উপন্যাসের পাশাপাশি গল্প রচনায় এক অসামান্য নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নির্মম মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার এক অসাধারণ গল্প ‘নয়নচারা’। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র “নয়নচারা” গল্পগ্রন্থে মোট আটটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পই জীবন স্পর্শী যা গভীরভাবে স্পর্শ করে পাঠকদের। তার অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী গল্পগুলো হলো- নয়নচারা, জাহাজী,পরাজয়. মৃত্যু-যাত্রা. খুনি ও নয়নচারা। আজকের আলোচনার বিষয় নয়নচারা গল্প। নয়নচারা হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের এক নির্মম বাস্তবতার গল্প। গল্পটিতে ভেতর ও বাইরের বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে নিখুঁতভাবে। গল্পে রোমান্টিকতার কোনো পরিসর দেখা যায়নি। ক্ষুধা ও হাহাকারে পূর্ণ গল্পটি জীবন হয়ে ঢুকে গেছে জীবনবোধের আরেক বাস্তবতায়। এই গল্পে উঠে এসেছে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা। মানুষের অভাবের জীবনে শান্ত ময়ূরাক্ষী নদী তাদের দুর্যোগের প্রকাশ করেছেন তার কুয়াশা দিয়ে।
এর কাহিনী হচ্ছে ১৩৫০ সালের দুর্ভিক্ষের সময় পেটে ক্ষুধা নিয়ে কলকাতা শহরের পথেঘাটে ঘূরেফেরা কিছু মানুষ যাদের একজনের নাম আমু। তাদের মধ্যে অনাহারে মরে যাচ্ছে কেউ কেউ। কেউ কেউ একটু খাবারের আশায় দোকানে যায় এবং তাড়া খেয়ে ফিরে আসে। এই দুর্ভিক্ষে কেউ তাদের সাহায্য করে না। এতো বিতাড়িত হওয়ার পরে যখন একটি অচেনা মেয়ে তাকে ভিক্ষে দেয়, আমু তখন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘নয়নচারা’ গাঁয়ে কী মায়ের বাড়ি? এই একটি কথাই নয়নচারা গল্পের সমস্ত তাৎপর্যকে বহন করে। আমুর কাছে তার গ্রাম নয়নচারা ছিল তার স্বর্গ সেখানে তারা সবাই সুখে শান্তিতে ছিল। তার গ্রামের মানুষ মানেই স্নেহশীল ও দরদী। যদিও যে মেয়েটি ভিক্ষে দিয়েছে তার বাড়ি নয়নচারা গ্রামে নয়; কিন্তু আমু তাই মনে করেছে তার গ্রামের মেয়ে। তা না হলে ভিক্ষে দিবে কেন! শুধু তার নিজের গ্রামেই তার মা মায়ের মতো মমতাময়ী। নয়নচারা গ্রামের মানুষেরাই কেবল ভালোবাসায় অনেক বড়ো হয় তারা যেখানেই থাকুক যে জায়গাতেই থাকুক কেবল তারাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নিজেদের নাড়ির প্রতি টান, শেকড়ের প্রতি টান। আমুর নিজের গ্রামের মমতা জড়ানো ময়ূরাক্ষী নদী। আমু চরিত্রটি শহরে এসেও বিভিন্নভাবে নিজের গ্রামকে খুঁজেছেন কখনো শহুরে মেয়ের ঘনকালো চুলে দেখেছেন নিজের গাঁয়ের মেয়ের মুখ আবার কখনো দেখেছেন মাথার চুলে হাওয়ায় নিজের এলাকার দোলানো ধানখেত।
চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে তার গ্রাম নদী ও স্নেহময়ী প্রকৃতি, দেখতে পেয়েও যেন কিছুতেই এই চোরাবালি থেকে বের হতে পারছে না তারা। গল্পটিতে শহুরের মানুষের হৃদয়হীনতা ও বাস্তবতার পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের সহজ সরল স্বভাব ও সুখ হাসি কান্নার চিত্র দারুণভাবে উঠে এসেছে নিখুঁতভাবে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দরদমাখা সহজ আবেগের এক অসামান্য উপস্থাপন ঘটেছে তার নয়নচারা উপন্যাসে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
নিলয় ১৪, নতুন পাড়া, সুনামগঞ্জ।