এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বৈচিত্র্যময় গল্পের সমাহারে লেখক বইটি সাজিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি গল্পে পাঠককে তিনি নতুন আখ্যানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কখনো তিনি তা করেছেন জাদুবাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতা দিয়ে, কখনো চলমান জীবনের কথকতা দিয়ে। ইনকিউবেটর, অদ্ভুত গোলাপ বাগান, সাতটি পিতলের ড্যাগ, নাচের শহর রূপেশ্বরী, ঔরসজাত, কলিমুল্লাহ দরবেশ- এমনই সব গল্প।
ইনকিউবেটর গল্পে এক জমজের জন্ম এবং জন্মের অব্যবহিত পরেই একসাথে ইনকিউবটরে অবস্থান, সেই থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা। তারা স্কুলে লেখাপড়াও শুরু করে। এদেরই একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে যখন কোনোভাবেই সুস্থ হচ্ছিল না- মৃত্যুর দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল সেই সময় হাসপাতালের এক সিস্টারের চিন্তায় আসে ওর পাশে ওর জমজকে রাখতে হবে। বড়ো বড়ো চিকিৎসকরা যা চিন্তা করেননি সিস্টারের চিন্তায় সেটিই আসল। হয়তো মেডিকেল সায়েন্সে এমন কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির বিবরণ নেই। কিন্তু এর পরেই ঘটে চলল মিরাকল। অদ্ভুত গোলাপ বাগান দারুণ এক জাদুবাস্তবতার গল্প। ঘটনাটি ফ্রান্সের এক ছোট শহর মেন্টন। এই শহরে একটি মেয়ে থাকত তার দাদুর সাথে এক পোড়োবাড়িতে। এখানে বসবাসকালে সে যেসব ছেলের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিল তাদের তার নিজ বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়ে গোলাপ বাগানে গোলাপ গাছে রূপান্তর করার ক্ষমতা তার ছিল। লেখকের স্বার্থকতা এখানেই যে, গল্পটি পড়ে আদৌ রূপকথা মনে হবে না। নাম গল্প নাচের শহর রূপেশ্বরী। ইরাবতী ও মিথুনের প্রেমের গল্পটি শেষ হয়েছে পরাবাস্তবতার আবহে বিয়োগাত্মক পরিণতির মধ্য দিয়ে। নাচের শহর রূপেশ্বরী বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রেম ও প্রতিশোধের গল্প। ইরাবতী একজন অতৃপ্ত আত্মার মৃত নারী রূপেশ্বরী শহরের সব পুরুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে তাদের নপুংসক বানিয়ে ফেলতে চায়। সেই ঘটনা রুখতেই জমিদারের ছেলে মিথুন ইরাবতীর সাথে মিশতে শুরু করে। কিন্তু গল্পে দেখা যায় দুজন দুজনকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলে। মিথুনের চোখের জলে ইরাবতী অভিশাপ মুক্ত হয়। আর তখনই দুজনের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয় কিন্তু তার ইরাবতী অইসব পুরুষদের পুরুষত্ব ফিরে পাবার পথ বাতলে দিয়ে যায়। পরাবস্তব আবহের এই গল্পটি পাঠ করলে ইরাবতীর জন্য পাঠক হৃদয়ের গভীর সমর্পণ তৈরি হয়।
সাতটি পিতলের ড্যাগ নামীয় দীর্ঘ গল্পটিতে বেশ অনেকগুলো চরিত্রের সমাবেশ হয়েছে। ন্যারেটিভে কিছুটা উপন্যাসের আবহের ছায়া পাওয়া যায়। প্রধান চরিত্র মজিদখান। স্বপ্নে সে দেখে টাকা ভরিতি সাতটি পিতলের ড্যাগ। এই স্বপ্নই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র ছেলে সাপের কামড়ে মৃত্যু বরণ করে। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে সে আবারও বিয়ে করে। সন্তান হয়। কিন্তু পরাবাস্তবতার ঘোরে সে রাতে প্রস্রাব করতে বের হয়ে আবারো টাকা ভরতি সাতটি পিতলের ড্যাগ দেখতে পায়।
ভোকাট্টা ঘুড়ি সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষিতে ভালো লাগার মতো একটি গল্প। করোনার পরে বেকারত্বের সময়ে আবীরের স্ত্রী শম্মি পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। ফেসবুকে কবিতার নামে কিছু অকবিতা লিখে শতশত লাইক, কমেন্ট পেয়ে নিজের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণায় উপনীত হয়। একটা সময় স্বামী ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে সব কিছুই আবিষ্কার করে ফেলে। বিয়োগাত্মক ঘটনাটি অবাস্তব বলে মনে হয়নি। দ্বয়িত গল্পটি সত্তর-আশির দশকের সিনেমার গল্পের মতো মনে হয়েছে। এগল্পটিতে গল্প-সংকলনের অন্য গল্পগুলোর মতো নতুনত্ব বা আহামরি কিছু নেই। অপহরণ গল্পটিও বিশেষ কোনও কৃতিত্ব দাবি করে না। হারকিউলিস মাদার গল্পটি শুধু আমাদের দেশ নয় চলমান বিশ্বের সকল স্বল্পোন্নত দেশের নারীত্বের নিদারুন অবমাননা প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পটি নারী পাচার ও তাদেরকে পতিতালয়ে বিক্রয়কে উপজীব্য করে গল্পের আখ্যান গড়ে উঠেছে। ঢাকা মিরপুরের বিউটিও কাজের সন্ধানে পাচারকারীদে খপ্পরে পড়ে এবং তার আশ্রয় হয় কলকাতার পতিতালয়ে। সেখান থেকে সে ফোনে তার মাকে জানায়। তার মা স্বামীর সম্মতিতে পাচারকারীদের সাথে সখ্য গড়ে তোলে। সে নিজেও পাচায় হয়ে মেয়েকে উদ্ধারের মিশনে নামে। কিন্তু তার স্থান হয় দিল্লীর পতিতালয়ে। বিউটির মাও ধর্ষিত হয়। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিউটির মা তাঁর মেয়েকে উদ্ধার করে। তবে এখানে পাঠকের মনে খটকা লাগা অস্বাভাবিক নয় যে মেয়েকে উদ্ধারের জন্য কোনো ‘মা’ নিজে অন্য দেশের পতিতালয়ে বিক্রিত হবার ঝুঁকি নিবে কি না? যদি পাঠকের কাছে এমন আখ্যান অবাস্তব মনে হয় তাহলে গল্পের আখ্যানভাগই পরিবর্তন করতে হবে। গল্পটিতে ধর্ষকের ভাষাও শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে।
ঔরসজাত গল্পটি লন্ডনের প্রেক্ষাপটে বাঙালি বিবাহিত মাঝবয়সি মেয়ে লীনা ফিলোপিনো যুবক ব্যাননির মধ্যকার অনাকাঙ্ক্ষিত সঙ্গমের গল্প। লীনা পিএইচডি করার জন্য লন্ডনে যায়। সেখানে ব্যাননীর পিছু লেগে থাকার প্রেক্ষিতে লীনা তাকে কিছুটা প্রশ্রয় দেয়, কিন্তু তার সাথে মদ খাওয়া কিংবা লিভ টুগেদারে যেতে অস্বীকার করে। দেশে চলে আসার আগে ব্যননি লীনার কাছে একটি রাত সময় চায়। কারণ লীনার সাথে সে শৈশবের গল্প বলবে। সেই রাতে ব্যননী প্রচুর মদ খায়, লীনাকে মদ খেতে না পারার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে লীনাও অনেকটুকু মদ খায়। এরপর ব্যননী লীনাকে দেখতে পায়- তার ছেড়ে যাওয়া প্রেমিকা রূপে এবং সেই নামেই ডাকতে থাকে ও তার সাথে সহবাস করে।
লীনা গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার স্বামী গর্ভপাতে সম্মতি দেয় না। ব্যাননি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত্যু শয্যায় তখন লীনার স্বামীই ব্যাননির কানে কানে বলে- আমার ছোট ছেলের জন্মদাতা তুমি। হি ইজ ফ্লেস অফ ইউর ফ্লেস। তখন দেখা যায় তিনজনের চোখ থেকেই অঝোরে জল ঝরতে থাকে। যদিও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ-বিষয়ে ঔৎসুক্য থেকেই যায় যে, কোনো স্বামী তার স্ত্রীর অবৈধ গর্ভধারণ মেনে নেয় কিনা! তবে গল্প শেষ না হওয়া অব্দি কোনোভাবেই এর পরিনতি বোঝা যায় না। গল্পকারের কৃতিত্ব তিনি পাঠকের মনযোগ ধরে রেখেছেন শেষ অব্দি।
লাল শাড়িটি গল্প আমাদের সমাজে বহুল চর্চিত ঘটনা বিবৃত হয়েছে। গল্পের মুখ্য চরিত্র নিরুর বিয়ের পরে তার প্রিয় লাল শাড়ি হারিয়ে যায়। যৌথপরিবারে শাড়িটি কে নিতে পারে তা নিয়ে অনেক আলোচনা, দেনদরবার। অবশেষে মেজ চাচা নোয়া চাচার স্ত্রীকে বেদম পেটাতে শুরু করে কেননা, তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে খারাপ, সন্দেহের তীর তার দিকেই যায়। কিন্তু এক বছর পরে মেজ চাচার মেয়ের বিয়েতে নিরু আসে বাপের বাড়িতে। দাওয়াতে যায় মেজ চাচার ঘরে। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য হলেও দেখে তার লাল শাড়িটি মেজ চাচার মেয়ে এষার ঘরের তারে ঝোলানো। গল্পটি বিশেষ কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে বরে মনে হয়নি। দীর্ঘ গল্প কলিমুল্লাহ দরবেশ। কলিমুল্লা কখনোই দরবেশ ছিল না। ভালোবেসে বিয়ে করে সুন্দরী রূপালীকে। বিয়ের পরে তাকে চলে যেতে হয় শহরে। কলিমুল্লাহর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুন্দরী স্ত্রী রূপালী গার্মেন্টেসে চাকরি নেয়। এর পরে তার মধ্যে সে পরিবর্তন দেখতে পায়। হঠাৎ করেই সে যে খরচ করতে শুরু করে তা তার বেতনের চেয়ে বেশি। রাতে কলিমুল্লাহ যখন স্ত্রীর সাতে মিলিত হতে চায় তখন তার মধ্যে অনীহা লক্ষ্য করে। এমনকি তার শরীরে পুরুষের ছোঁয়ার প্রমাণও পায়। কলিমুল্লাহ চট্টগ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রূপালীকে ময়মনসিংহের ভালুকাতে নিয়ে যায়। সেখানে সে রূপালীকে হত্যা করে। সেখান থেকে সে পালিয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে দরবেশের রূপ নিয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। এই গ্রামেই বিয়ে করে আসে এক পুলিশ অফিসার। তার সন্দেহ হয়। প্রমাণদিসহ সে কলিমুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে। কলিমুল্লাহ তখন তার আস্তানার ভেতর থেকে তার দয়িতার কর্তিত স্তন ও ঠোট নিয়ে আসে সাথে রাখার জন্য। মানবশরীরের কর্তিত অংশ এত বছর কীভাবে সংরক্ষিত থাকল তা লিখলে ভালো হতো। গল্পের আঙ্গিক বিন্যাস পর্যালোচনা করলে কোথাও ছন্দপতন লক্ষ্য করা যায় না। বরং অধিকাংশ গল্পই পাঠককে চূড়ান্ত পরিণতি জানতে আগ্রহী করে তোলে। ছোটোগল্পের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য টুইস্ট। লেখকের গল্পগুলোর আখ্যানবিন্যাস এমনই যে মনে হয় টুইস্টই গল্পের প্রাণ। কিছু কিছু গল্পে চমৎকার মেটাফোরের অবতাড়না করা হয়েছে। আখ্যান-বয়ানে রেখকের সাবলীলতা প্রশংসনীয়। বর্তমানে বেশিরভাগ লেখকই জটিল ভাষা পরিত্যাগ করে সাধারণ ও সাবলীল ভাষায় গল্প লেখেন। নুসরাত সুলতানা তার ব্যতিক্রম নন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শব্দ প্রয়োগে কিছুটা সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। লেখকের বাড়ি সম্ভবত বরিশাল, যে কারণে তিনি যে সব গল্পে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। আঞ্চলিক ভাষার শুদ্ধতম প্রয়োগ গল্পে ভিন্ন এক ব্যাঞ্জনা তৈরি করে, যা তিনি করতে পেরেছেন। তবে বেশ কিছু গল্পে চরিত্রের সংখ্যাধিক্য এবং ন্যারেটিভে ডিটেইলিং অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও চরিত্রসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ উপন্যাসের আবহ তৈরি করেছে। আশা করি ভবিষ্যতে লেখক এ ব্যাপারটি মূল্যায়ন করবেন।
বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন এবং প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশনা। কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক