় হচ্ছে সে হাসপাতালের একজন সুযোগ্য নার্স। রোগীদের আরোগ্য লাভে সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। কোন রোগীর কখন কি লাগবে, এসব ব্যাপারে সে বেশ বিচক্ষণ। তবে সুলতানা খেয়াল করেছে সে যখন ৩০৭ নাম্বার কেবিনে সেকান্দর আলীর খোঁজখবর নিতে আসে, সেকান্দর আলী দূর থেকে তাকে ঠাওর করতে না পেরে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চান, ‘কে, দুলাল নাকি?’ পরে যখন জানেন দুলাল নামের কেউ আসেনি, তিনি নরম গলায় বলেন, ‘ও আচ্ছা!’

ব্যাপারটি দু একবার ঘটেছে, এমন নয়, যতবারই সে এখানে সেকান্দর আলীর অবস্থার উন্নতি অবনতি পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে, ততবারই লক্ষ্য করেছে বেশ আগ্রহী হয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন- কে, দুলাল নাকি! সুলতানা ভাবে, দুলাল নামে হয়তো তার কেউ না কেউ আসার কথা এখানে।

২.হাসপাতাল থেকে আগামীকাল রিলিজ দেওয়া হবে সেকান্দর আলীকে। সুলতানা সন্ধ্যা ছয়টায় শেষবারের মতো কেবিনে এসেছে সেকান্দার আলীর প্রেসার মাপতে। কেবিনে ঢুকার আভাস পেয়ে সেকান্দর আলী যথারীতি বললেন, ‘কে এসেছে? দুলাল?’ সুলতানা বলল, ‘প্রতিবার দুলাল এসেছে মনে হয় কেন আপনার? দুলাল কে? কই একদিনও তো সে এখানে আসেনি।’ সেকান্দর আলী মলিন কণ্ঠে বললেন, ‘সে আর কোনোদিন আসবেও না।’- আচ্ছা দুলাল কে, বলেন তো।- আমার ছেলে। - কি করে সে?

- ঘুমায়।- মানে?- কবরে ঘুমায়।- ওহ সরি। আমি জানতাম না আপনার ছেলে মারা গেছে।- মারা যায়নি। শহীদ হয়েছে।- শহীদ হয়েছে?- হ্যাঁ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে আমার দুলাল শহীদ হয়েছে।- সে কি! কি বলছেন? সেকান্দর আলী আর কিছু বলতে পারেন না। তার চোখ ছলছল করে। পুরো ঘটনা সুলতানাকে বিস্তারিত জানিয়ে মোমেনা বেগম বললেন, ‘আমাদের প্রথম সন্তান ছিল দুলাল। ভাষা আন্দোলনে সে প্রাণ দিয়েছে। ১৯৫২ সাল তখন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তখন তরুণেরা রুখে দাঁড়ায়। রাজপথে মিছিলে নেমে পড়ে তারা। সেই মিছিলে গুলি চালানো হয়। লুটিয়ে পড়ে অসংখ্য তরুণ। রফিক, সফিক, বরকতদের লাশের ভিড়ে পড়ে থাকে আমাদের দুলালের ছিন্নভিন্ন লাশ।’

সুলতানা চুপ হয়ে যায়। নিস্তেজ গলায় বলে, ‘তাহলে ভাষাসৈনিক রফিক সফিকদের নামের ইতিহাসে দুলালের নাম নেই কেন?’ মোমেনা বেগম কোনো কথা বলতে পারেন না। সেকান্দর আলী বললেন, ‘ভাষাসৈনিকদের নামের ইতিহাসে এমন অসংখ্য দুলাল আছে, যাদের নাম আলোচনায় আসেনি। ঘুরেফিরে রফিক সফিক সালাম বরকতের নামই উচ্চারিত হয় তোমাদের মুখে মুখে। কিন্তু আমার দুলালের নাম রয়ে গেছে তোমাদের অগোচরে।

সুলতানা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে কেবিন থেকে চলে যায়। ফিরে আসে আধা ঘন্টা পর। তবে একটা সুখবর নিয়ে এসেছে। সেকান্দর আলী ভাষা সৈনিক দুলালের বাবা, এ কথা সে জানিয়ে দেয় হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সবাইকে। সব ডাক্তার, নার্সেরা ৩০৭ নাম্বার কেবিনে ছুটে আসেন সেকান্দর আলীকে বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাতে।

এমন একটি পরিস্থিতিন সূচনা হবে, ভাবতেই পারেননি সেকান্দর আলী ও মোমেনা বেগম। এরই মধ্যে সুলতানার ফোনে কার যেন কল আসে।

সে বারান্দায় চলে গেল কথা বলতে। দু মিনিট পর ফিরে এসে জানায়, ‘আমাদের হাসপাতালের প্রধান মালিক জরুরি কাজে কক্সবাজারে গেছেন। তাকে আপনাদের ছেলে দুলালের গল্প বলেছি। তিনি এখন ফোন করে জানিয়েছেন আপনাদের কাছ থেকে চিকিৎসার কোনো খরচ যেন না রাখা হয়! কারণ আপনারা একজন ভাষাসৈনিকের পরিবার।’

সুলতানার কথা শুনে সেকান্দর আলী বাকরুদ্ধ হলেন। হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের এই উদারতায় শুধু সেকান্দর আলীই নয়, মোমেনা বেগমও মুগ্ধ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত