ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রতন ও কালুর বন্ধুত্ব

শারমিন নাহার ঝর্ণা
রতন ও কালুর বন্ধুত্ব

সাদা সাদা মেঘ পুঞ্জ উড়ে যাচ্ছে অজানা পথে, খোলা আকাশের পানে চেয়ে রতন মুখখানা ভার করে বসে আছে। কাল থেকে কালুকে আর দেখতে পাবে না, সারা দিন কালুর সেবা করেই দিন কাটে রতনের। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে রতনের আর স্কুলে যাওয়া হয় না সারা দিন কালুর পেছনে দৌড়াদৌড়ি। রতনের গরুর নাম কালু চোখ দুটো সাদা ধবধবে গায়ের রং কালো মিচমিচে এজন্য রতন আদর করে কালু ডাকে। কালু বলে ডাকলে গরুটা হাম্বা হাম্বা ডাকে, রতন তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় গরুটা নীরবে চোখ বন্ধ করে রতনের আদর অনুভব করে। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব, রতনকে দেখতে না পেলে কালুও ছটফট করে। রতন কালুকে যখন ঘাস খাওয়ায় তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে কালু ঘাস খায় না। গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব কালুকে পছন্দ করেছেন এবার কোরবানি ঈদে গরুটাকে কোরবানির জন্য তিনি কিনেছেন। কালকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে রতনের মনটা ভীষণ খারাপ, রতন কালুকে কিছুতেই বিক্রি করবে না, কিন্তু বিক্রি না করলে উপায় নেই। বাবার চিকিৎসা করাতে হবে বাবার একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে রতনের চোখে লোনাজল গড়িয়ে পড়ে, হঠাৎ করে কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে কি হয়েছে বাবা এখানে বসে আছিস কেন? রতন চমকে ওঠে দেখতে পায় তার মা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদিস না বাবা মহান আল্লাহতালা সব সময় আমাদের পাশে আছেন ভালো কিছু করবেন। তিনি বিপদ দিয়েছেন তিনি উদ্ধার করবেন। দুজনের চোখের জলে আকাশ বাতাস যেন ভারি হয়ে যায়। রতনের মা চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করে, কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে রতনের সংসার চলে। কিন্তু শেষ সম্বল ছিল কালু সেটা এখন বিক্রি করতে হচ্ছে বাবার অসুস্থতার জন্য, আজকের দিনটা কালুকে মন ভরে আদর করবে, রতন কালুকে সুন্দর করে গোসল করিয়ে কচি ঘাস মুখে তুলে খাওয়ায় আর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কালু আহ্লাদে মাথা নাড়তে থাকে। রতনের চোখ থেকে টপটপ করে অজান্তে জল ঝরে অবিরত। পরদিন সকালে ষাট হাজার টাকা নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব রতনদের বাড়িতে আসেন। পরশুদিন ঈদ তাই আজকে গরুটাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। রতনের মা তোমার ছেলেকে বলো গরুটাকে আমাদের বাড়িতে একটু দিয়ে আসতে। আর এই যে ধরো ষাট হাজার টাকা ঈদের দুই তিনদিন পরই রতনের বাবাকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করবে। কালুকে নিয়ে রতন চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে রওনা হলো। সারা পথ কালুকে অপলকে দেখতে দেখতে রতনের যেন দেখার সাধ মেটে না। চেয়ারম্যানের গোয়াল ঘরে কালুকে বেঁধে রেখে পিছন দিকে না ফিরে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে আসে রতন। রাত গভীর হয় রতনের বুকে অজানা ব্যথা জাগে, কালুর জন্য দরদে বুকটা ফেটে যায় সে এক দৌড়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির গোয়াল ঘরে চলে যায় আর কালুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। কালু হাম্বা হাম্বা ডাকে, কিছুক্ষণ কালুকে আদর করে আবার বাড়িতে ফিরে যায় রতন। ঈদের দিন ভোর বেলা রতনদের বাড়িতে নামে শোকের ছায়া, রতনের বাবা চিরবিদায় নিলেন সুন্দর এই ধরণী থেকে, ঈদের এই খুশির দিনে আকাশে বাতাসে সহস্র খুশির ভীড়ে যেন বিষাদের ঢেউ খেলে। চেয়ারম্যান সাহেব এসে রতনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আজ থেকে তোমরা আমার পরিবারের সদস্য, আমার তো কোনো বোন নেই, আজ থেকেই স্বামীহারা বোনের সব দায়িত্ব আমি বুঝে নিলাম। রতন আর রতনের মা আমাবস্যায় যেন আশার আলো দেখতে পেল খুশিতে চোখে জলের ধারা নামলো। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন ঐদিন রাতে আমি দেখেছি রতনকে কালুর জন্য খুব কাঁদতে, এমন অকৃত্রিম পবিত্র ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা প্রিয় বস্তুকে কোরবানি দিতে বলেছেন। রতন যেহেতু এখন আমার পরিবারের সদস্য রতনের এই প্রিয় বস্তুর মহান ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করবেন। এই মহান ত্যাগ সবার জীবনে চির কল্যাণ বয়ে আনুক। রতন এখন থেকে লেখা পড়া করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। পবিত্র ঈদের এই খুশির দিনে চোখের জলে নয়, আনন্দের জোয়ারে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করো বলেই চেয়ারম্যান সাহেব রতনকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত