আশা না ফুরিলো

জোবায়ের রাজু

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সিএনজির ডান পাশে বসেছে আফসার। সে যাচ্ছে জেলা সদরে। আজকের পহেলা বৈশাখে প্রতিবারের মতো এবারও সাংস্কৃতিক আয়োজনে গান গাইতে হবে তাকে। দশ দিন আগে এই প্রস্তাব এসেছে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এই দশ দিন আগ থেকে গলা চর্চা আর গানের প্র্যাকটিস করে নিয়েছে আফসার। পেশাদার কোনো শিল্পী নয় সে। এমনকি গানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই। শখের বশে গান করে। কিন্তু গলা অপূর্ব। সংগীতশিল্পীদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। খালি গলায় গান রেকর্ড করে ফেসবুকে ছাড়ে। মুহূর্তেই সেই গান বহু মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। একদিন ডাক আসে জেলা সদরের পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক আয়োজন থেকে। কর্তৃপক্ষ আফসারকে মেসেজ লিখে পাঠান এবারের বৈশাখের জলসায় তাকে দিয়ে তারা গান করাতে চায়।

আফসার তাদের সাথে যোগাযোগ করে। তিন বছর আগের সেই পহেলা বৈশাখের জমজমাট আয়োজনে জনসমাগমে প্রথম গান করে সে। সারা দিন গান গেয়ে আয়োজক পারিশ্রমিক হিসেবে আফসারের হাতে টাকার যে খামটি তুলে দেয়, সেখানে হয়তো টাকার অঙ্ক বেশি ছিল না। তবে আফসার এই নিয়ে কোনো অভিযোগ রাখেনি। এই দুনিয়ায় গরিব মানুষদের অভিযোগ রাখতে নেই। অভিযোগ হচ্ছে ধনী মানুষদের দক্ষতা। আফসার গরিব ঘরের সন্তান। সর্পদংশনে বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরাটা কতটা কঠিন, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সে। ছোট দুটি ভাইবোনকে পড়ালেখার খরচ আর হার্টের রোগী মায়ের চিকিৎসার ওষুধ কিনতে অসীম হিমশিম আজও খাচ্ছে। এমন দুর্দিনে বিত্তশালী সব আত্মীয়দের দূরত্ব প্রতি দমে দমে তাকে শেখাচ্ছে- কেউ কারো আপন নয়।

এসব কিছু ভাবতে ভাবতে জেলা সদরের অতি কাছে চলে এসেছে আফসার। অন্যান্যবারের তুলনায় আজ সেই সুরের মূর্ছনায় সবাইকে ব্যাকুল করে তুলবে। গলা ভালোভাবে সাধনা করেছে। গতবার একটা গানের লাইন সে ভুল গেছে। এবার ভুল করা যাবে না। সেদিকে নজর রাখতে হবে ভীষণ। বৈশাখে কেনা গায়ের পাঞ্জাবিটা বারবার দেখছে। প্রতিবার এখানে এলে আয়োজকের পক্ষ থেকে সে পান্তা ইলিশ খায়। পান্তা ইলিশ মুখে দিতেই ছোট ভাইবোন রকি ও মিমকে মনে পড়ে। ওরা কখনো বৈশাখের পান্তা ইলিশ খায়নি। সে কথা ভাবতে গেলে আফসারের চোখ ভিজে আসে।

সিএনজি থেকে নামতেই কানে ভেসে এলো মাইকের আওয়াজ। জেলা কলেজ মাঠে বৈশাখের এই আয়োজনে মাইক থেকে ভেসে আসছে বাংলা নববর্ষের হৈ হৈ কান্ড রই রই ব্যাপার।

অনুষ্ঠানে প্রবেশের আগে আফসার ঢুকল একটা কফি দোকানে। কপি খেলে নাকি গলার স্বর স্পষ্ট থাকে। অর্ডার করার কিছুক্ষণ পর কপির মগ হাতে এলো। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ভাবে, কর্তৃপক্ষ এবার যে পয়সা দেবে তাকে, সেখান থেকে মায়ের জন্য দামি দেখে একটা পানের বাটা কিনতে হবে। পান রসিক মায়ের পানের বাটাটা পুরনো হয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। মিমের জন্য একটা হেডফোন কিনতে হবে। ওর অনেকদিনের শখ একটা হেডফোনের। তাছাড়া রকির সাইকেলের সামনের চাকার টায়ার ফেটে গেছে মাসখানেক আগে। টাকার অভাবে ঠিক করা হয়নি। এবার পুরো চাকাটাই নতুন করে কিনে দিতে হবে। নিজের জন্যও এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল কিনবে।

২.

মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আফসারের চোখ চকচক করে উঠল। কি দারুণ মঞ্চ বানানো হয়েছে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার। ভাবতে ভালো লাগছে যে এই মঞ্চে সে কিছুক্ষণ পর গাইবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য এক সত্য আফসারকে জানায় আয়োজক। এবারের বৈশাখে আফসার গাইবার সুযোগ পাচ্ছে না। দেশের নামকরা গায়ক রওনক চৌধুরী এবার গাইবে। অনেক চেষ্টার পর পরশু রাতে তার সিডিউল পাওয়া গেছে। কিন্তু আফসারকে বারণ করে দিতে ভুলে গেছে আয়োজক।

মনটা বিষন্ন হয়ে গেল আফসারের। বিষন্ন মন নিয়ে বৈশাখের এই জলসা থেকে বের হতেই দেখে একটা লাল প্রাইভেট কার এসেছে। ভেতরে দেশের জনপ্রিয় গায়ক রওনক চৌধুরী। তাকে ঘিরে জনতার ঢল নেমেছে। আয়োজকরা ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৈশাখের এই বিশেষ অতিথিকে বরণ করে নিতে।