ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আষাঢ়ের দুপুর

ফারুক আহম্মেদ জীবন
আষাঢ়ের দুপুর

ঝন্টু, মন্টু, আর পিন্টু তিন বন্ধু। একইসাথে ওরা প্রাইমারিতে ক্লাস ফাইভে পড়ে। একি গাঁয়ের এক পাড়াতেই পাশাপাশি ওদের বাড়ি। আর তাই এক সাথেই ওরা তিন বন্ধু স্কুলে যাওয়া আসা করে। ওরা একজন থেকে আরেকজন বয়সে খুব বেশি ছোট-বড় না। তিনজনের বয়স নয়, দশ, এগারো এরইমধ্যে হবে। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব তিনজনের। এখন আষাঢ় মাস বর্ষাঋতু চলছে। আজ তাই ওদের স্কুল বর্ষার ছুটিতে এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ দিয়েছে। স্কুল বন্ধের ঘোষণা শুনে ওদের তিন বন্ধুর মনে যেন আনন্দের সীমা নেই। কিছুক্ষণ আগে বেশ ভারি বর্ষা হয়েছে। এখনো হাল্কা টিপ-টিপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। ওরা তিন বন্ধু হাল্কা বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরছে। বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে আর তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে মনের খুশিতে বৃষ্টির দিনের মিষ্টি ছড়া কাটছে আর নিচে জমে থাকা জলে পা মেরে জল ছিটাচ্ছে। সে ছড়াটি হলো.... আজ যে স্কুল মোদের ছুটি/চল যাই-রে সহপাঠী,/বর্ষার জলে ভিজে আজ সব/কদম পুষ্প খুঁটি।/চল ব্যাঙ কুতকুত খেলি আজকে/মেখে কাদা মাটি, /আজ সব ঘোলা জলে পা- ছুড়বো / মাটির গর্ত কাটি।/এই-না বাদল ঝরা বেলা/ কাটাই হৈচৈ করে, / তুলে রেখে পড়ার বই সব ঘরে টঙের পরে।/আজকে ধরবো টাকি কই মাছ/ধরবো টেংরা, পুঁটি, / ঝিলের জলে খেলবো আজ সব/ হাসবো কুটিকুটি। বর্ষার ঢলে ঝিলে মাছ আজ/ লাগছে ভীষণ গাবা, /আজ মাছ ধরে আনবো নীড়ে/খাবে মাছ -মা, বাবা।

একসময় যখন ওরা সব বাড়ি পৌঁছালো। বাইরের দোলজখানায় বসে ছিল ঝন্টুর আশি বছরের বৃদ্ধ দাদু তমেজ মোড়ল। ওদের ছড়া কাটা শুনে ডেকে বললো, কি ব্যাপার দাদু ভাই। আজ তোমাদের বড্ড খুশি মনে হচ্ছে। দাদুর কথা শুনে ওরা তিন বন্ধু দোলজখানায় এগিয়ে গেলো। তারপর ঝন্টু বললো, বা-রে খুশি হবো না দাদু? জানো, আজ আমাদের স্কুল বর্ষার জন্য বন্ধ দিয়েছে। তমেজ মোড়ল বললো, ও তাই বুঝি সব মনের আনন্দে বৃষ্টির দিনের মিষ্টি ছড়া কাটছিলে?

মন্টু বললো, হুম দাদু, আমরা এখন বৃষ্টির জলে ভিজবো। কদম গাছ থেকে জলে ভেজা কদম্ব ফুল ছিঁড়বো। আহা! কদম ফুলের কি সুন্দর মিষ্টি প্রাণ জুড়ানো সুবাস। আর শুভ্র সাজানো পাপড়িগুলো বর্ষার জলের ছোঁয়া পেয়ে যেনো সজীব প্রাণবন্ত হয়ে ঘ্রাণ ছড়িয়ে হাসে। আরো কতো রকম খেলা করবো। মাটিতে গর্ত কেটে পা-দিয়ে জল ঘোলা করে, কাদা-মাটি খেলবো। তারপর আমরা সবাই ঝিলের জলে মাছ ধরতে যাবো। তমেজ মোড়ল বললো, মাছ ধরতে যে যাবে দাদুভাই-রা। কোথায় মাছ ধরবে? এমন ধুলো উড়া বর্ষাঋতুতে কি আর আগেকার/ আমাদের সময়ের মতো বিল-খালে জলের স্রোতের ঢল নামে?/ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস তুলে/ বললো। আগেকার সেসব দিন যে হারিয়ে গেছে/ দাদু ভাইয়েরা। কতো মধুর ছিলো আমাদের ছোটবেলার সেসব দিন গুলো। এখন আর আগের মতো তেমন মুষলধারে বর্ষাও নামে না, বর্ষার জল ঢালু বেয়ে কুলকুল শব্দে স্রোত বয়েও চলে না। সে-সব হারানো দিনের কথা যদি তোমাদের সাথে বলি দাদু ভাইয়েরা। তবে তোমরা যে সব আষাঢ়ে গল্প ভাববে। আষাঢ় শ্রাবণ মাস আসলে যে, কতো মজা করতাম আমরা। দাদুর কথা শুনে ওরা তিনজন দোলজখানার আড়ার উপর থেকে গামছা পেড়ে। গামছা দিয়ে মাথা মুছে দুপুরের নাওয়া-খাওয়া ভুলে দাদুর কাছে জড়ো হয়ে বসলো গল্প শোনার জন্য। পিন্টু বললো, আজ তাহলে দাদু তোমার ছোট- বেলার বর্ষাকালের গল্প শুনবো। বলো তো শুনি... কেমন মজার ছিল তোমাদের বর্ষাকাল? দাদু বললো সত্যি, সত্যি গল্প শুনবে দাদু ভাই তোমরা? তাহলে বলছি শোনো, তারপর কল্পনায় বলতে লাগল। আমাদের সময় বর্ষাঋতু আষাঢ় শ্রাবণ মাস আসলে। দিনের বেলা যখন আকাশে মেঘ জমে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামতো। আমরা পাড়ার ছেলে-মেয়েরা সব হৈ-হুল্লোড় করে বৃষ্টির জলে ভিজে আনন্দ করতাম। আরো নানা রকম খেলা করতাম।

আকাশ থেকে বৃষ্টির জলের সাথে বরফ খন্ড শিল পড়তো। আমরা দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি করে সেসব শিল খুঁটে খেতাম। জানো দাদু ভাইয়েরা, বৃষ্টি নামা দেখলেই আমার মা চলে যেতো রান্না ঘরে। গিয়ে নানা রকম পিঠা তৈরি করতো। শালকেলি ধানের খই ভাজতো, মুড়ি ভাজতো। তারপর ঢেঁকিতে কুটা ছুলার যে ছাতু, সেই ছাতু বানানো থাকতো ঘরে। মা খেজুরের গুড় দিয়ে সেসব আমাদের বসিয়ে খেতে দিতো আহা! কি মজা যে সেসব খেতে। দোলজখানায় দাদু বসে পায়ের উপর ঘসে টাকুর ঘুরিয়ে কুশটা মানে পাটের চিকন সুতা কাটতো দড়া-দড়ি তৈরি করার জন্য। তখন, ঝমঝমিয়ে বিরামহীনভাবে কলসে ঢেলার মতো রাত-দিন বৃষ্টি হতো। খালবিল পুকুর-ডোবা সব এক রাতে প্রায় তলিয়ে যেতো। সকালবেলা আমরা যখন ঘুম থেকে উঠতাম। দেখতাম মাঠ-ঘাট সব জলে তলিয়ে গেছে। গাঁয়ের রাস্তার উপর দিয়ে এপাশের জল ওপাশে যাওয়া আসা করছে। বাড়ির উঠানে জল চলে আসছে। আর সে জলে মাছ খেলা করছে। আমরা একদিন এমনি এক গুঁড়িগুঁড়ি বর্ষার জলে খেলা করছি। এমন সময় দেখি, একটা দেশী মাগুর উঠানের উপর চলবল চলবল করতে করতে ডিম ডিম জলের স্রোতের সাথে চলে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে চেপে ধরলাম। ধরার পর সেকি আনন্দ আমার! পিন্টু বললো, তোমার হাতে কাঁটা মারলো না দাদু? দাদু হেসে বললো, না দাদু ভাই আমি মাছ ধরার সব কৌশল আমার বাবার কাছ থেকে আগেই শিখেছিলাম।

তারপর আবার বলা ধরলো জানো দাদু ভাইয়েরা, বর্ষার সে জল উঠান থেকে পুকুর ডোবা খালবিল কাণায় কাণায় ভরে যেতো। যেদিকে তাকাতাম চারিদিক দেখতাম জলে থৈথৈ করছে। জানো, সেকি আনন্দ করতাম আমরা? এক পুকুর ডোবার মাছ জলের স্রোতে ভেসে আরেক পুকুর ডোবায় চলে যেতো। খাল বেয়ে বিলে যেতো। আমার বাবা তো বৃষ্টির জলে ভিজে তুলুল স্রোতের মুখে খ্যাপলা জাল ফেলে বড় বড় রুই কাতলা মাছ ধরতো। আমিও আমার বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম। স্রোতের মুখে জলে মাছ সেকি লাফালাফি করতো। ঘুনী পেতে রাখতো হাল্কা স্রোতের মুখে। তাতে নানান রকম হরকরা ছোট-ছোট মায়া, ঝাইয়া, পুঁটি, পাকাল, গুতেল, গোচি, টাকি এসব মাছে ভরে যেতো। বাবার সাথে মাছ নিয়ে বাড়ি এলে। সে মাছ মা বটিতে কুটে ঝোল করতো। আহা! গরম ভাতের সাথে জ্যান্ত মাছের ঝোল, খেতে সে -কি যে মজা লাগতো। তখন শুধু আমাদের বাড়িতে না, দাদু ভাইয়েরা। গাঁয়ের প্রায় সবার বাড়িতেই মাছে ভরে যেতো। শুধু মাছ আর মাছ। মাছ ঝোল, মাছ চচ্চড়ি। বড় রুই মাছের মাথার মুড়িঘণ্ট। আহা! সেসব দিনের কথা এখনো মনে উঠলে মন চায় ফিরে যাই, আবার সেই শৈশবে। আমরা পাড়ার একবয়সি ছেলেরা কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সেই ভেলার পর চড়ে জলে ঘুরতাম। আবার সেই বর্ষার জল স্রোতে নিচে নদীতে নেমে গেলে। কই মাছগুলো বিল থেকে ওঠে দূর্বাঘাসের উপর দিয়ে কানি হেঁটে উপরে চইচই জমে থাকা জমিতে উঠতো। টাকি মাছ গুলো উঠে বিলের উপর ফসলি জমিতে লাফিয়ে বেড়াতো। সেসব মাছ আমরা ধরতাম। এরকম বর্ষার দিনে আমরা সব জটলা হয়ে বসতাম দোলজখানায়। দাদুর কাছে গল্প শোনার জন্য।

দাদু যে কতো রকম হাসির গল্প বলতো। আমাদের তো হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যেতো। এক-বিগেত এক বুদ্ধিমান ছেলের গল্প। সাত ভাই, সাত রানীর গল্প। শিয়াল বেঁজির বন্ধুত্বের গল্প। তারপর, রাজপুত্রের ডানাওয়ালা পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে পাতালপুরী রাক্ষসের দেশে গিয়ে সোনার কাঠি, রূপার কাঠি, দিয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে রাক্ষসদের মেরে রাজকন্যার মুক্ত করার গল্প। বাব্বাহ! ইয়া বড় বড় দাঁত ওয়ালা রাক্ষসের গল্প যখন বলতো না দাদু। কি-যে ভয় লাগতো। ভয়ে তো আমাদের গলা বুক শুকিয়ে হাড় হয়ে যেতো। আমাদের সবার ভয় পেতে দেখে দাদু শুধু হাসতো। শেষে আমাদের ভয় ভাঙ্গানোর জন্য দাদু, বলতো, আরে দাদুরা এসব তো সত্যি না, সব মিথ্যে গল্প। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে ওসব রাক্ষস বলতে কিছু নেই। তারপর দাদু বললো, জানো, দাদু ভাইয়েরা এখন তো তোমরা যেসব গান শোনো, এসবে তো জ্ঞান নেই কোনো প্রাণ নেই। আমাদের সময় সন্ধ্যা রাতে পাড়ায় গানের আসর বসতো। কতো জ্ঞানের কথা থাকতো সেসব গানে।

ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি, জারি সারি গান বাউলগান, মুর্শিদী গান, আমরা তো সব মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তারপর কোনো কোনো সময় বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর ছোট বেলার গল্প বলতো দাদু। কীভাবে সে মায়ের আদেশ মতো সত্য বলে ডাকাত দলের সর্দারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। বায়েজিদ বোস্তামীর মাতৃভক্তির গল্প। কীভাবে সে তার অসুস্থ মায়ের শিহরের কাছে জলের গ্লাস নিয়ে মায়ের ঘুম ভাঙার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিল। যে জন্য তারা আজ সব আল্লার প্রিয় বান্দা মহামানব আউলিয়া হয়েছে। তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো। এখন কেউ তাদের মতো সত্য কথাও বলে না। মা-বাবাকে তেমন ভক্তি শ্রদ্ধা সেবা যত্নও করে না।

এমন সময় ঝন্টুর মা এসে ঝন্টুদের ওর দাদুর কাছে গল্প শোনা দেখে হেসে বললো, ঝন্টু তুমি স্কুল থেকে এসে দাদুর কাছে তাহলে গল্প শুনতে বসেছ? তোমার আব্বু তোমাকে ডাকছে। কি বলে শোনো গিয়ে। আর, আমার রান্না হয়ে গেছে। যাও, তোমার আব্বুর কথা শুনে, গোসল করে এসে তোমার আব্বু আর তোমার দাদুর সাথে একসঙ্গে বসে খেয়ে নাও। ঝন্টু, ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ঠিক আছে যাচ্ছি আম্মু।

তারপর দাদুকে উদ্দেশ্য করে বললো, সত্যি দাদু তোমাদের ছোট বেলাটা সত্যিই অনেক মজার ছিল। মন্টু, পিন্টুর দিকে তাকিয়ে বললো, কি ঠিক বলেছি না মিন্টু, পিন্টু? মিন্টু, পিন্টু বললো, একদম ঠিক বলেছিস ঝন্টু। তারপর ঝন্টু বললো, চল আজ তাহলে আমরা যাই। গোসল করে খাওয়া-দাওয়া করে নিই। অন্য একদিন আবার আমরা দাদুর গল্প শুনবো..। মিন্টু, পিন্টু বললো হুম চল আজ যাই। তারপর দাদুকে বলে মিন্টু, পিন্টু, যে যার বাড়িতে চলে গেলো। আর ঝন্টু দোলজখানা থেকে নেমে ওর আব্বুর সাথে কথা বলে। তারপর গোসল করে দুপুরের খাবার খেতে বসল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত