কালু দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে গা-গোসল দিয়ে খেতে বসলে তার ছয় সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে ময়না কেঁদে কেঁদে বায়না ধরেছে তার কাছে। সে এবার ঈদের পর তাদের গাঁয়ের বৈশাখি মেলায় যাবে। তাই তাকে একটা ঘাগরগাঁথা লাল টুকটুকে কুচি দেওয়া বৈশাখি ফ্রক জামা কিনে দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে একটা লাল পাজামা আর জুতা। যে জামা-কাপড় পরে সে এবার ঈদ করবে। আর বৈশাখি মেলাতে গিয়ে নাগর-দোলনায় চড়বে। কালু একজন হতদরিদ্র ভ্যানওয়ালা। যার নিত্য দিন আনা দিন খাওয়ায় জীবন। বলা যায় যে, সে একেবারে ছা-পোষা নিঃস্ব অভাবী গরিব মানুষ। প্রতিদিনের আয়-রোজগারের উপর যার দাঁড়ির মুখে বেঁচে থাকার মতো, দুবেলা দুমুঠো পেটের অন্ন জোটে। কালু সে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে রাত-দিন কলুর বলদের মতো খাটে। কিন্তু খেটে সে কি করবে? ‘দুর্ভাগা যে, তার জীবনে কি আর কখনো দূরআশার অন্ধকার ঘুচে আশার আলো ফোটে?’ তবু কালু যে বড় আশাতে বুক বেঁধে নিত্যদিন হাড়ভাঙা ঘাম ঝরানো কঠিন খাটুনি খাটে। এভাবে দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন আসে। আর কালু সময় গুণতে থাকে। হয়তো কালকের প্রত্যুষে সুভাগ্য আপনা হতে তার ভাগ্যের দুয়ারে এসে ধরা দিবে। সেই আশাতে আবারো প্রতিক্ষা তার একটা নতুন প্রভাতের। ‘তার নিরাশায় ঘেরা জীবনে আশার বাহক হয়ে যদি কাল প্রভাতে নতুন সূর্য ওঠে সেজন্য। কিন্তু কালু জানে না, কোনো দুঃখীর কপালে কখনো সুখ নাহি জেটে’। আর তাই তো ময়নার জন্মের পরপরই কালুর স্ত্রী অর্থাৎ ময়নার মা- আয়না বেগমও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ল। জরায়ু আর মূত্রনালীর ইনফেকশনে ভুগছে সে। প্রতিদিন তার জন্য ওষুধ কিনতে হয় কালুকে।
যাহোক, যেটা বলছিলাম ময়না বৈশাখি জামার জন্য বায়না করেই চলেছে। ময়নার মা- আয়না বলল, মা ময়না বিরক্ত করো না তোমার বাবাকে। একটু ধীরস্থিরভাবে তোমার বাবাকে খেতে দাও। ময়না বলল, না আমার জামা কিনে দেবে কি না
বলুক। আবার ময়না কাঁদতে কাঁদতে চোখের নাকের জলে একাকার হয়ে বলতে লাগল ও বাবা...বাবা...বলো না...আমার জন্য লাল বৈশাখি জামা কিনে দেবে তো?
কালু তার ছোট্ট মেয়েটাকে কি করে বুঝাবে যে, গরিবের কোনো শখ আহ্লাদ থাকতে নেই ‘এই পৃথিবীতে গরিবের জন্মই হয়েছে শুধু বুক ভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে অপূর্ণ স্বপ্নের জন্য দীর্ঘ শ্বাসে হা-হুতাশ করার জন্য।’
সে মনের কষ্ট মনেই চেঁপে মেয়ে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বললো ঠিক আছে মা, ময়না। তোমার জন্য একটা লাল
টুকটুকে কুচি দেওয়া ঘাগর গাঁথা বৈশাখি ফ্রক জামা কিনে আনব। এবার তুমি খুশি তো? এবার চোখের জল মুছে একটু হাসো দেখি। ময়নার কেবল দাঁত পড়ে দাঁত উঠছে। আবার কিছু দাঁত এখনো ওঠেনি। সে দুই হাত দিয়ে চোখের জল মুছে তার ফোকলা দাঁত বের করে চান্দের আলো ঝরা বিশ্বজয়ী হাসি হাসতে লাগল। আর দুহাত এক করে তালি দিতে দিতে বলতে লাগলো আহা কি মজা..কি মজা..আমার আব্বু আমার জন্য নতুন লাল বৈশাখি জামা কিনে দেবে। ময়নার ছোট্ট সে কচি মুখের হাসির কাছে শুধু সাত রাজার ধন কেনো... পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ এক করলেও সে হাসির সমতুল্য হবে না। কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দে অভাবী কোনো পিতার সন্তানের মুখের মুক্তা ঝরানো হাসি কতটা যে সুখের, কতোটা আনন্দের, কতোটা তৃপ্তিদ্বায়ক তাণ্ড কেবল সেই পিতাই জানে।’
কালুর স্ত্রী আয়না বললো, মেয়েকে জামা কিনে দিবে তো বললে। কি করে কিনবে? একে-তো নিজেদের খাওয়া জুটছে না। এই অভাবের মধ্যে... কালু বললো ও নিয়ে তুমি চিন্তা করোনা ময়নার মা। দেখবে ঠিক এক উপায় হয়ে যাবে।
মেয়ে ময়না বললো, আব্বু তুমি না খুব ভালো। আর মা আয়নার দিকে ময়না তাকিয়ে বললো মা তুমি খুব পচা। কালু বললো না মা ময়না, ও কথা বলতে নেই। তোমার আম্মুও অনেক ভালো।
ময়না বললো, তাই? আচ্ছা ঠিক আছে আম্মু তুমি ও খুব ভালো। ময়না খেলতে চলে গেলো। কালু গুছিয়ে সে তার ভান নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সে মনে মনে ভাবছে আজ থেকে তাকে আরো একটু বেশি রাত পর্যন্ত ভান চালাতে হবে। তাহলে তার মেয়ের শখ পূরণ করতে পারবে। এবারের মতো প্রতি বছর তাদের গায়ে বৈশাখি মেলা বসে। সে দুই-তিন দিন দুপুরে বাড়ি না এসে বাড়তি আয়ের জন্য গায়ের পার্শ্ববর্তী মফস্বল শহরে ভ্যান চালাতে লাগলো। বাড়িতে বউকেও বলে দিয়েছে দুপুরের জন্য তার খাবার রান্না না করতে। দুপুরে কোনো হোটলেও সে খায় না। খুব বেশি তৃষ্ণার্ত আর ক্ষিদে পেলে একটু জল খেয়ে নেয়। এভাবে সে না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে থেকে গভীর রাত অবধী ভ্যান চালায় টাকা জমায় তার মেয়ে ময়নার জামা জুতার জন্য। রাত পোহালেই ঈদ। আর ঈদের তিন দিন পরেই বৈশাখি মেলা। আর তাই অনেক রাত পর্যন্ত আজ বাজারের দোকানপাট খোলা।
কালু গভীর রাত পর্যন্ত ভ্যান চালায় শেষে মেয়ে ময়নার জন্য একটা লাল টুকটুকে ঘাগর গাঁথা কুচি দেওয়া ফ্রক লাল পাজামা আর জুতা কিনে বাড়ি ফিরছে। না খেয়ে না দুয়ে শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। মাথাটা কেমন যেনো ঘুরছে। চোখে মুখে যেনো অন্ধকার দেখছে সে। দুজন লোক বললো ভাই সামনের মোড়ে নামব যাবেন? কালু ভাবলো এ পথ দিয়েই তো আমি বাড়ি ফিরব। যাওয়ার পথে যদি কয়টা টাকা হয় অসুবিধে কি? সে বললো যাবো ওঠেন। মফস্বল শহর ছাড়ায় গাঁয়ের অন্ধকার রোড। ভ্যানের সামনে হারিকেন রাখা। তাতে কোনো রকম পথ দেখার মতো টিপটিপ করে আলো জ্বলছে। হঠাৎ মাঠের মধ্যে আসলে, পেছন থেকে যাত্রী বেশে ছিনতাইকারী দুজন চাকু, বের করে বললো এই শালা ভ্যান রাখ। দে- তোর কাছে যাকিছু আছে বের কর। কালু তো হতভম্ব।
কিংকর্তব্য বিমূঢ় হওয়ার অবস্থা তার। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। কালু বললো কে... আপনারা? কি করছেন কি? ওরা বললো আমরা কে বুঝতে পারছিস না? চাকু পেটে ঠেকিয়ে বললো আমরা ছিনতাইকারী শালা। দে- টাকা-পয়সা আর যা কিছু আছে দে। কালুর পকেট হাতড়িয়ে মাত্র পঞ্চাশ টাকা পেলো। আর একটা পলিথিনে কিছু ওষুধ আর মেয়ের জন্য কেনা জামাকাপড় জুতা। কালু বললো, এগুলো নেবেন না। এগুলো আমার মেয়ের জন্য কেনা। আর এই টাকাটা আমি দেবো না। আমার মেয়ে ঈদে মিষ্টি কিনে খাবে। ছিনতাইকারীরা বললো, দে, দে শালা বলছি দে।
না হলে কিন্তু একেবারে জীবনে মেরে ফেলবো। এভাবে ধস্তাধস্তি করতে করতে একজন হঠাৎ চাকু বসিয়ে দিলো কালুর বুকে। কালু চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কিন্তু মেয়ের লাল বৈশাখি জামা পাজামা জুতা ছাড়লো না। কিসের একটা শব্দ আসতে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে সরে পড়লো। কালুর নিথর দেহ পড়ে থাকলো পথে। সকালে লোকমুখে সংবাদ আসতেই কালুর স্ত্রী আয়না মেয়ে ময়নাকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হলো। অনেক লোকের সমাগম। পুলিশও আছে। কালুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো স্ত্রী আয়না। তখনো কালুর দুহাতে বুকের সাথে ধরে রাখা রক্ত মাখা মেয়ে ময়নার বৈশাখি লাল জামাকাপড়ের ব্যাগ। ময়না কালুর লাশের উপর আঁচড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো আমি লাল বৈশাখি জামা চাইনে বাবা তুমি কথা বলো বাবা। কথা বলো বাবা...কথা বলো তুমি। ময়নার অমন আহাজারি করে কাঁদতে দেখে তখন উপস্থিত অন্যদের চোখেও জল চলে এলো...।