ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তবুও সুখী

জোবায়ের রাজু
তবুও সুখী

বাহিরে একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই কখন থেকে রান্নার কাজে ব্যস্ত পপি। বিরাম নেই একফোঁটাও। আজকে তানি আসবে। ভালো ভালো কয়েক পদের খাবারের পাশাপাশি থাকবে তানির প্রিয় টমেটো ভর্তা। এই খাবারের প্রতি তানির আগ্রহ বেশি। আজ তানি আসবে, একথা পরশুদিন সুমনকে জানাতেই সুমন বাজার সদাই করেছে। মাছ, মোরগসহ নানা জাতের সবজি কিনলেও গরুর গোশত কেনার সামর্থ্য হয়নি সুমনের। গরুর গোশতের অবিশ্বাস্য দামে সুমন সেটা কেনার সাহস পায়নি। পপিও স্বামীকে আর জোর করেনি। যদিও সে জানে গরুর গোশত তানির খুব একটা পছন্দ না।

টমেটো ভর্তা তৈরি করতে করতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। তানির ফোন ভেবে পপি দৌড়ে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সুমনের কল। ওপাশ থেকে সুমন জানায় দুপুরে সে আজ বাসায় আসতে পারবে না। মালিক তাকে নিয়ে কুমিল্লা যাবে ব্যবসার কাজে। ফিরতে রাত হবে।

শুনে পপির মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়ে টমেটো ভর্তা প্রস্তুতে মনোযোগী হতে গিয়ে অতীতের অনেক স্মৃতি মনে পড়ল। বনেদি ঘরের মেয়ে সে। অথচ সুমনের মতো দরিদ্র ঘরের ছেলেকে ভালোবেসে এক কাপড়ে চলে এলো দুই বছর আগে। এছাড়া উপায় ছিল না। বাবা-মা জানিয়ে দিয়েছেন সুমন তাদের যোগ্য নয়। তাকে ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু পপির পক্ষে সুমনকে ত্যাগ করা সম্ভব নয় বলে একদিন সুমনের ঘরে চলে আসতে বাধ্য হয় নিজের বাবার রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি ছেড়ে।

এখানে এসে পপি দেখে সুমনদের মানবতার জীবনযাপনের নমুনা। বেশ দরিদ্র তারা। যদিও সুমনের বাবা-মা প্রথমেই মেনে নিয়েছেন পপিকে। কিন্তু পপির পরিবারের কেউ একবারের জন্যও তার খবর নেয়াটা জরুরি মনে করেনি। ফেসবুকে পপি ছোট বোন তানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। তানি যে তাকে খুব একটা পছন্দ করে না, পপি এসব বুঝত তানির মেসেজের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। কিন্তু পরিবারের জন্য সব সময় তার বুকে আগুন জ্বলত বলে তানির একধরনের অবহেলাকে গায়ে না মেখে বরং যোগাযোগটা রাখত। প্রায়ই সে তানিকে এখানে আসার অনুরোধ করত আর তানির একধরনের অনীহা টের পেত।

অবশেষে অনেক আবদারের পর তানিকে রাজি করানো গেছে। শনিবার সে পপির শ্বশুরবাড়িতে আসবে বলে কথা দিয়েছে। তবে বাবা-মা সেটা জানবে না, জানলে তার এখানে আসা হবে না।

আজ সেই শনিবার। দুপুরে তানি এলো। বৃষ্টিতে বেশ সমস্যা হয়েছে বটে। অনেকদিন পরে বোনকে দেখে অঘোরে কাঁদে পপি। এতে অবশ্য তানির মন গলল না। সে বরং বড় বড় চোখে পুরো ঘরের আনাচ কানাচ দেখছে। ঘরের পুরোনো আসবাবপত্রের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের সোফা নেই? ফ্রিজটাও এত পুরোনো। সব রুমে সিলিংফ্যান নেই কেন? এ কোন জায়গায় এসেছিস আপা?’ তানির প্রশ্নে পপি চুপ হয়ে গেল। তানি হয়তো অপমানের ছলে প্রশ্নগুলো করেনি, কিন্তু পপির কাছে এসব প্রশ্ন শুনতে ভালো লাগছে না। দুপুরে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে যখন তানিকে ভাত খেতে বসতে বলে পপি, তানি অবাক হয়ে বলল, ‘মানে কি? আমি যে নিচে বসে খেতে পারি না তুই তো জানিস। তোদের ডাইনিং টেবিলও নেই? এ কোন পরিবারে এসেছিসরে?’ পপি ফিসফিস করে বলল, ‘আস্তে বল, সবাই শুনতে পাবে।’ তানি বিরক্ত চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কোনোরকম কষ্ট করে মেঝেতে বসে ভাতের লোকমা মুখে দিতে দিতে বলল, ‘এখানে আর কোনোদিন ডাকিস না আমায়। এমন পরিবেশ জানলে আসতাম না।’ বিকালে যখন বোনের হাতের চা খাচ্ছিল তানি, হঠাৎ পপির রুমের এক কোণের টিনের চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়তে শুরু করে দেখে তানি বলল, ‘তুই আমাদের রাজমহল ছেড়ে এই কুঁড়েঘরে এসে এসব সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করছিস? মাথায় তো এত গোবর দিন দিন কোথা থেকে আসছে?’ তানির তিরস্কারময় কথাগুলো শুনে চোখে পানি চলে এল পপির। কাঁপা গলায় বলল, ‘তবু আমি এখানে সুখে আছিরে। আমাদের বাবার হয়তো রাজপ্রাসাদ আছে, কিন্তু সুখ নেই। বাবা-মায়ের রোজদিনের ঝগড়াঝাঁটি। আমাদের জয় ভাইয়া মদ খেয়ে প্রতি রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে। ছোট ভাই অপূর্ব মার্ডার কেসের আসামি বলে প্রায়ই রাতে বাড়িতে পুলিশ এলে প্রতিবেশীদের কাছে আমরা আরো বেশি সমালোচিত হই। তোর মেজাজ খারাপ হলে শোকেস থেকে থালা বাসন বের করে একনাগাড়ে ভাঙতে থাকিস। কিন্তু এখানে এসব নোংরা কেলেঙ্কারি নেইরে। এখানে হয়তো অভাব আছে, কিন্তু দিনশেষে সুখ পাওয়া যায়। যেটা আমাদের বাবার রাজপ্রাসাদে পাওয়া যায় না।’ পপির কথা শুনে তানি তাচ্ছিল্যে বলে, ‘আর জ্ঞান দিতে হবে না। চালের ফুটো দিয়ে এখন সুখের ঘরে যে বৃষ্টির পানি পড়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল আছে? আগে ওটা সামাল দে, তারপর এত বড় বড় লেকচার দিস।’

তানির কথা শুনে পপির চোখ ভিজে গেল। ভেজা চোখ মুছে সে একটা বালতি এনে টিনের ফুটো ভেদ করে নামা বৃষ্টির পানি জমা রাখতে বালতিটা সেই জলধারার নিচে রাখতেই টের পেল বালতির তলানিতে ছিদ্র। সেটি দেখে তানি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘কত বড় ঘরে পালিয়ে এসেছিস। দেখ, এদের বালতির তলাটাও ফুটা!’

তানির কথায় আন্দোলিত হয়ে উঠতে চেয়েও চুপসে গেল পপি। আজ তানি এখান থেকে চলে যাবার পর সে তানিকে সোজা ব্লক করে দেবে। আজকের পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত