ঘামে ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে লিজা। কড়া রোদ মাথায় নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখে আজ রোগীদের তেমন ভিড় নেই। লিজা রোগী হয়ে কিংবা কোনো চিকিৎসার জন্য আজ এখানে আসেনি। সে এসেছে তার বড় ভাই মাসুমের কাছে। মাসুম এই হাসপাতালের একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। লাশ পৌঁছে দিয়ে আসার দায়িত্বের পাশাপাশি সে ডাক্তারদের কাছে রোগীর সিরিয়াল দেয়ার কাজেও নিজের যোগ্যতা দেখিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সুনজর কেড়েছে। ভালো মাইনে পায়।
লিজার আগমন দেখে মাসুম যে বিরক্ত, সেটা লিজা টের পেয়েছে। তবুও না বোঝার ভান করে রইল। এছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই। দুঃসময়ে অপমান গায়ে মাখতে নেই। লিজার এখন দুঃসময় চলছে। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার এখন আর সহ্য করা যায় না। সবে মাত্র বিয়ের আট মাস শেষ হলো। এই আট মাসে শাশুড়ির অনেক অত্যাচার সয়ে গেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে লিজারা সোহেলদের মতো সচ্ছল নয়। হয়তো এই সুযোগে রাশেদা বেগম পুত্র সোহেলের স্ত্রী লিজাকে বাপের বাড়ি থেকে এটা সেটা আনার জন্য সব সময় চাপের মধ্যে রাখেন। লিজার গরিব বাবা মেয়ের সেসব সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পান না। মাসুম যদিও বোনের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতে পারে। কিন্তু সে এখন আর এসব নিয়ে ভাবে না। কারণ বিয়ের পর মাসুম স্ত্রী সুলতানাকে নিয়ে শহরের ভাড়া বাসায় উঠে গেছে। পরিবারের দায়িত্ব পালন করাটা তার জন্য এখন আর জরুরী নয়।
লিজাকে দেখে মাসুম নিরস কণ্ঠে বলল, ‘কেন এসেছিস?’ নত কণ্ঠে লিজা জবাব দেয়, ‘বড় বিপদে পড়েছি ভাইয়া। আমার শাশুড়ি আবদার করেছে এবার কোরবানির ঈদে একটা ছাগলের। বিয়ের পর তো এটাই আমার প্রথম কোরবানির ঈদ। এ সময়ে বাপের বাড়ি থেকে একটা ছাগল দেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছে। তা না হলে নাকি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সমাজে মুখ দেখাতে পারেনা। আমাকে রক্ষা কর ভাইয়া।’ লিজার কথা শুনে গা জ্বলে ওঠে মাসুমের। তেজী সুরে বলল, ‘এসব কিছু শোনাতে এখানে আর আসিস না তো। একটা ছাগলের দাম কত, তুই জানিস?’ লিজা চুপ হয়ে গেল। কিন্তু চুপ হলে তাকে চলবে না। মাসুমের কথায় লিজা আবার বলল, ‘তুই পারবি ভাইয়া। এখানে তো ভালোই পয়সা আয় করিস। তাছাড়া আমি তো তোর আপন বোন, তাই না?’
মাসুম বিরক্তের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়ে বলল, ‘প্লিজ লিজা, চলে যায় এসব নাটক করিস না। ভালো লাগে না।’ লিজার চোখে পানি চলে এলো। ভাই তার এতটা নির্দয়, ভাবতেই পারছে না। অথচ বিয়ের আগে সে কত পরিবারকেন্দ্রিক ছিল। স্ত্রীকে যে ভাড়া বাসায় রেখে মহারানী সাজিয়ে রেখেছে, সেসব চিত্র মাঝে মাঝে ফেসবুকে লিজা দেখে। তখন তার অভাবের কষ্ট থাকে না। বিষন্ন মন নিয়ে লিজা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে।
২.
রাতে সোহেল লিজাকে বলল, ‘তোমার বাবাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। আগামী পরশু একটা ছাগল নিয়ে এ বাড়িতে আসবেন। খবরদার আমার মাকে ভুলেও বুঝতে দিওনা এই ছাগল কেনার টাকা আমি দিয়েছি। তুমি আর কখনো মাসুম ভাইয়ের কাছে হাত পাততে যাবে না।’
সোহেলের কথা শুনে লিজা আকাশ থেকে পড়ল। সোহেল কীভাবে জানে যে সে ভাইয়ের কাছে হাসপাতালে গিয়েছে। লিজাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে বলে সোহেল বলল, ‘আমার কাছে আড়াল করতে চাচ্ছ কেন? আমি সব জেনেছি। হাসপাতালে তোমাকে যে মাসুম ভাই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমার বন্ধু জয় আমাকে সে গল্প বলেছে। জয়ের স্ত্রী ওর বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল। ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় তোমাদের ভাই বোনের কথোপকথন সব শুনেছে।’
লিজা কোনো কথা বলতে পারছে না। তার কান্না আসছে। সোহেল বলল, ‘জয়ের কাছে সব জেনে আমি সঙ্গে সঙ্গে তোমার বাবার সাথে যোগাযোগ করে টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে আমার মা যা করছেন, সেটা অনুচিত জানি। কিন্তু আমি তো আর সন্তান হয় মাকে কিছু বলতে পারি না, তাই তুমি ধৈর্য ধরে সব সয়ে যাও।’
সোহেলের কথায় লিজার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। সাংসারিক ঝামেলার কারণে মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে যে পরিমাণ চোখের পানি মুছে ফেলে, সে পানি যদি জমা করা যেত, তবে পৃথিবীতে আরো একটি সাগরের জন্ম হতো। সে সাগরের নাম হতো- অশ্রু সাগর। মেয়েদের জীবনের সব ছন্দ হারিয়ে যেত সেই সাগরের গহীন স্রোতে।