বেলা ফুরিয়ে যায়
জোবায়ের রাজু
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যান্ত্রিক এই শহরের মিরপুরে যে পাঁচতলা বাড়িটি, আশরাফ এই বাড়ির নতুন দারোয়ান। বয়স তার ৪০ পেরিয়ে। দারোয়ানের পেশায় সে এই মাসের শুরুর দিকে এসেছে। এ বাড়ির মালিক নাসিম খান যথেষ্ট অমায়িক মানুষ। দারোয়ান বলে আশরাফকে কখনো খাটো করে দেখেন না। দুর্ব্যবহার করার তো প্রশ্নই আসে না। এ বাড়ির আগের দারোয়ানদের তিনি কতটুকু মর্যাদা দিতেন আশরাফ জানে না, তবে তাকে যে নাসিম খান অসম্ভব পছন্দ করেন, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। অথচ সারা জীবন আশরাফ জেনে এসেছে বড় লোকেরা নাকি হৃদয়হীন। মানুষকে তারা মানুষ বলে গণ্য করে না। কিন্তু নাসিম খানের মানবিকতায় এসবের কোনো আভাস দেখা যায় না। তবে আশরাফ শুনেছে নাসিম খানের জীবনের বড় একটি ধাক্কার কথা। তার স্ত্রী মিসেস শাহানা মরণব্যাধি ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেয়েছেন। যদিও উন্নত চিকিৎসা না হলে এটি সম্ভব হতো না। প্রায় অর্ধকোটি টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুরে টানা আট মাস চিকিৎসার পর পুরোপুরি এখন শঙ্কামুক্ত মিসেস শাহানা। আজ তিনি সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরবেন বড় ছেলে ইমরানের সঙ্গে। নাসিম খানকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যাচ্ছে।
সন্ধ্যায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছেন মিসেস শাহানা। মহা আয়োজনে তাকে বাসায় বরণ করে নেওয়া হয়েছে। খুব আন্তরিকতা দেখিয়ে ছুটে এসেছে পাঁচতলা ভবনের সব ভাড়াটিয়ারা। সবার এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে আশরাফ ধারণা করেছে মিসেস শাহানাও হয়তো নাসিম খানের মতো নৈতিক মানুষ। তা না হলে ভাড়াটিয়া নামক এসব মানুষের ভালোবাসা অর্জন করবেন কেন! ভালোবাসা জিনিসটা তো আজকাল মানুষের তরফ থেকে পাওয়াটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আশরাফের শখ মিসেস শাহানাকে একবার দেখবে। মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা মানুষটা দেখতে না জানি কেমন! কিন্তু বেশি দিন আর আশরাফকে অপেক্ষা করতে হয়নি। সাত দিন পর সকালে যখন টবের গাছে পানি ঢালছিল আশরাফ, তখনই নিচে নেমে এলেন মিসেস শাহানা। ভদ্রমহিলা এ বয়সেও যথেষ্ট সুন্দরী। বয়স বেড়েছে বটে, কিন্তু শারীরিক গড়নে ও চাহনিতে এখনো অভাবনীয় রূপসী। তবে এই রূপসীকে কোথাও যেন আগেও দেখেছে আশরাফ! কোথায় দেখেছে মনে পড়ছে না! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল নিজ গ্রামের কথা। হ্যাঁ এই সেই মানুষ, যে আশরাফদের হাইস্কুলের স্টুডেন্ট ছিলেন। প্রতিবছর স্কুলে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সেখানে ইনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন। সেই সুর, সেই কণ্ঠ, সেই গায়কী এখনো মনে আছে আশরাফের। যদিও সে তখন অনেক ছোট ছিল। যতদূর মনে পড়ে, এই ম্যাডাম তার বড় বোন রেশমার সাথে একই শ্রেণিতে পড়ত। কিন্তু এই ম্যাম এখানে কেন! ভাবে আশরাফ। - তুমি এমন করে কি দেখছো আমাকে? ভাবছো মৃত্যুর অতি কাছ থেকে ফিরে এসেছি কি করে, তাই না? - ইয়ে মানে... - তুমি আমাদের এখানে নতুন জয়েন করেছ, তাই তো? আমি নাসিমের কাছে সব জেনেছি। সে খুব তারিফ করেছে তোমার। - আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি কি এক সময় গান গাইতেন?
- সে কি! তুমি জানো কীভাবে! গান তো এখন আর করি না। অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। - আপনি কি নোয়াখালীর আমিশাপাড়ার হাইস্কুলে কখনো গান গেয়েছেন? - হ্যাঁ হ্যাঁ। কে তুমি! বাবার চাকরির সুবাদে আমার অনেক জায়গায় থাকা হয়েছে। তবে নোয়াখালীতে বেশি থেকেছি। তুমি কে?
- আমি সেই আমিশাপাড়ার মানুষ। ছোটবেলায় আপনি যে স্কুলের সাংস্কৃতিক আয়োজনে গান গাইতেন, আমি দেখেছি। খুব সুন্দর ছিল আপনার গলা। - বলো কি! তুমি আমিশাপাড়ার মানুষ? আমার জীবনের সবথেকে সুন্দর জায়গা ছিল তোমাদের ওই ভূমি। ওখানে আমার এক বান্ধবী ছিল রেশমা নামে। চিনবে না হয়তো। - জি ম্যাম। আমি রেশমার ছোট ভাই। - ওমা! কাকতালীয়ভাবে এত মিলে যাচ্ছে কেন তোমার সঙ্গে? রেশমা কোথায় এখন? আশরাফ চুপ হয়ে গেল। মিসেস শাহানাকে সে কীভাবে বলবে রেশমা বুবু খুন হয়েছেন। যৌতুকের দায়ে ওর নরপিশাচ স্বামী ওকে কুপিয়ে খুন করেছে।
আশরাফকে চুপ থাকতে দেখে মিসেজ শাহানা বললেন, ‘প্লিজ তুমি এখনই একটা কল দাও রেশমাকে। আমি সবসময় ওকে স্মরণ করি। ওর একজোড়া রূপার নূপুর ছিল আমার কাছে। হুট করে আমরা নোয়াখালী ছেড়ে এসেছি যে সেই নূপুর রেশমাকে দিতে ভুলে গেছি। তুমি ওকে এখনই কল দাও। আমি ওকে দেখব।’ আশরাফ এই মুহূর্তে তার কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছে না। সাদা কাপড়ে ডাকা খুন হওয়া বোনের সেই মৃত বীভৎস চেহারাটা যতবার ভাবে, ততবার তার গলা ফাটানো চিৎকার আসে।