ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কেন লিখি : এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক কতটা সরল রৈখিক?

নুসরাত সুলতানা
কেন লিখি : এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক কতটা সরল রৈখিক?

মোটা দাগে একজন কবি বা লেখক লিখে রেখে যান সময়ের স্মারক। অথবা লিখেন প্রজন্ম, দেশ, মা, তার নিজ ভূগোলের বা রাজনৈতিক মানচিত্রের জন্য যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন তাদের রক্তের দাগ। কিন্তু তারপরও কী একজন লেখক সবার আগে নিজের জন্যই লিখেন না? যেমন নজরুল বলেছেন- বনের পাখির মতো গান গাওয়াই আমার স্বভাব। কেউ শুনিলেও গাহি, না শুনিলেও গাহি। আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন- আমি এসেছিলাম প্রেম পেতে এবং প্রেম দিতে। সেই প্রেম পেলাম না বলেই- প্রেমহীন এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। তার মানে এই দাঁড়ায় যে, একজন লেখক প্রকৃত অর্থে নিজেকেই লিখেন। লিখেন নিজের বেদনার অবমুক্তি, স্বপ্ন, আশা, হতাশা, প্রেম, বিচ্ছেদ সব। একথার প্রমাণ আমরা পাই- যখন দেখি- নজরুলের ছেলে বুলবুল মারা গেলে নজরুল লিখলেন- ঘুমিয়ে গ্যাছে শান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি। আবার রবীন্দ্রনাথ যখন বিলেতে যাবেন ব্যারিস্টারি পড়তে। নতুন বৌঠান যিনি তার কবিতার প্রথম পাঠক, সকল প্রেরণার উৎস। তাকে ছেড়ে যেতে যখন ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন তিনি লিখলেন- তোমারেই করিয়াছি জীবনেরও ধ্রুবতারা। আবার বিশ্বকবির ছেলে শমীর প্রয়াণে কবি লিখলেন- আমারে যে জাগতে হবে/কী জানি সে আসবে কবে/আমারে যে জাগতে হবে/কী জানি সে আসবে কবে/যদি আমায়/যদি আমায় পড়ে তাহার মনে/যাব না এই মাতাল সমীরণে/আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে/আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।

মানে সবাই বনে গেছে যাক। কবি জেগে থাকবেন। যদি সে আসে! কিন্তু একজন লেখকের বেদনা ক্রমশ ব্যপ্ত হতে থাকে তার পরিবেশ, প্রতিবেশ, সমাজ দেশ এবং সর্বোপরি বিশ্বের সবার জন্য। প্রন্মের শিক্ষা ব্যবস্থা, শ্রমিকের মজুরি প্রতিদিনকার দ্রব্যমূল্য, শিউলিফুলের টুপটাপ ঝরে যাওয়া সবই লেখকের অন্তরকে কাঁদায়। একজন লেখক ব্রান্ড পারফিউমের চাইতে যেমন ভালোবাসেন শ্রমিকের ঘাম তেমনি যে কোনো চমৎকার নকশিকাঁথার চাইতে ভালোবাসেন মায়ের আঁচল। কবিতা একজন কবির বেঁচে থাকার ওষুধ। যেমন ক্যান্সার রোগী থেরাপি ছাড়া বাঁচবে না। তেমনি একজন কবি কবিতা লেখা ছাড়া সুস্থ থাকতে পারবে না। কবিতা আমার কাছে আত্মার আহাজারি, হৃদয়ের হর্ষ। কবিতাকে টর্চ করে আলো ফেলতে চাই সভ্যতার সকল গভীর অন্ধকারে। তারপর ও পেছনে ফিরে তাকাই ঠিক কীভাবে, কবে লিখতে শুরু করেছিলাম কবিতা? স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে- চতুর্থ শ্রেণির কথা। ছোট বেলায় লবন হলুদ দিয়ে জ্বাল করা ইলিশ আর পান্তা খেতে ভালোবাসতাম। একদিন আম্মু পান্তা খেতে দিয়েছিলেন। অই পান্তায় আমি আরও পানি চাই কিন্তু আম্মু দেবে না। আমি মুখে মুখে বললামণ্ড ‘খুকু চায় পিয়া খেতে। মা তা দেয় না। খুকু কাঁদে ঘরে বসে। মা মেরেধরে কিছু থোয় না।’ আম্মু কিন্তু আমাকে মারেনি। আমি লিখলামণ্ড মা মেরেধরে কিছু থোয় না। আজও ভাবি আর অবাক হই- পুকুরকে সমুদ্র বানানোর অভ্যাস কী তবে আমার মজ্জাগত ছিল? একসমুদ্র প্রেমে থেকেও কবি/লেখক ভোগেন অপ্রেমে। যাক সেকথা। প্রচুর কবিতা পড়েছি, গল্প-উপন্যাস সবই পড়েছি আশৈশব। কিন্তু হিমু, মিসির আলিরা কিংবা কোনো জনপ্রিয় লেখক আমাকে টানেনি একেবারে। বয়স যখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই তখন মা’কে হারালাম। বাংলাদেশের ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় মা খুব ভুগে ইন্ডিয়ার ব্যাঙ্গালোরে মারা গেলেন।

মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত লন্ডভন্ড আমি কখন কলম হাতে তুলে নিলাম জানি না। জীবনের প্রথম কবিতা মাকে নিয়ে। লিখলামণ্ড না হয় বলিনি ভালোবাসি/জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিইনি/বলিনি দিগন্ত বিস্তৃত নীলাভ আকাশের বুক চিড়ে/উড়ে যাওয়া ধবল বকের চেয়েও তুমি সুন্দর।/তাই বলে এভাবে কেউ শোধ নেয়!/এই অবেলায় কেউ দিগন্তে মিশে যায়! সেই থেকে লিখছি কবিতা। প্রকৃত পক্ষে লিখছি প্রজন্মের প্রতি দায় থেকে সময়ের স্মারক, শ্রমিকের, ঘাম, মায়ের আঁচল বেশ্যা পুঁজিবাদ আর ড্রাকুলা বিশ্বায়নের হালহকিকত। কবিতা লিখতে শুরু করার এক বছরের মাথায় গল্প লিখতে শুরু করি।

যাকিছু লিখতে চাই তার সবকিছু কবিতায় লিখতে পারি না। সমাজ, সম্পর্ক, মানুষের মনস্তত্ব আর সময়ের বিস্তারিত চিত্রকল্প কথাসাহিত্য ছাড়া তুলে ধরা যায় না। তাছাড়া গল্পে বুনে দেয়া যায়- বাস্তবতা, সমাজ বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা এবং যাদুবাস্তবতার দারুণ সব উপাখ্যান। গল্প, কবিতা, উপন্যাসের পরেও কিছু কথা অনিবার্য হয়ে ওঠে। যা প্রবন্ধ ছাড়া বলা যায় না।

সেখানে তথ্য, তত্ত্ব আর পর্যবেক্ষণ মুখ্যত আসে। তাই কিছু প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করি। প্রকৃত পক্ষে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ যা কিছুই লেখা হোক না কেন- একজন লেখক লিখেন- উদীয়মান সূর্যের কথা, গর্ভজাত ফসলের কথা, স্বপ্নের চারাগাছ বপনের কথা এবং সাম্যবাদী শোষণহীন বিশ্বের কথা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত