দাম্পত্য জীবনের ১ বছর পূর্ণ হলেও মনিকার মনে এক ইঞ্চি পরিমাণও জায়গা হয়নি সালমানের। স্ত্রীকে সে পাগলের মতো ভালোবাসতে জানে, এই আভিজাত্যে মনিকাকে সে প্রতি মুহূর্তে দিয়েছে সুখের স্রোতধারা। কিন্তু মনিকা কখনো হৃদয় দিয়ে সালমানকে একটুও বুঝতে চায়নি। বাবা মা এই বোকা সোকা মানুষটার কাছে তাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। পাত্র হিসেবে সেই শুরু থেকে সালমানকে ভালো লাগেনি মনিকার। কিন্তু বাবা-মা মেয়ের মতামতকে তোয়াক্কা না করে বিত্তবান সালমানের সাথেই বিয়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন মনিকার। মানুষটার বিপুল টাকা আছে সত্য, কিন্তু মানুষটা ভীষণ হাবা গোবা আর সহজ সরল। প্রথম রাতেই বলল ‘চলো, আমরা আইসক্রিম খেতে বাইরে যাই।’ কতটুকু হাবলারে বাবা! বাসর রাতে কেউ নতুন বউকে এমন অফার করে!
সংসার শুরু করার কয়েকদিন পরই মনিকা বুঝতে পারে মানুষটার মাথায় সমস্যা আছে। বেশ বাচাল প্রকৃতিরও। কথা না বলে থাকতে পারে না। যতক্ষণ বাসায় থাকে, ঘরটাকে সরগরম করে রাখে। সব মিলিয়ে দিন দিন সালমানের প্রতি অনীহা বাড়ে মনিকার। এই হাবলুটাকে গলায় ঝুলিয়ে সারা জীবন থাকতে হবে! ওহ, না! এ জীবন আর রাখতে ইচ্ছে করে না।
সালমান আজকাল মনিকাকে প্রায়ই বলে ‘তুমি আমি দুজনে একসাথে একটা ছবি তুলব। ছবিটা বড় করে বাঁধাই করে ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখব।’ মনিকা সালমানের আবদার কানে তোলে না। এই হাবলুর সঙ্গে ছবি তোলার ইচ্ছে আপাতত তার নেই। তার মত স্মার্ট সুন্দরী নারীর পাশে এই হাবলুকে মানায় না। ছবি তোলা তো প্রশ্নই আসে না।
- কই, তুমি তো ছবি তোলার ব্যাপারে কিছুই বললে না।
- না। এসব ভালো লাগে না।
মনিকার মরা গলার কথা শুনে আর আগ বাড়িয়ে কথা বাড়ায় না সালমান। সে এতই বোকা যে বউ যে তাকে পাত্তা দিচ্ছে না, এটাও বুঝছে না। মনিকার ভাষ্য- মানুষের অর্থ থাকলেই হয় না। সময়ের সাথে সাথে তাকে স্মার্ট আর আধুনিকও হতে হয়। সেই যোগ্যতা সালমানের নেই। এতটা দিন ধরে একজনের সাথে একই ছাদনা তলায়, তবুও সে বুঝতে পারছে না স্বামী হিসেবে স্ত্রীর মনে তার আসন কতখানি! এমনই সালমান।
একদিন বাবার বাড়ি চলে যায় মনিকা। সালমানের সংসারে ফিরে না যাবার সংকল্প করে বাবা-মাকে জানিয়ে দেয়। এই সিদ্ধান্তের ক’দিনের মাথায় মনিকার পাঠানো তালাকনামা সালমানের হাতে পৌঁছে। স্ত্রীর এমন আচরণে মানষিকভাবে সালমান ভেঙে পড়লেও মনিকার মাঝে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়নি।
নতুন করে আরিফকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুঁনে মনিকা। এই আরিফ যে বিয়ের আগে কতবার প্রপোজ করেছে তাকে। কিন্তু কখনো পাত্তা পায়নি। সংসার ত্যাগের পর এখন আরিফের মতো সুদর্শনকে মনে পড়েছে ভীষণ। আচ্ছা আরিফ কি এখন মেনে নেবে মনিকাকে! এলোমেলো ভাবতে থাকে মনিকা।
মনিকা খোঁজ নেয় আরিফের। কিন্তু ভালো রিপোর্ট আসে না। একের পর এক নারী কেলেংকারিতে জড়ানো আরিফ এখন জেলে দিন কাটাচ্ছে। জয়া নামের এক মেয়ের করা মামলার ফল ভোগ করছে। সেই মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা খেয়েছে আরিফ।
আরিফ অসৎ ছেলে। তা না হলে মেয়েদের সাথে ঝামেলায় জড়াবে কেন? ভাবতে থাকে মনিকা। এভাবে একাকী দিন কাটতে থাকে তার। বাবা দ্বিতীয় বিয়ের তাগিদ দেন। কিন্তু মনিকার আর সংসার করার ইচ্ছে নেই।
এভাবে কেটে গেল কয়েক বছর। মাঝেমধ্যে সালমানকে বড় মনে পড়তো। মানুষটা এখন কী করছে! নিশ্চয় এতদিনে আবার নতুন করে সংসার পেতেছে। নাকি একাই আছে। বড় জানতে ইচ্ছে করছে মনিকার।
২. সময়ের সঙ্গে সাথে বুকের ভেতর এক ধরনের টান অনুভব হচ্ছে সালমানের জন্যে। মানুষটা যে তাকে এক তরফা ভালোবাসতো। মনিকা ভাবে, একদিন সে সালমানের ফেলে আসা সংসার দেখতে যাবে। সে সংসারের কি হাল, তাও দেখে আসবে। কিন্তু এই মুখ কিভাবে আবার সালমানকে দেখাবে, এ নিয়ে মনের ভেতর এক নতুন দ্বিধার জন্ম।
এক পড়ন্ত বিকেলে বোরকা পরে আর নেকাবে মুখ ডেকে মনিকা গেল সালমানের বাড়িতে। এই বাড়িতে একদিন সে বেনারশি পরে এসেছে, আজ আবার এসেছে অচেনা অতিথি হয়ে।
ঘরে ঢুকতেই এগিয়ে এলেন এক পরমা সুন্দরী নারী। নাম টুম্পা। মনিকার পরিচয় জানতে চায়। পথিমধ্যে থেকে একটুখানি বিশ্রাম নিতে এসেছে, জানিয়ে দেয় মনিকা। শুনে মিষ্টি হাসে টুম্পা। এমন মিষ্টি হাসি আর কোনো নারীরই দেখেনি মনিকা। টুম্পা মনিকাকে ড্রয়িংরুমে আহ্বান জানায়। সম্মতি দেয় মনিকা।
ড্রয়িংরুমে আসতেই দেয়ালে বিশাল এক ছবি চোখে পড়লো মনিকার। ছবিতে সালমানের পাশে যে নারীটি মৃদু হাসছে, সে নারীই এখন মনিকার পাশে। বুঝতে দেরি হয় না এই নারীর পরিচয় জানতে। মনিকার ভেঙে দেয়া সালমানের ভাঙা সংসার এই সুন্দরীকে দিয়ে জোড়া দিয়েছে সালমান। টুম্পা সালমানের জীবনের নতুন মানুষ।
সোফায় পাশাপাশি বসেছে মনিকা ও টুম্পা। মুখের নেকাব খোলার জন্য টুম্পার দারুণ অনুরোধ। কিন্তু মনিকা সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে দেয়ালে ঝুলন্ত ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল ‘উনিই আপনার স্বামী?’ ম্লাণ হেসে টুম্পা বলল ‘হ্যাঁ। ও সালমান। আমাকে এক রোখা ভালোবাসে। ছবিটা কিন্তু গত মাসে বাঁধানো হয়েছে। ওর চরম আগ্রহ স্ত্রীর সাথে ছবি তুলে ঝুলিয়ে রাখবে। হা হা হা।’
টুম্পার হাসিতে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো মনিকার। নিজের অবহেলায় এ সংসার আজ টুম্পার হয়েছে। নিচু গলায় মনিকা প্রশ্ন করলো ‘আপনার স্বামী এখন কোথায়?’ হেসে টুম্পার জবাব ‘সালমান অফিসিয়াল কাজে সাত দিনের জন্য কাতারে গেছে। কাল ফিরবে। ফিরেই সে একটা শুভ সংবাদ শুনবে।’ মনিকা আবারও নিচু গলায় বলল ‘কি শুভ সংবাদ?’ নিচের দিকে তাকিয়ে টুম্পা বলল ‘ও বাবা হবে।’ মনিকার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এই সংসারের মহারাণী কিংবা সালমানের সন্তানের মা সেও হতে পারত। এমন কী দেয়ালের ওই ছবিটায় টুম্পার বদলে মনিকা নিজেও থাকতে পারত। সহজ সরল মানুষটার যে কোনো দোষ ছিল না। সব দোষ মনিকার নিজের। এতদিনে আজ সে এটা টের পাচ্ছে।