ঢাকা ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কথাসাহিত্যের রাজকন্যা সেলিনা হোসেন

এসডি সুব্রত
কথাসাহিত্যের রাজকন্যা সেলিনা হোসেন

বাংলা কথাসাহিত্যের রাজকন্যা সেলিনা হোসেন। তার রচিত বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রচিত উপন্যাস পড়ানো হয়। সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক, গবেষক এবং প্রাবন্ধিক।

কথা সাহিত্যের রাজকন্যা জলোচ্ছ্বাসের পরে জ্যোৎস্নায় সূর্য জ্বালা অনুভব করেছেন, হাঙর নদী গ্রেনেডের মুক্তির উপাখ্যানে মগ্ন চৈতন্যে শিস বাজিয়েছেন নিজেই তার যাপিত জীবনে। নীল ময়ূরের যৌবনের পদশব্দ ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই চাঁদবেনে কিংবা পোকা মাকড়ের ঘরবসতিতে ক্ষরণ দেখেছেন। কাঁটাতারে প্রজাপতি কিংবা খুন ও ভালোবাসার টানাপড়েনের মধ্যেও তিনি কালকেতু ও ফুল্লরাদের ভুলে যাননি, ভুলে যাননি প্রীতিলতাকেও। তার লেখার জগৎ এ দেশের মানুষ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে। তার উপন্যাসে তিনি বাংলার লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রসমূহকে নতুনভাবে এনেছেন। তার উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংকট। আমাদের অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় এক নতুনমাত্রা যোগ করেছে।

সেলিনা হোসেনের পৈতৃক নিবাস বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার হাজীরপাড়া গ্রামে। বাবা একে মোশাররফ হোসেন ছিলেন রাজশাহী রেশম শিল্প কারখানার পরিচালক। মা মরিয়মন্নেসা বকুল ছিলেন গৃহিণী।

ছেলেমেয়েরা কে কোথায় পড়াশুনা করবে তার সিদ্ধান্তও নিজেই নিতেন মা। সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে।

বাবার কর্মস্থল বগুড়ায় তার শৈশব কেটেছে। শৈশবে মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠেন। মাঠে ঘাটে, প্রান্তরে, নদীতে, ঘুরে বেড়ানো, গাছ বাওয়া, কখনও অনেক উচুঁ গাছে চড়ে বাবাকে দেখে বকা খাওয়ার ভয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের একটি। তারা যেখানে থাকতেন সেটা ছিলো রেশম চাষের এলাকা। বিশাল বিশাল তুতের বাগান। তার বাবা ছিলেন সেই অফিসের কর্মকর্তা। সেই এলাকার ভেতরে ছিলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসস্থান, ডাকবাংলো রেশমণ্ডকীট পোষার ঘর। স্কুল থেকে ফেরার পথে টিলায় উঠে পুলিশদের বন্দুকের গুলি থেকে বেরিয়ে আসা সিসা কুড়িয়ে হানিফের দোকান থেকে মুড়ি- মুড়কি, ছোট ছোট রঙিন লজেন্স নিয়ে চিবুতে চিবুতে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে বাড়ি ফেরার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ খুঁজে পেতেন। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ছি-বুড়ি ইত্যাদি একেকরকম খেলা খেলতেন একেকদিন। সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ফিরে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসতেন। তার বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী। ফলে বাবাকে ভাইবোনেরা খুব ভয় পেতেন। চার-পাঁচ বছর বয়সের ছোট বোন লাকির মৃত্যু তার বাবাকে একদম বদলে দেয়। ছোট বোনকে সুস্থ করার জন্য ভাইবোনদের সঙ্গে তিনিও ধানক্ষেতে গিয়ে শিশির ঝরিয়ে বাটি ভরে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এরপরও ছোট বোনকে হারাতে হলো। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে। সে সময় কাগজ-কলমে লেখার রেওয়াজ না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি সেøটে লিখতেন। সেøটে শিক্ষক তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন লিখতে দিতেন এবং সেগুলো ঠিক হলো কি না একজন আরেকজনকে যাচাই করতে দিতেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি বগুড়ায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাবার বদলির চাকরির কারণে এরপর তারা রাজশাহীতে চলে আসেন। এখানে এসে রাজশাহীর পিএন গার্লস স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর রাজশাহী মহিলা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন এই কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার লেখালেখির শুরু ১৯৬৪ বা ১৯৬৫ সালের দিকে। রাজশাহী কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী আন্তঃবিভাগীয় সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তিনি এই প্রতিযোগিতায় গল্প লিখে প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়ানশিপ গোল্ড মেডেল পান। বিষয়গুলো ছিল বাংলা ও ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, ছোট গল্প লেখা, ইংরেজিতে নির্ধারিত বক্তৃতা। এ বছরই রাজশাহী মহিলা কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শিক্ষকরা শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেন। তারা সেলিনা হোসেনকে ‘মেহেরজান’-এর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত করেন।

এটা ছিল তার জীবনের প্রথম অভিনয়। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকার ‘পূবালী’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। ড. মাযহারুল ইসলাম, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় ‘উত্তর অন্বেষা’, ‘পূর্বমেঘ’ এবং ঢাকার ‘মাহে নও’, ‘পূবালী’ পত্রিকাতে তার লেখা ছাপা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে তিনি রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ছাত্রী ইউনিয়নে (মতিয়া গ্রুপে) যোগ দেন। দলের পক্ষে সভা-মিছিলে অংশ নেন। তিনি মন্নুজান হলের ছাত্রী সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের দু’বার সহকারী কমনরুম সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ বছরে একবার সাহিত্য প্রতিযোগিতার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। তিনি ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করাসহ নাটকে অভিনয় করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় চারবার চ্যাম্পিয়ন হন। সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলা একাডেমমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে দুটো চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি পান। একটি বাংলা একাডেমিতে অন্যটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে সরকারি কলেজের জন্য।

বাংলা একাডেমির চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন প্রমুখ। তিনি বাংলা একাডেমিতে গবেষণা সহকারী পদের জন্য ইন্টারভিউ দেন। একই দিনে একই সময়ে সেখানে পান্ডুলিপি পাঠক পদেও ইন্টারভিউ হচ্ছিল। ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাকে বললেন, ‘পুঁথি পড়তে পার?’ তিনি বলেন ‘পারি।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক সেলিনার দিকে তাকিয়ে চারশত বছর আগের পান্ডুলিপি ঠেলে দিয়ে বললেন ‘পড়ো।’ সেলিনা সুর করে পুঁথি পড়ে শোনান। কারণ এমএ ক্লাসে তাদের পুরনো পান্ডুলিপি পাঠ করা শেখানো হতো। ভীষণ রাগী পন্ডিত মানুষ ড. মুহম্মদ এনামুল হক তার নির্ভুল পাঠ শুনে এমন একটি হাসি দেন যা সেলিনা কখনো ভুলেননি। তিনি বিশ্বাস করেন প্রবন্ধটিও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরকারি কলেজের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বোর্ডে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে পান। কলেজের চাকরিটাও তার হয়। তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় সিলেটের এমসি কলেজে। সে সময়ে তার ছোট মেয়ে লারার বয়স দু’মাস থাকায় তিনি কলেজের চাকরিটি গ্রহণ না করে সরকারি কলেজের থেকে অর্ধেক বেতনে বাংলা একাডেমির চাকরিটিতে যোগদান করেন।

বাংলা সাহিত্যের ধারায় সেলিনা হোসেন সত্যিকারে নির্মাণ করেছেন নিজস্ব একটা ভুবন। সাহিত্যিক হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তিনি কখনো ভুলে যাননি। ফলে তার সব রচনার পশ্চাতেই একটা সামাজিক অঙ্গীকার, একটা প্রগতিশীল ভাবনা থাকে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত