ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমি গাছ লাগাতে এসেছি

আবু হাসান শাহরিয়ার
আমি গাছ লাগাতে এসেছি

অগণন সাধারণ মানুষের প্রতি যার নিরঙ্কুশ পক্ষপাত, যিনি কোনো দল বা গোষ্ঠীর হয়ে কথা বলেন না তিনি আবু হাসান শাহরিয়ার। ‘গাছ তো কাটাই যায়; আমি গাছ লাগাতে এসেছি/ যে আমাকে ঘৃণা করে, পত্রপুষ্পে তাকেও সাজাব/ জয়-পরাজয়ে লেখা যুদ্ধশেষে শোষক বদল হয় শুধু/ নতুন শোকের গল্প শুরু হয় যুদ্ধাহত বঞ্চনার পাড়ে/ আমি কোনো বিজয় দেখিনি/ আমি আজো বিজয় দেখিনি ।’

(অধরা বিজয় /আবু হাসান শাহরিয়ার) স্বস্তির বিষয় এই যে, দেরিতে হলেও কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় আবু হাসান শাহরিয়ারের নামটা যুক্ত হয়েছে। যেটা আরো আগেই তার পাওয়ার কথা ছিল। ২৫ জুন ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীতে জন্ম আবু হাসান শাহরিয়ারের।

পৈতৃকনিবাস সিরাজগঞ্জ জেলার কড্ডাকৃষ্ণপুর। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে এক বছর ডাক্তারি পড়েন। সেখানে নিজেকে মেলাতে না পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। সেখানেও নিজেকে মেলাতে পারেননি। অধ্যয়ন অসম্পূর্ণ রেখে ৩ বছর পরই সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা থেকে। পরিপূণূরূপে নিবেদিত হয়েছেন কবিতার কাছে।

পেশা হিসেবে অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের মতোই বেছে নিয়েছেন সাংবদিকতাকে। বিভিন্ন পত্রিকার ফিচার সম্পাদক, উপসম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বপালন করে সর্বশেষ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দৈনিক আমাদের সময়ে। তবে নব্বইয়ের দশকে ‘দৈনিক মুক্তকণ্ঠ’র ‘খোলা জানালা’ নামের একটি সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

পত্রিকা ছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতাসমগ্র’, ‘জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত শ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘প্রামাণ্য শামসুর রাহমান’, ‘দেশপ্রেমের কবিতা’, ‘বিরহের কবিতা’, ‘জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা’, ‘রূপসী বাংলা (জীবনানন্দকৃত পাণ্ডুলিপি সংস্করণ), ‘বনলতা সেন’, ‘ছোটগল্প ৯৮’, ‘কবিদের লেখা প্রেমপত্র’ এবং ‘জীবনানন্দ দাশ : মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার’। তার প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হলো- ‘উদোরপিণ্ডি’, ‘কালের কবিতা কালান্তরের কবিতা’, ‘কবিতার প্রান্তকথা’, ‘কবিতাণ্ডঅকবিতাণ্ডঅল্পকবিতা’ এবং ‘কবিতার বীজতলা’। লিখেছেন ‘অর্ধসত্য’, ‘সমাত্মজীবনী : মিডিয়া ও প্রতিমিডিয়া’, ‘পায়ে পায়ে’, ‘যাইত্যাছি যাইত্যাছি কই যাইত্যাছি জানি না’, ‘নৈঃশব্দের ডাকঘর’ (মৃণাল বসুচৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে), এবং ‘আমরা একসঙ্গে হেঁটেছিলাম’।

‘আসমানী সাবান’ নামে একটি ছোটগল্পের বই আছে তাঁর। আছে ‘পায়ে নূপুর’, ‘ভরদুপুরে অনেক দূরে’, এবং ‘আয়রে আমার ছেলেবেলা’ নামে কিশোর কাব্যও। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তিনি কবি। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’, ‘অব্যর্থ আঙুল’, ‘তোমার কাছে যাই না, তবে যাবো’, ‘একলব্যের পুনরুত্থান’, ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’, ‘এ বছর পাখিবন্যা হবে’, ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’, ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’, ‘বালিকা আশ্রম’, ‘আড়াই অক্ষর’, ‘তোমাদের কাচের শহরে’, ‘কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়’ এবং ‘আবু হাসান শাহরিয়ারের প্রেমের কবিতা’ ও ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলনগ্রন্থটি বহুল পাঠকপ্রিয় ও বহুসংস্করণে ঋদ্ধ। যিনি কবিতাকে আপনমনের সবচাইতে মহার্ঘ্য সত্তা হিসেবে ধারণ করেন, প্রকৃত পাঠক যার কবিতায় ভাষাশিল্পের অকপট আনন্দের সন্ধান পান; তিনিই যথার্থ কবি। স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবে অনেক কবিই কবি নয়, কবিতার কর্মী শুধুই। কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলে পাঠকের মনেও স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব অনুভূত হয়। তার কবিতায় পাঠক অনায়াসে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার।

১৯৮৬ সালে ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’ করতে বেরিয়ে পড়েন কবি। লেখেন, ‘নৌকা থামাও। ঝাঁপ দেবো কালো জলে/ফেলে আসা পথ সাঁতারেই দেবো পাড়ি।/ তোমাদের গড়া জীবনের কোলাহলে/ তাকালেই দেখি মৃত মুখ সারি-সারি।’ স্বাভাবিক মসৃণ পথে না গিয়ে নিজের তৈরি স্বতন্ত্র পথেই তিনি কাব্যসাধনা করতে চেয়েছেন। তবে ঐতিহ্যকে একেবারে বাদ দিয়ে নয়, বরং পুরোনোকে নতুনভাবে গড়ে। সেরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ‘খনন’ কবিতায় : ‘নতুন পুরানো হয়ে যায়,/ পুরোনো নতুন হয়ে আসে। / মানুষ বদলে যেতে যেতে / পেছনে তাকাতে ভালোবাসে।’ ভালোবাসে বলেই সে সামনের দিকে যেমন এগোয়, তেমনি এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হিসেবে পুরোন পথ ও প্রথাকে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় মনে করে না। ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ কাব্যের শিরোনাম কবিতাটি এক অসামান্য নিবেদন, যেখানে কবি সরলতা দেখাতে গিয়ে ঠকে যাওয়া ব্যাধপুত্র একলব্যের পরিবর্তিত নতুনরূপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যান কবিতারাজ্যের অগ্রজদের উত্থানসভায়। তাইতো কবি বলেন উঠেন.... এসেছি একাকী আমি একলব্য। /দাঁড়িয়েছি অগ্রজের উত্থানসভায়।/দাও দীক্ষা। শব্দস্বর তুলে দাও ব্যগ্র করতলে।/ যুদ্ধে যাই।/ লক্ষ্যভেদী শরে বিদ্ধ করি যত কূপমণ্ডূকতা।

/কপটতা। /ধ্বংস করি জড়ভরতের যত দিনরাত্রি।/সাম্রাজ্যবিস্তার।/কিন্তু অগ্রজেরা তো ‘দ্রোণাচার্য। সাড়াশব্দহীন। /প্রাচীন কৌশলের পুরাণে উড্ডীন।’ কবির কবিতায় অবলীলায় উঠে আসে দেশের কথা। দেশকে ভালোবাসার কথা। দেশের বৈশিষ্ট্যৈর কথা। তাইতো কবি তাঁর বাঙলাদেশ কবিতায় লিখেছেন.... বাঙলাদেশ বড়ো শান্ত মেয়ে/ কারও সঙ্গে খুনসুটি করে না কখনও/ নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালোবাসে।/ কেউ ওকে চুল টেনে ঢিল ছুড়ে বিরক্ত কোরো না।/ অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে/ ভূত সেজে ভয় দেখিও না।’

কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় প্রেম প্রকাশিত হয়েছে সাবলীলভাবে এক স্বতন্ত্র মহিমায়, আবেগের পরম মায়ায়। তুলাদণ্ড কবিতায় কবির প্রেমের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে ঠিক এভাবে.... ‘তোমার চোখের চেয়ে বেশি নীল অন্য কোনো আকাশ ছিল না/ যেখানে উড়াল দিতে পারি/ তোমার স্পর্শের চেয়ে সুগভীর অন্য কোনও সমুদ্র ছিল না/ যেখানে তলিয়ে যেতে পারি।’

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত