শিশু শ্রমিক রতনের গল্প

ফারুক আহম্মেদ জীবন

প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ওঢাকা মগবাজারের একটা ভাতের হোটেলে কাজ করে রতন। বয়স মাত্র দশ বছর। আসলে এ বয়সে ওর পড়াশোনা খেলাধুলা আর হৈ-হুল্লোড় করে হাসি আনন্দে জীবন কাটানোর কথা। কিন্তু, সেটা আর রতনের ভাগ্যে জোটেনি.... কি করে জুটবে..? “কথায় আছে না, অতি যত্নের জিনিস পিঁপড়ে খায়” রতনের বেলায়ও হয়েছে ঠিক তাই।

আসলে শিশু শ্রমিক রতনের মতো কতো যে রত্ন।

যত্ন বিনে আজ অবহেলা অনাদর আর অবজ্ঞাতে

পুষ্পের মতো পাপড়ি মেলে মিষ্ট সুবাস বিলানোর

আগেই কুড়িতেই যে ঝরে পড়ছে। সেসবের হিসাব

আমরা কয়জনেই বা রাখি?

এমনটা শুধু যে আমাদের দেশ বাংলাদেশে তা কিন্তু নয়। সমগ্র বিশ্বের শহর বন্দর গাঁয়ে হাইওয়ের ফুটপথে রেলস্টেশনে রতনের মতো কতো যে রত্ন অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে কঠিন সংগ্রাম করে চলেছে। রতনের জন্মের পর ওর মা-বাবা বড় আদর করে ছেলের নাম রেখেছিল রতন। আর তার তিন বছর পর রতনের একটা বোন হয় রতনের নামের সাথে মিল করে মেয়ের নাম রাখে রেণু। ওদের বাবা ছিল একজন বেবিট্যাক্সি ওয়ালা নাম বাঁধন। আর মায়ের নাম মায়া। সত্যিই বাঁধন আর মায়ার দুটি সন্তান রতন আর রেণুকে নিয়ে বেশ মায়ার বাঁধনে ঘেরা ছিল ওদের সুখের পরিবারটি। কিন্তু সে সুখ ওদের ভাগ্যে বেশি দিন সয়নি। আর তাই রেণুর জন্মের ছয় মাসের মাথায় একরাতে ওদের বাবা বাঁধন যাত্রী নামিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায়। ওদের সংসারে নেমে আসে অমানিশায় ঘেরা ঘোর অন্ধকার। ওদের বাবা বাঁধন বেঁচে থাকতে মগবাজার এলাকায় একটা বাসা ভাড়া নিয়ে ওরা থাকতো। কিন্তু রতনের বাবার মৃত্যুর পর ভাড়া দিতে না পারার কারণে মাথা গোজার ছাদ টুকুও ওরা হারিয়ে ফেলে। ওদের মা মায়া ছোট ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে কি করবে? কোথায় যাবে? এই ভেবে। অবশেষে দয়াল মায়াকে বোনের মর্যাদায় বস্তিতে ছেলে-মেয়ে দুটো নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। আর গার্মেন্টসে কাজ জোগাড় করে দেয়। কিন্তু, বিধির লেখা খণ্ডন করবে এমন সাধ্য কার? আর তাই তো একদিন হঠাৎ গার্মেন্টস থেকে ফেরার পর রাতে স্ট্রোক করে মারা যায় ওদের মা- মায়া। মা-বাবাকে হারিয়ে একেবারে অনাথ হয়ে যায় রতন আর রেণু। আর তখন থেকে বোনটিকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য হোটেলে কাজ করে রতন। যা হোক যেটা বলছিলাম, রতন যে হোটেলে কাজ করে। একদিন সেই হোটেল মালিক দয়াল, তার ক্যাশ টেবিল থেকে রতনকে ডাক দিলো এই রতন রতন..? শুনতে পারছিস..?

রতন গ্লাস প্লেট ধুতে ধুতে জবাব দিলে এইতো মামা হাতের কাজটা শেষ করেই এহনি আইতাছি। তারপর রতন হাতের কাজ শেষ করে এগিয়ে এসে বললো হ্যা মামা কন কি কইতাছেন? হোটেল মালিক দয়াল বললো একটু তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারিসনে? এরকম নিম নিম করে কাজ করলে এদিকটা সামলাবি কখন হুম? তারপর বললো শোন, ওই যে দেখতাছিস পিছনের টেবিলে এক ভদ্রলোক সাথে এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বসে গল্প করছে। যা- ওই টিবিলটাতে এই খাবারগুলো দিয়ে আয়। রতন জ্বি, আচ্ছা এহনি যাইতাছি মামা। রতন টেবিলের কাছে খাবারের প্লেট নিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা বেখেয়ালি হয়ে হাত নাড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে রতনের হাতের সাথে ধাক্কা লেগে মোবাইলটা টেবিলের নিচে ফ্লোরের মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে গেলো। আর রতনের হাতের খাবার প্লেট পড়ে জলের গ্লাস ছটকে ওদের দুজনার দেহের কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা রাগে দাঁতের উপর দাঁত রেখে কিড়মিড় কিড়মিড় করতে করতে ছোটলোকের বাচ্চা কি করলি কি এটা? এই বলে রতনের ছোট্ট গালটিতে কষে দিলো একটা থাপ্পড়। তারপর বললো আমার শখের এতো দামি মোবাইলটা তুই ভেঙ্গে দিলি? এই বলে আবার অন্য গালে মারলো আরেক চড়। হোটেল মালিক দয়াল, রতনকে ঐভাবে মারতে দেখে ক্যাশ টেবিল থেকে দ্রুত ছুটে এসে বললো ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে। ছোট মানুষ। ক্ষমা করে দিন ছেলেটিকে। রতন কাঁদতে কাঁদতে বললো কিন্তু মামা ওনার হাতের আঘাত লেগেই তো... কথা শেষ করার আগে দয়াল ইশারা ইঙ্গিতে চুপ করতে বললো রতনকে। কিন্তু রতনের ঐটুকু কথায় ভদ্রমহিলা ওর গায়ের গেঞ্জি ধরে টানাহেঁচড়া করতে করতে বললো তুই আমার এতবড় ক্ষতি করে আবার মুখেমুখে তর্ক করছিস? ফকিন্নি, ছোটলোকের জাত। যতো বড় মুখ না ততো-বড় কথা।

ভদ্রমহিলার সঙ্গে থাকা ভদ্রলোকটি গায়ের জামা প্যান্টে পড়া খাবার জল মুছতে মুছতে বললো দাও বেয়াদবটাকে একটু উত্তমমধ্যম দিয়ে দাও। ভদ্রমহিলা তখন রতনকে বললো জানিস আমার এ মোবাইলটার দাম কতো? তোর চৌদ্দগোষ্ঠীর মধ্যে কেউ এমন দামি মোবাইল কেনা তো দূরে থাক কখনো চোখে দেখেছে? হোটেল মালিক দয়াল আবারো বললো ও বুঝতে পারেনি ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম।

ভদ্রমহিলা বললো আপনি চুপ করুন এইসব ইতর ছোটলোকদের আপনি হোটেলে রেখেছেন কেনো? তারপর আবার গালে চড় মারতে লাগলো রতনের ছোট্ট বোনটি রেণু মাঝে মধ্যে ওর ভাইয়ার থালা বাসন মাজার কাজে সাহায্য করে। সে সময় রতনকে মারতে দেখে রেণু দৌড়ে এসে বললো ছাড়ো... ছাড়ো... আমার ভাইকে মারছো কেনো? ছেড়ে দাও আমার ভাইয়াকে... ছেড়ে দাও... বলছি। তখন ওই মহিলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো রতনকে। রতন ছিটকে গিয়ে পড়লো অন্য এক টেবিলের কাছে। টেবিলের পাইয়ার কার্ণিশে রতনের কপাল কেটে রক্ত ঝরছে। হৃদয় হোটেলে ঢুকতেই এতটুকু দৃশ্য দেখলো সে। সে রতনকে তুলে কপালের ক্ষত জায়গায় পকেট থেকে টিস্যু বের করে চেপে ধরলো। রতন হাউমাউ করে কাঁদছে। তারপর হৃদয় সবকিছু শুনলো রতন আর হোটেল মালিক দয়ালের কাছ থেকে।

হৃদয় ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাটিকে বললো দেখতে তো মানুষ মনে হচ্ছে। কিন্তু অমানুষের মতো খাসলত কেনো? মানবিকতা জ্ঞানটুকুও নেই। এইটুকু শিশু বাচ্চার সাথে কেমন আচরণ করতে হয় সে শিক্ষা কি পাননি?

ভদ্রমহিলা বললো আপনি আবার কোন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর শুনি? যে আপনার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে? হৃদয় বললো আমি কে সেটা এক্ষুণি জানতে পারবেন। তারপর মোবাইল করতেই পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হলো। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে ঘিরে ধরলো পুলিশ। হৃদয় তার পরিচয় কার্ড তুলে ধরে বললো। আমি এই জেলার ডিসি। তারপর পুলিশ ফোর্সদের হুকুম দিলো শিশু নির্যাতনের অপরাধে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাটিকে গ্রেপ্তার করার জন্য। দয়ালকে ডেকে বললো আপনি জানেন শিশু শ্রম অমার্জনীয় অপরাধ? দয়াল বললো জানি স্যার আমি করাতে চাইনি। কিন্তু রতন ওর আর ওর বোনের কথা বলে এমন ভাবে কাদঁতে কাঁদতে এসে বললো যে- আমি আর না করতে....

রতন বললো ওনার কোনো দোষ নেই স্যার ওনাকে কিছু করবেন না। মামা ঠাঁই না দিলে যে আমরা কচুরিপানার মতো ভেসে যেতাম স্যার।

রতনের মুখে শুনে ক্ষমা চোখে দেখলো ডিসি হৃদয়, হোটেল মালিক দয়ালকে। তারপর রতনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো সে। হৃদয় রতন আর রেণুকে পেয়ে সে যেনো তার ছেলে-মেয়েকে ফিরে পেয়েছে।

ওদের মতো হৃদয়েরও দুটি সন্তান ছিলো। যারা বছরখানেক আগে ওদের মায়ের সাথে সিলেটে মামা বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ভাগ্য ক্রমে বেঁচে যায় হৃদয়। কেননা সে চাকরির কারণে ওই যাত্রায় যেতে পারিনি। যা হোক এরপর রতনকে আর হোটেলে কাজ করতে দেয়নি হৃদয়। রতন আর রেণুকে সে তার বাড়িতে এনে নিজের সন্তানের মতো করে বাবা মায়ের আদর স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে অতি যত্নে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে লাগলো। ডিসি হৃদয় অনাথ রতন রেণুকে ঠাঁই দিয়ে স্থাপন করলো এক মানবিক দৃষ্টান্ত।