ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নজরুলের বিদ্রোহী : শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক

এস ডি সুব্রত
নজরুলের বিদ্রোহী : শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক

ঔপনিবেশিক শোষণ, সামন্ত মূল্যবোধ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন বিদ্রোহী রূপে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আবির্ভূত হন নজরুল। সত্য সুন্দর মঙ্গল ও শান্তির কামনায় তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন যাবতীয় অপশক্তি, ধর্মীয় শোষণ ও জীর্ণ-সনাতন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির অভিলাষে তিনি হয়েছেন বিদ্রোহী। তবে আজ থেকে ১০০ বছর আগে রচিত এ কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক, বোধ করি প্রাসঙ্গিক থাকবে চিরকাল। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল রচনা করেন এই ভুবনবিজয়ী কবিতা। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ রচনা করেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কবিতাটির প্রথম শ্রোতা ছিলেন মুজফফর আহমদ। কলকাতার ৩/৪-সি তালতলা লেনের ভাড়া বাড়ির একতলায় থাকতেন মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘ঔপনিবেশিক ভারতের সেই সময় যখন নজরুল আবির্ভূত হলেন, তখন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঔপনিবেশিক বিরোধিতা বড় করে তুলছেন। বল বীর, চির উন্নত মম শির, এই বীর তিনি বলছেন সমস্ত বাঙালিকে, যে বীরের মতো তোমরা উঠে দাঁড়াও। ভীরু বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করে তুলতে চেয়েছেন, তাদের জাগ্রত করতে অসংখ্য শব্দের ঝংকারে কবিতাটি যেন পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে!’

অন্যায় এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে নজরুলের লড়াই ছিল আজীবনের। কমরেড মুজফফর আহমদ তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। বিদ্রোহী কবিতাটি লেখার মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ‘তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে।

রাত্রির কোনো সময়ে তা আমি জানিনে। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। ‘পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।’ ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথ’ বইয়ে মুজফফর আহমদ এরপর বর্ণনা দিয়েছেন, যেহেতু তিনি সামনাসামনি কারো প্রশংসা করতে পারেন না, তাই কবিতা শোনার পরেও তিনি উচ্ছ্বসিত হতে পারেননি। তাতে মনে মনে কাজী নজরুল ইসলাম আহত হয়েছিলেন বলেও তার মনে হয়েছে। সেদিন বেলা হওয়ার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সেই বাড়িতে আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সেটা শুনে একটি কপি সঙ্গে নিয়ে যান। মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ‘আমিও বাইরে চলে যাই। তারপরে বাড়িতে ফিরে আসি ১২টার কিছু আগে।

আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষেদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, বিজলীতে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।’

১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল।

বিদ্রোহী কবিতার ব্যাঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস ‘ব্যাঙ’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলে, যা শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্যারোডি করে লিখেছিলেন, 'আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমার ঠ্যাং/ আমি ব্যাঙ/ আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/ আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।’

বিশ্বের পালাবদলের প্রভাব নজরুলের কবিতায়

পৃথিবীর ভাবজগতে বিভিন্ন দেশে সেই সময় একটা পরিবর্তন চলছিল। বিশেষ করে এই অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের মধ্যে যে রোমান্টিক ধারা চলছিল, তাতেও পরিবর্তন আনে। সেই সঙ্গে বলশেভিক বিপ্লব সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের প্রচলিত ধ্যানধারণার, চিন্তা চেতনার পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে। ‘তাই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাতে আরো সময় লেগে যেতো। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হলো।’ তিনি আরো বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও যেখানেই এসব পত্রিকা পেতো, সেগুলো জব্দ করত। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। আমার মনে হয় না, বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী ছাড়া আর কোনো কবিতা এতোটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১০০ বছর পরেও সেই আবেদন কমেনি।’

বিষয়ভাবনা এবং জীবনার্থের মতো, শব্দ ব্যবহারেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রাতিস্কিতার স্বাক্ষর রেখেছেন নজরুল। বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার প্রেরণায় নয়, বরং আবেগের প্রাবল্যে নির্বাচিত হয়েছে তার শব্দমালা। কোনোরূপ বিচার-বিবেচনার দাসত্ব স্বীকার না করে স্বাধীন স্ফূর্তিতে তিনি চয়ন করেছেন তার প্রিয় শব্দরাজি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ব্যবহৃত তৎসম, তদ্ভব, দেশি বা বিদেশি শব্দের মধ্যে নেই কোনো জাত বিচার। এ কবিতায় ওক্তধর্মী সংস্কৃত শব্দের পাশেই ভেদিয়া, ছেদিয়া, ভীম ভাসমান মাইন, ঠমকি ছমকি, হরদম ভরপুর মদ, তুড়ি দিয়া ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধ অবলীলায় ব্যবহৃত হয়েছে। এ কবিতায় নজরুলের শব্দচেতনায় এখানেই স্বাতন্ত্র্য যে, তিনি ধ্বনি-প্রবাহের অনুগামী করে শব্দের মধ্যে নিয়ে এসেছেন প্রবল জীবনাবেগ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় শব্দ ব্যবহারের এই নতুন পরীক্ষা আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশকে সদর্থক মাত্রায় করেছে প্রভাবিত।

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের মতো অত সুদীর্ঘ নয়; আবার খুব ছোটও নয়। ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে একবাক্যে স্বীকৃত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজ শাসকের রোষানল ধেয়ে আসে তার দিকে। বিদ্রোহী কবিতা প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখলেন- ‘হঠাৎ একটা তীব্র প্রবল তুফানের ঝাপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিল।’ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখলেন, ‘এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠল।’ মতামত দিলেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

আশীর্বাদ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক দিকে স্বদেশপ্রেমিকদের সাহস জোগাল, অন্য দিকে বন্ধুদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাল। এই অসামান্য বৈপরীত্য- ‘বিদ্রোহী’ ছাড়া আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে অদৃষ্টপূর্ব। বাংলার জনমানসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ঘিরে জমে ওঠে প্রতর্ক ও প্রতিক্রিয়ার পুষ্পবাণ, যা এর আগে কোনো কবিতাকে ঘিরে হয়নি। মাত্র ২১ বছরের একজন নবীন ও তরুণ কবির পক্ষে-বিপক্ষে বিচিত্র পাঠ-প্রতিক্রিয়া আর কোনো কবির জীবনে ঘটেনি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে বলা হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল মানচিত্র। যেখানে বেদণ্ডপুরাণ-উপনিষদণ্ডগীতা মহাকাব্য থেকে শুরু করে ইসলামী অনুষঙ্গও অসামান্য দক্ষতায় চিত্রিত হয়েছে।

শুধু হিন্দু-মুসলিম মিথ নয়, এতে গ্রিক পুরাণেরও মহাসমন্বয় ঘটেছে। যেন বেদণ্ডপুরাণ-কোরআন-বাইবেলের সহাবস্থানে উদার সুফিবাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। শুধু পুরাণ কিংবা মিথ নয়, দেশি-বিদেশি শব্দমালার সংমিশ্রণ এটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। গ্রিক পুরাণের হোমারের ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, প্রাচীন ভারতের ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, বেদণ্ডউপনিষদণ্ডভাগবত গীতা ছাড়া ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে মিথের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ১০০ বছর পেরিয়ে এসেও বিদ্রোহী আজো সমান প্রাসঙ্গিক।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত