ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কখনো বিবর্তন

সুলেখা আক্তার শান্তা
কখনো বিবর্তন

উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। প্রত্যন্ত গ্রাম নয়নদিঘি যুদ্ধের বিভীষিকায় আক্রান্ত হয়েছিল। খবর আসে পাকিস্তানি মিলিটারি হামলা করবে গ্রামে। হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে লুটপাট চালায় অগ্নিসংযোগ করে। ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জনপদে। মানুষ ছুটতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কোথায় যাবে, দেশের সীমানার ভিতরে সর্বত্র বিভীষিকাময় পরিবেশ। যে যেভাবে পারে ইন্ডিয়ায় পালাতে থাকে। ইমান আলী গ্রামের উঠতি কৃষক। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বড় দুশ্চিন্তা মেয়ে মিনুকে নিয়ে। মেয়েটা পঙ্গু হাঁটতে পারে না। তাদের গ্রাম থেকে ইন্ডিয়ার বর্ডার বহুদূর। গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ। সদর রাস্তায় সর্বত্র আর্মি রাজাকার চেকিং। তারা পরিচয়পত্র দেখতে চায়। দেখাতে না পারলে হয় গ্রেফতার না হয় গুলি। মানুষ পালায় বিকল্প পথে, মাঠ ঘাট বন বাঁদর ভেঙে। এই অবস্থায় মিনুকে বহন করে নিয়ে যাওয়া কঠিন ব্যাপার। মিনুর কী হবে তা নিয়ে হৃদয়বিদারক ব্যাকুলতা পিতা-মাতার। কেউ কোনো পথ খুঁজে পায় না। কোনো উপায় না দেখে মিনুর মা বলে, মিনুর জন্য সবার জীবন যাবে? মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিতে ইমান আলীর বুক ভেঙে যায়। পাশের বাড়ির এক বুড়িকে মিনুর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে পরিবারের সবাই ইন্ডিয়া যাত্রা করে। গ্রামের পাশে খ্রিষ্টান পাড়া। মিলন গোমেজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর সৈনিক ছিল। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ ছিল আর্মি মেডিকেল কোরে। এখন গ্রামে বাস করে। নিজের বলতে কেউ নাই। ব্রিটিশ সরকারের অবসর ভাতা আর কিছু জমিজমা তাই দিয়ে চলে যায় তার। অসুখ-বিসুখে গ্রামের মানুষের দুর্দশা তাকে পীড়িত করে। বাড়ির বৈঠকখানায় সে একটা ডিসপেন্সারি করে। সেখানে গ্রামের মানুষ কিছুটা চিকিৎসাসেবা পায়। সবাই এটাকে খ্রিষ্টান হাসপাতাল বলে। মাঝেমধ্যে বিদেশি সাহায্য সংস্থার লোকজন তার জনসেবা মূলক কাজ কর্ম দেখতে আসে। সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুবাদে গ্রামের লোকজন মিলন গোমেজকে কমান্ডার বলে ডাকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে শুরু হয় পরিবার পরিত্যক্তা মিনুর টিকে থাকার দীর্ঘ যুদ্ধ। মিনু জানতে পারে খ্রিষ্টান হাসপাতালের কথা। একদিন নয়নদিঘি গ্রামে মিলিটারি আসবে বলে খবর পাওয়া যায়। গ্রাম ছেড়ে অবশিষ্টরা পালাতে থাকে। নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় অনেক কষ্টে মিনু নিজেকে টেনে হিঁচড়ে খ্রিষ্টান হাসপাতালে নিয়ে আসে। রাজাকারের দল গ্রামে ঢুকে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। যাকে সামনে পায় তাকেই হত্যা করে। এক রাজাকার মিনুকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে খ্রিষ্টান হাসপাতালের বৃদ্ধ মিলন গোমেজ তাকে রক্ষা করে। কিন্তু মিলন গোমেজের শেষ রক্ষা হয় না। তার পরিচয় কমান্ডার এবং সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে জানতে পেরে গুলি করে হত্যা করা হয় মিলন গোমেজকে।

বিদেশি সাহায্য সংস্থার লোকজন ঘটনা জানতে পেরে অনেকেই ছুটে আসে। একটি জার্মান দম্পতি আসে খ্রিষ্টান হাসপাতালে। মিনুর পঙ্গুত্ব দেখে তারা সাহায্য করতে চায়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং চিকিৎসা পেলে মিনু সাবলম্বী জীবন কাটাতে পারবে। জার্মান দম্পতি মিনুকে সঙ্গে নিয়ে যায় বিদেশে।

স্বাধীনতার পর সবাই গ্রামে ফিরতে থাকে। ইমান আলী বাড়িতে ফিরে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। প্রভাবশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে পুরনো বিরোধ বিরাট আকার ধারণ করে। ইমান আলীকে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজতে থাকে তারা। রাজাকার, শান্তি কমিটি লোক বলে অপবাদ দিয়ে ঘরবাড়ি সহায় সম্পদ দখল করে গ্রামছাড়া করে। শহরে এসে সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে পরে ইমান আলীর পরিবার। একটি বিদেশি সাহায্য সংস্থার সহায়তায় মিনু অসহায়দের স্বাবলম্বী করতে গড়ে তোলে বিরাট প্রতিষ্ঠান। সেখানে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজের জন্য লোকবল প্রয়োজন হয়। ইমান আলী কাজের সন্ধানে সেখানে যায়। মিনুর সঙ্গে দেখা হয় মা বাবার। নিয়তির নির্মম পরিহাস। বোঝা মনে করে মিনুকে একা রেখে পালিয়ে ছিল তারা। এখন মিনু স্বাবলম্বী। শুধু নিজের নয় সবার বোঝা বহন করার সামর্থ্য হয়েছে তার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত