বমূর্ত লাঞ্ছনা

সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছায়া সুনিবিড় শস্য শ্যামল এক গ্রামের নাম শান্তিপুর। নামে শান্তি হলেই সেখানে সবাই শান্তিতে বাস? করবে এমন কোনো কথা নেই। আনিস নামের যুবকের বাস সেই গ্রামে। আনিস নিষ্ঠাবান এবং সৎ স্বভাবের মানুষ। অশান্তি তার একদম ভালো লাগে না। চারপাশে হৃদয়হীনতা স্বার্থপরতার সংঘাত তাকে আলোড়িত করে। এমন এক ব্যক্তির কপালে জুটে সীমাহীন অশান্তি। আনিসকে ভালোবাসে রুপা। কিন্তু সেখানে ভিলেন হয়ে আছে মুনির। মুনির রুপার চাচাতো ভাই। সে মোটেও ভালো মানুষ নয়। সমস্যা আরও আছে। রুপাদের পরিবার তার চাচার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পারিবারিক দ্বন্দ্বে। রুপার দাদা বিষয় বুদ্ধিতে ছিলেন বেশ পটু। গড়ে ছিলেন বিস্তর সহায় সম্পদ। অকাল মৃত্যুর কারণে তিনি পারিবারিক সহায় সম্পত্তির সঠিক বিধি ব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। সেই সুযোগটা নিয়েছে তার ধুরন্ধর ছোট পুত্র অর্থাৎ রুপার চাচা। বড় ভাই রুপার পিতা আক্কাস আলীকে বঞ্চিত করে। আক্কাস আলী নিরিহ গোছের মানুষ। সম্পত্তি নিয়ে ছোট ভাইয়ের জালিয়াতি প্রায় মুখ বুজেই সহ্য করছেন। মুখরা স্বভাবের রুপার পক্ষেও পিতাকে ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেয়ার মতো প্রতিবাদী করে তোলা সম্ভব হয়নি। নিরবে দগ্ধ হয় রুপা।

আনিসের যে স্বভাবের মানুষ তাতে যেঁচে গিয়ে প্রেম নিবেদন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রুপাই প্রথম এগিয়ে এসে প্রেম নিবেদন পর্ব সম্পন্ন করে এবং রুপা বুঝতে পারে সে ভুল করেনি। মানুষ হিসেবে আনিস অতুলনীয়। রুপা জেদি এবং মুখরা স্বভাবকে শান্তভাবে সামাল দিতে পারে আনিস। অপরদিকে অবস্থা বুঝে ঘরে বাইরে ম্যানেজ করতে পারে রুপা। স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলার যৌক্তিকতা খুঁজে পায় না সে। ভাবে পূর্ণাঙ্গিনী বললে হয়তো সঠিক হতো। কৌশলী রুপা তার ছোট চাচার বাড়িতে যাওয়া আসার মাধ্যমে সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। বুদ্ধিমান হলেও নারীর ক্ষেত্রে হয়তো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একদিন রুপা ধুরন্ধর ছোট চাচার মহা ধুরন্ধর ছেলে মুনিরের ফাঁদে আটকে যায়। মুনির জরুরী কথা আছে বলে ঘরে নিয়ে যায় তাকে। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। মনির বলে, এখন চিৎকার করে মানুষ ডাকলে বলবো তুমি আমাকে ফাঁসানোর জন্য ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছ। মানুষ সেটাই বিশ্বাস করবে। ঈশ্বরের দিব্যি, অশ্রুজল সহ রুপা অজস্র কাকুতি মিনতিতে কাজ হয় না। মুনির মহাবিক্রমে তার পুরুষত্ব জাহির করে। আনিস দীর্ঘদিন রুপার দেখা পায় না। দারুণ উতোলা হয়ে পড়ে সে। আনিস অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে তোমার। কিছু হয়নি বলে এড়িয়ে যায় রুপা। রুপার ম্লান হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে আনিস উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে। বাড়তে থাকে তার উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।রুপার একদিন মুনিরের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়। সর্বনাশের কথাটা জানায় তাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকে রক্ষা কর মুনির। মুনির এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে সব দায়িত্ব। কোথায় কী করে এসেছ এখন আমার কাঁধে উঠতে চাইছ। সবাই জানে আনিসের সঙ্গে তোমার মাখা মাখির কথা। আনিসকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন? আনিসের কাছে যাও। এখানে ঝামেলা করলে সবাইকে ডেকে বলে দেবো তোমার কুকীর্তির কথা। রুপার চরম অপমানিত হয়ে বিধ্বস্ত চিত্তে ফিরে আসে। রুপা একদিন আনিসের সঙ্গে দেখা করে। বিধ্বস্ত উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা, দেখে আনিস চমকে উঠে। রুপা বলে, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আনিস অধীর আগ্রহে শুনতে চায়, বলো। রুপা বলে, আমি আত্মহত্যা করব। আনিস চমকে উঠে, একি কুলক্ষণে কথা। কেন কী হয়েছে তোমার। রুপা জানে এই একটি লোকের কাছে মন খুলে কথা বলা যায়। সব বলা যায়। রুপার জন্য যার মনে আছে সীমাহীন ভালোবাসা। অশ্রু সজল রুপা বর্ণনা করে তার অপমান আর অনাগত কলঙ্কের কথা। সব শুনে স্তম্ভিত হয় আনিস। সে বলে, তুমি তো অপরাধী না। তাহলে নিজেকে এত বড় শাস্তি দিতে চাও কেন? যে অপরাধ করেছে শাস্তি তো তার পাওয়া উচিত। কে বোঝাবে কাকে অনন্তকাল দুনিয়াটা এভাবেই চলছে। বিধাতা কলঙ্কের বোঝা বহনের জন্য শক্তিহীন নারীকে কেন বেছে নিয়েছেন। এমন সর্বনাশা পরিস্থিতির প্রতিকার দেবার বুদ্ধি নেই আনিসের। কদিন উথাল-পাতাল চিন্তা করে পরিত্রাণের একটি উপায় বের করে আনিস। রুপাকে বলে, চলো আমরা ঢাকায় চলে যাই। ওখানে গিয়ে আমরা বিয়ে করব। তোমার অনাগত সন্তান আমার পরিচয়ে বড় হবে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় রুপা। পাথরচাপা বুকটা একটু হালকা হয়। পরক্ষণই মনে হয় এমন একজন উদারমনা ভালো মানুষকে ঠকানো উচিত হবে না তার। সারা জীবন এই কলঙ্কের বোঝা দগ্ধ করবে তাকে। রুপা আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর আগে সে সুইসাইড নোটে লিখে রেখে যায়, ‘আমার মৃত্যুর জন্য মুনির দায়ী’। বিষয়টা পুলিশ আসার আগেই জানতে পরে মুনির। সে একজন বিশ্বস্ত পরিচারিকাকে দিয়ে সেটা সরিয়ে ফেলে। এমন একটা অন্যায়ের প্রতিবাদে আনিসের মানবিক সত্তা মুহুর্মুহু নিরবে ফেটে পড়ে। মহা অন্যায় চোখের সামনে দেখে নিশ্চুপ থাকার যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয় হৃদয়। অপমানিত বিবেক নিয়ে সে নিরুদ্দেশে চলে যায়। জীবনে আর কখনো শান্তিপুর ফিরে আসেনি।