বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর একটি উক্তি দিয়েই শুরু করি- ‘জ্ঞানের প্রদীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িবে। মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্য সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন।’ আসলেই সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। মনোজগতে আলো না থাকলে শুধু বহির্জগতের আলো দিয়ে কোনো মানুষ কিংবা জাতি বহুদূর যেতে পারে না। যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির কর্মকাণ্ডে যত অগ্রগামী, সে জাতি অন্য জাতির কাছে তত বেশি গ্রহণযোগ্য ও পূজনীয়।
সময় আর সভ্যতা এ দুটোর হাত ধরেই এগিয়ে যায় সাহিত্য। মানুষ তার জৈবিক ও আত্মিক চেতনা থেকে ছড়িয়ে দিতে চায় শিল্প-সাহিত্যের সুমধুর রস। যা পান করে যুগে যুগে ঋদ্ধ হয় লেখক-পাঠক ও জনসাধারণ। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের যাত্রাও এখন আর কম দীর্ঘ বলে মনে করি না। সাহিত্য নিজেই অনন্ত পথের যাত্রী। সে কোন কোন পথ দিয়ে বয়ে যাবে এরও নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। নদীর মতো এরও আছে ভিন্ন ভিন্ন গতি পথ। সময়ের যানে ঘুরে ঘুরে টিকে থাকে সে। এর প্রকাশ ও চর্চার মাধ্যমও যুগে যুগে ভিন্ন। এ ভিন্নতার মধ্যেও মানুষ যত দিন থাকবে মনোজগতকে প্রতিভাত করার জন্য সাহিত্যচর্চাও ততদিন থাকবে বলে বোধ করি। এর আদৌ প্রয়োজন না থাকলে কালের পর কাল সাহিত্য টিকে থাকত না।
ফেসবুক সাহিত্যের কোনো অংশ নয়, ফেসবুক একটি প্রচার মাধ্যম মাত্র। কোনোকিছু জাহির করার পথ। মূল উপজীব্য হলো সাহিত্য। আগেই বলেছি, যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির কর্মকাণ্ডে যত অগ্রগামী, সে জাতি অন্য জাতির কাছে তত বেশি গ্রহণযোগ্য ও পূজনীয়। মনুষ্যজীবনে একদিকে যেমন কঠিন বাস্তবতা আছে, অন্যদিকে আছে কোমল মনের আবেগ-অনুভূতি। এই আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা, ভাব, চিন্তা এ সবই সাহিত্যের উপজীব্য। এ সব সামনে রেখেই মানুষ এগিয়ে যায় প্রগতির পথে, সমাজ পরিবর্তনের পথে। মানবিক চেতনা, নৈতিক মূল্যবোধ ও উন্নত সমাজ গঠনে সাহিত্যের অবদান অপরিসীম। তাই আগে সাহিত্য রচনার বিষয় আসে, তারপর প্রকটন। আবার সাহিত্য রচনা করে চিরকাল ডায়েরির ভেতর আবদ্ধ থাকলেইবা লাভ কী? এর প্রকাশও তো প্রয়োজন। বর্তমান সাহিত্যের কয়টা লেখা পত্র-পত্রিকায় স্থান পায়? প্রযুক্তির হাত ধরে বর্তমানে অনেক নতুন কবি-লেখকরা তার রচনা প্রকাশ করতে বেছে নিয়েছেন ফেসবুক। কিন্তু এতে সমাজের কেউ কেউ তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং নাক সিটকিয়ে ফেসবুক কবি কিংবা ফেসবুক রাইটার আখ্যা দিয়ে নিরুৎসাহিত করছেন। মূলত এখানেই আমার কথা বলার মূল উদ্দেশ্য।
মানুষ স্বভাবতই তার সৃষ্টিকে প্রচার করতে চায়। কেউ কম, কেউ বেশি। এটি দোষণীয়ও বলা যায় না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সে কোনো না কোনো প্রচারপথ খোঁজে। আমাদের জীবন যেহেতু এখন প্রযুক্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই বর্তমান সময়ে নিঃসন্দেহে বলা যায়- ফেসবুকই হলো আধুনিক ও উত্তম প্রচারমাধ্যম। রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা, ফ্যাশন, বিজ্ঞাপন, গণ-আন্দোলনসহ নানা বিষয়ে যদি প্রচার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করা যায় তাহলে সাহিত্যে কেন নয়? সেই চিন্তা থেকেই বোধ করি আজকাল নতুন কবি-লেখকরা তাদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধসহ নানা লেখা ফেসবুকে প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু দুঃখ লাগে যখন সাধারণ মানুষের সাথে কিছু কিছু কবি-সাহিত্যিকরাও অবজ্ঞা করে তাদের বলে থাকেন- ফেসবুক কবি কিংবা ফেসবুক রাইটার। ফেসবুকে এখন অনেক লেখালেখি বেড়ে গেছে- এটি তারা সহজভাবে না নিয়ে ঋণাত্মক অর্থে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে যাচ্ছেন। তারা আত্মণ্ডঅহমিকায় মনে করেন তাদের প্রকাশিত পত্রিকার লেখাটিই কেবল লেখা আর ফেসবুকে নতুনদের লেখাগুলোর কোনোটাই লেখা হয়নি। বলতে চাচ্ছি- ফেসবুকে প্রকাশিত কবিতা, গল্পগুলোও লেখা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে- কিন্তু লেখার গুণমান সেটি ভিন্ন বিষয়। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নতুনদের উৎসাহশূন্য করা সমীচীন হবে কি?
আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে- কোনো খাতেই মানুষ নতুনদের সহজে স্পেস দিতে চায় না। হোক সেটি ভালো কাজ- তাও। কোনো ভালো কাজে কাউকে অনুপ্রাণিত করার মতো সমাজে আজকাল লোক নেই বললেই চলে। বহু আগেই শুনেছি- বাঙালি গুণের কদর করতেও সব সময় কার্পণ্য করে। একটি ছবির মধ্যে যেরূপ লাইক, কমেন্ট, শেয়ার আসে সেরূপ ভালো কোনো কন্টেন্টে আসে না কেন? তার মানে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই সস্তা জিনিসকে লুফে নেয় কিন্তু ভালো জিনিসকে সহজে ভালোভাবে গ্রহণ করে না। শিল্প-সাহিত্য চর্চা করতে উন্নত মন ও মানস, উত্তম রুচিবোধ এবং যথেষ্ট শিক্ষার দরকার। এমন মানুষের সংখ্যা যুগে যুগেই কম। তার ওপর যদি ফেসবুকে লেখা প্রকাশ করায় নতুনদের অবজ্ঞা করা হয় তাহলে এ সংখ্যা দিনে দিনে আরো কমে যাবে। কথায় আছে ‘গাইতে গাইতে গায়েন, বাজাতে বাজাতে বায়েন’। ফেসবুকে চর্চা করতে করতেই তাদের লেখা একদিন ম্যাগাজিন, পত্রিকা, ব্লগ, ই-ম্যাগাজিন কিংবা বই আকারে কোথাও প্রকাশ হবে বলে আশা রাখি। তাদের মধ্য থেকেই বের হয়ে আসবে ভালো কবি-সাহিত্যিক- যারা একদিন জাতীয় পর্যায়ের লেখকদের সঙ্গে যুক্ত হবেন বলে আমার দৃঢ় প্রত্যয়।
যেটি প্রশ্ন আসতে পারে, তা হলো লেখার মান নিয়ে। এটি অত্যন্ত যৌক্তিক। এ ছাড়া বানান ভুল, বাক্য গঠনে ভুল, যতিচিহ্ন ব্যবহারে ভুল লক্ষ্য করা যায়। লেখার মান খারাপ বলেই নতুনদের লেখা ম্যাগাজিন কিংবা পত্রিকায় স্থান পায় না- এটি মিথ্যে নয়। আবার- পত্রিকায় প্রকাশ হয় না মানেই কি নতুনদের সব লেখা খারাপ? প্রশ্ন তো এটিও হতে পারে- পত্রিকায় প্রকাশিত সব লেখাই কি মানসম্পন্ন, সাহিত্য মানের? যাদের লেখা এখনো জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ হয় না, তাদের আদৌ তিরস্কার করা সঙ্গত নয়। আজ হয়নি একদিন হবে। কিন্তু তাদের হেয় করে নানা মন্তব্য দিয়ে উদ্যম নষ্ট করা কি ঠিক? যারা সত্যিকারের পাঠক তারা ঠিকই খোঁজে নিবেন কোনটি কবিতা আর কোনটি অ-কবিতা। তবে এটিও সত্য নিজে নিজে শুধু ফেসবুকে লিখে গেলে কোনোদিন বোঝা যাবে না কোনটি কবিতা আর কোনটি অ-কবিতা। আজীবন কি শুধু ফেসবুকেই লিখবেন? তাই নতুনরা ফেসবুকে চর্চার পাশাপাশি সাহিত্য সম্পাদকের কাছে লেখা পাঠানো দরকার, সাহিত্য সম্পাদকের হাত দিয়েও লেখা প্রকাশিত হওয়া দরকার। লেখা ভালো হলে অবশ্যই তারা প্রকাশ করবেন। তাহলে বোঝা যাবে তার কবিতা, গল্প হচ্ছে কিনা। শুধু ফেসবুকে সস্তা জনপ্রিয়তার চেষ্টা না করে সাহিত্য সম্পাদকের কাছেও লেখা পাঠান। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো পড়েন। ভালো লেখকের লেখাও পাঠ করেন- একথাগুলো নতুনদের জন্য বলছি। তবে হ্যাঁ, পত্রিকাগুলোরও বাধ্য-বাধকতা কিংবা সীমাবদ্ধতা আছে- এটি ভুলে গেলে চলবে না। আরেকটি বিষয়- সাহিত্যের কোনো সেন্সর বোর্ড নেই। কোনো কালে ছিলও না। থাকা উচিতও না।
যদি ভুল করে কোনো কালে সেটি হয়ও তবে তা হবে আত্মঘাতী। সাহিত্যের সেন্সর বোর্ড হলো কাল বা মহাকাল। কোনটি সাহিত্য, কোনটি সাাহিত্য নয় তা বলে দেবে সময়। সাহিত্য যেখানে অনন্ত পথের যাত্রী সেখানে সে নিজেই সব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে সামনে এগুনোর পরিষ্কার পথ বের করে নেবে। সেটি নির্ভর করে সময় ও পাঠকের ওপর। বর্তমান সময়ে পাঠক তৈরি করতে ফেসবুকের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই। তাই বর্তমানে খ্যাতিমান অনেক কবি-লেখকরাও এখন ফেসবুকে তার লেখা প্রকাশ করে থাকেন অধিকতর মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য। যারা পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়েন না, সাহিত্য পড়েন না, তারাও এখন কবিতা, গল্প পড়ছে ফেসবুকের কল্যাণে। লিটল ম্যাগাজিনগুলো সাহিত্যচর্চার মূল প্লাটফর্ম হলেও আমার মনে হয় বর্তমানে এর চেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে ফেসবুকে। সাহিত্যের প্রচার-প্রসার চাইলে ফেসবুককে গ্রহণ করাই অধিকতর উত্তম। সাহিত্য যেমন মানুষ লেখে, আবার এর পাঠকও মানুষ। পাঠক চাইলেই সাহিত্য টিকে থাকবে। এদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার আবুল ফজল তার ‘সাহিত্যের ভূমিকা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সাহিত্যের সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য, নব নব পথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুঃসাহসিক অভিযান সবকিছুই নির্ভর করছে পাঠক বা জনসাধারণের ওপর।’
তাই এ অভিযানে আমাদের সকলেরই সহনশীল হতে হবে। কবিতাণ্ডগল্প-প্রবন্ধ ফেসবুকে প্রকাশিত বলে তাচ্ছিল্য করে নতুনদের ভগ্নোদ্যম করা মোটেও উচিত নয়। কোন মাধ্যমে লেখা প্রকাশিত সেটির চেয়ে বিবেচ্য বিষয় হলো লেখার মান কেমন। কোনটি কবিতা কোনটি অ-কবিতা, কোনটি সাহিত্য কোনটি সাহিত্য নয় তা ছেড়ে দিতে হবে কালের ভেলায়। আজ যা পেছনে, সময়ের দাবির কাছে একদিন সেটিই সামনে আসতে পারে কাঙ্ক্ষিত গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।