জোনাকি
ফারুক আহম্মেদ জীবন
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মনু মিয়া যশোরের ঝিকর গাছার কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম পাড়ে শান্তিপুর গাঁয়ের একজন
গরিব কৃষক।
এক জোড়া গরু লাঙ্গল আর কাঠ বাঁশের গাড়ি তার সম্বল। স্ত্রী ফুলি, মেয়ে জোনাকি আর ছেলে স্বপ্নকে নিয়ে দুই কামরা মাটির টিনের ঘরে তার বসবাস।
পরের জমি বর্গা চাষ করে তার সংসার চলে। কপোতাক্ষ নদের পাড়েই গড়ে উঠেছে ছোট একটা গঞ্জ। গঞ্জের ডানপাশে প্রাইমারি, হাই স্কুল, আর খেলার মাঠ।
শীতকাল এলে রাতের বেলা সেই স্কুল মাঠে শুরু হয় জারি গান। পড়ন্ত বৈকালেতে গঞ্জের চায়ের দোকানগুলোতে জমে উঠে মানুয়ের আড্ডা। সন্ধ্যাটা নামলেই সব যোগ দেয় জারি গানের আসরে।
এভাবেই হাসি, আনন্দের ভেতরেই জীবন কাটে শান্তিপুর আর তার পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের মানুষদের। মনুর বউ ফুলি খুব সুন্দর ফর্সা, ছেলে স্বপ্ন মায়ের মত হয়েছে।
আর মেয়ে জোনাকি হয়েছে বাপের মতো একটু রঙে চাঁপা। কালো হলেও জোনাকি দেখতে শুনতে মন্দ না। মাথা ভর্তি কোমর ছুঁয়া চুল। লম্বা মাংসল ভরাট মুখের গড়ন।
পাতলা দুটি ঠোঁট, বাঁশির মতো চিকন লম্বা ঝুলান্ত নাক। আর ডাগর ডাগর ভাসা গভীর মায়াবী কাজল কালো দুটি চোখ। তার বাড়ন্ত দেহে উঠতি যৌবনে মাত্র পনেরো বছরে এক অন্য রকম নেশা জাগানো রুপ জৌলুস সারা দেহে ফুটে উঠেছে।
দেখলে ১৯-২০ বছরের বয়সি একটা পূর্ণবতী যুবতি মনে হবে জোনাকির। এবছরে গাঁয়ের স্কুল থেকে এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দেয়েছে। আর স্বপ্ন সেভেনে পড়ে।
কষ্টের মধ্যেও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে- মনু মিয়া। চৈত্রের দুপুরের খাঁ খাঁ রৌদ্র মনু মিয়া হাল চাষ করে লাঙ্গল, জোয়াল, কাঁধে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এমন সময় পশ্চিমপাড়ার রহমত ঘটক দূর থেকে চিল্লাইয়া হাঁফাতে হাঁফাতে- ও-মনু মিয়া...মনু মিয়া...? একটু দাঁড়াও- তোমার সাথে দুটো কথা আছে...।
মনু-কি কথা চাচা...? চাচা এখন তো দাঁড়ানো
যাবে না, গরু বাড়ির দিকে ছুট ধরেছে।
ঘট - তোমার মেয়ে জোনাকির জন্য একটা ভাল সম্বন্ধ ছিল মনু সে ব্যাপারে কথা বলতাম।
মনু- যেতে যেতে.চাচা বৈকাল বেলা গঞ্জে আসেন কালুর চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে...।
ঘটক- আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে এসো কিন্তু...?
মনু- আচ্ছা চাচা-মনু বাড়িতে পৌঁছেই লাঙ্গল-জোয়াল রেখে গরু বেঁধে পানি খাওয়াই সানি দিয়ে মাথার গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছে হাঁফ ছেড়ে চৌকিটা টেনে বসলো।
বউ ফুলি- গ্লাসে করে খাবার পানি নিয়ে এগিয়ে এসে মনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নেও পানি খাও।
মনু- পানির গ্লাস নিতে নিতে দাও বউ খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
উহু! যে কাঠ ফাটা রৌদ্র ভ্যাপসা গরম।
ফুলি- মনুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে- ও জোনাকির বাপ, কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন চিন্তা যুক্ত দেখাচ্ছে কেনো?
মনু- কই, তেমন কিছু নাতো কি চিন্তা করব?
ফুলি- কিছু না বললেই হলো? তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তুমি কিছু একটা চিন্তা করছাও? আমার সাথে বলো শুনি...।
মনু- পানি খাওয়া শেষ করে গ্লাস এগিয়ে দিল।
ফুলি- গ্লাস হাতে নিয়ে বসো তোমার জন্য আগে পান বানিয়ে আনি ।ফুলি পান এনে মনুর হাতে দিয়ে অন্য একটা চৌকিতে বসে এবার বলো শুনি কি হয়েছে-?
মনু- স্বপ্ন এখনো স্কুল থেকে ফিরিনি ফুলি?
ফুলি - না আসিনি তবে আসার মতন হয়েছে।
মনু- আমার জোনাকি মা কোথায় গেছে?
ফুলি- দোলা চাচী ডেকে নিয়ে গেল সুঁইতে সুতো না- কি পরাতে পারছে না তাই।
মনু- ওহ, আচ্ছা ফুলি-পশ্চিম পাড়ার রহমত চাচার তো তুমি চেনো-তাইনা-?
ফুলি- কোন রহমত চাচা-যিনি ঘটকালি করে?
মনু - হ্যাঁ ঐ ঘটক রহমত চাচার কথায় বলছি।
ফুলি- কেন কিছু কিছু বলেছে চাচা তোমাকে-?
মনু- হু-জোনিকির বিয়ের ব্যাপারে বলছিলো ভালো একটা নাকি সম্বন্ধ আছে পুরো কথা শুনিনি বিকেলে গঞ্জে দেখা করতে বলেছি।
ফুলি- ও তাই বলো আমি ভাবলাম কি না কি? মেয়ে তোমার বড় হয়েছে লোকে তো বলবেই এতে মন খারাপের কি আছে?
মনু- তা অবশ্য ঠিক বলেছ আচ্ছা জোনাকির মা...তোমার মনে পড়ে?
তারপর মনু কল্পনায় ডুবে অন্য মনস্ক হয়ে বলতে
শুরু করলো.....
তোমাকে প্রথম যেদিন বউ করে এ ঘরে আনলাম সারা গাঁয়ের মানুষ তোমাকে দেখতে এলো। দেখে বলতে লাগলো মনু বউ একটা এনেছে। এমন
রুপসী বউ আশপাশের গাঁয়ে আর একটাও নেই।
সবাই বিদায় নিয়ে যখন চলে গেল রাতে তুমি একা ঘরের ভিতর জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলে আমি ঘরের ভিতর ঢুকতেই...তুমি লম্বা ঘোমটা টেনে দিলে। তোমার পাশে বসে ঘোমটা সরায় চিবুক ধরে মুখটা উঁচু করতেই লজ্জায় তুমি কেমন লাল হয়ে গিয়েছিলে।আমি তোমাকে
স্পর্শ করতেই তুমি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলে।
আমার বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে আদর পেয়ে আস্তে আস্তে সে কাঁপ বন্ধ হলো।
তারপর- আমাদের দুজনের ফুলশয্যা হলো।
ফুলি- লজ্জা পেয়ে বললো যাও-সে রাতের কথা মনে হলে আজো আমার কেমন শরম করে। খুব ভয় করছিলো আমার সে রাতে। তুমি যতো আমার কাছে আসছিলে ততই যেনো আমার গলা বুক শুকায় পুরো কাঠ হয়ে যাচ্ছিল।
মনু- বলল তারপর.. তোমার মনে আছে ফুলি-? মাসখানিক যেতে না যেতেই তুমি বললে মাথাটা কেমন ঘুরছে বমিবমি লাগছে। আমি সব শুনে তোমাকে গঞ্জে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা করে টরে হেসে বললো মিষ্টি খাওয়ান আপনি বাবা হতে চলেছেন। শুনে তুমি হেসে লজ্জা জড়ানো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলে। আমি বাবা হবো? শুনে কিযে খুশি লাগছিল আমার তা বলে বুঝাতে পারব না। তারপর থেকে কোন ভারি কাজ তোমাকে আমি করতে দিতাম না। খাদ্যের প্রতিও সবসময় যত্ন নিতাম যাতে তুমি আর তোমার পেটের সন্তান কোনো রকম অপুষ্টিতে না ভোগো।
তারপর...বছর ঘুরতেই জোনাকি মা তোমার
কোলজুড়ে ঘর আলো করে এলো।
ফুলি-মনে থাকবে না? সব মনে আছে আমার। তুমি মাঠের কাজ সেরে বাড়ি এসে কিভাবে আমাকে সাহায্যে করতে আমায় আগলে রাখতে।
মনু-মনে হয় সেদিনের কথা তাইনা ফুলি-?
ফুলি-হুম, দেখতে দেখতে ষোলটি বছর পার হয়ে গেল তোমার ঘরের বউ হয়ে এসেছি।
জোনাকি হঠাৎ এসে-মা-খুব ক্ষিদে লেগেছে ভাত দাও-আব্বা তুমি কখন ফিরলে?
মনু-এইতো আসলাম মা। এসে তোর মায়ের
সাথে বসে একটু দু’চারটে কথা বলছিলাম।
ফুলি-ওগো, তুমিও স্নান করে এসে খেয়ে নেও।
মনু- হ্যাঁ যাচ্ছি-ঐ তো স্বপ্নও চলে এসেছে
ফুলি-স্বপ্ন বই খাতা রেখে কাপড় পাল্টে রান্না ঘরে খেতে আয় বাবা খাবার দিচ্ছি জোনাকি তুইও আয় মা।
স্বপ্ন- হ্যাঁ আসছি মা-তুমি ভাত বাড়তে লাগো।
মনু দুপুরের ভাত খেয়ে বিকেলে গঞ্জে যেতেই চায়ের দোকানে রহমত চাচার সাথে দেখা...।
কখন আসলে চাচা..? এইতো এই মাত্র বাবা।
মনু-কালু ভাই আমাদের বিস্কুট আর চা দাও। কালু...দিচ্ছি বসো মনু ভাই।বিস্কুট পানি খেয়ে চা খেতে খেতে তারপর বলেন চাচা?
পাত্র কে? বাড়ি কোথায়? আর কি করে?
ঘটক-পাত্র সখিপুর গাঁয়ের শরিফের শালা বিদেশ থাকে, ভালোই কামাই, দেখতেও মন্দ না।
মনু- তবে তো ভালোই, তা দেনা-পাওনার কথা কিছু বলেছে মানে যৌতুক টৌতুক কিছু?
ঘটক- না এখনো কিছু বলিনি আগে মেয়ে দেখুক যদি পছন্দ করে, তখন দেখা যাবে।
মনু- ওরা কবে মেয়ে দেখতে চাচ্ছে চাচা?
ঘটক- ওরা তো আজকেই দেখতে চাচ্ছিল।
আমি থামাই রাখছি। কালকের কথা বলেছি কাল শুক্রবার আছে তুমি খাওন দাওনের একটু ব্যবস্থা করো মনু। ওদের মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। মনু-কিন্তু চাচা এত তাড়াতাড়ি-কি করে-?
ঘটক- তুমি গরিব মানুষ বাপু বেশি খরচণ্ডখরচার দরকার নেই। গাঁয়ের কিছু গণ্য মান্য লোক ডেকে ধরা বিয়ে দিলে হবে। বিয়ের কাজ যতো দ্রুত হয় ততই ভাল বুঝলে? তুমি সেভাবে রেডি থেকো।
মনু- ঠিক আছে চাচা আপনি যখন বলছেন...
ঘটক- তাহলে উঠি বাবাজী কাল দেখা হচ্ছে।
শুক্রবার-বারোটার আগেই ঘটক ছেলে পক্ষ
নিয়ে মনুর বাড়ি এলো। নাস্তার পর্ব শেষ হলে পাত্রী দেখানো হলো। পাত্রী ছেলের খুব পছন্দ।
কণে পছন্দের পর যৌতুক নিয়ে দর কষাকষি
শুরু হলো। পাত্র পক্ষের দাবী ঘর সাঁজাতে যা
লাগে আর একটা মোটর সাইকেল দিতে হবে।
জানালা থেকে জোনাকি আর তার পাড়ার সখিরা সব কথা শুনছে। গাঁয়ের মেম্বার এলো মনু-মেম্বার সাহেব? আসেন...বসেন...বসেন...
ও স্বপ্ন, মেম্বার সাহেবকে বসতে চেয়ারটা দে-বাবা মেম্বার-বসে সব শুনলো। তারপর বললো মনু তুমি কি জানো? বাংলাদেশের আইনে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দণ্ডনীয় অপরাধ? আর এই বিয়েকে বাল্যে বিবাহ বলে? যতোটুকু জানি জোনাকির এখনো ১৮ বছর বয়স হয়নি। আর যৌতুক তো তার চেয়েও অমার্জনীয় অপরাধ।
মনু- আমি মূর্খ মানুষ মেম্বার সাব এত কিছু বুঝতে পারিনি। মাথার উপর কন্যা দ্বায় তাই...।
এমন সময় মনুর বাড়ি পুলিশের গাড়ি এলো
সবাই হতভম্ব। জোনাকি মায়ের মুখে রাতেই শুনে বিয়ে ঠেকাতে সকালে রাকিকে সবকিছু খুলে বলে। রাকি এ গাঁয়েরই ছেলে রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে। ওরা দুজন দুজনকে অনেক পছন্দ করে। পড়া লেখা শেষ করে তারপরে ওরা দুজনে বিয়ে করতে চাই। রাকি সব শুনে সকালেই বিষয়টা মেম্বারকে বলে। আর তাই মেম্বার...
আগে থেকে থানার এসআই লালকে কল করে আসতে বলে। জোনাকি বেরিয়ে এসে।
মেম্বারকে বলে আমি যৌতুকে বিয়ে করতে চাইনে মেম্বার সাহেব। পড়া লেখা করে আমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমার আব্বার কোন দোষ নেই। আমি কালো বলে হয়তো- আব্বা আমাকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে রাজি...
মেম্বার-হুম, সব কিছুই বুঝতে পারছি জোনাকি তারপর এস,আই, লালকে যৌতুক দাবীর সব ঘটনা খুলে বললো মনু মেম্বার।
ইন্সপেক্টর লাল, সব কিছু শুনে যৌতুক দাবি করার জন্য কনস্টেবলদের বলল। পাত্রসহ সহযোগীদের এরেস্ট করে গাড়িতে তোলো।
আর ঘটক রহমত চাচাকে বর্তমানের যুগের
যৌতুকও বাল্য বিয়ের আইনের বিষয় ভালো
ভাবে না জানার কারণে বৃদ্ধ হওয়ায় মনু মেম্বার পুলিশকে ক্ষমার চোখে দেখতে বলল। পুলিশ
রহমত ঘটকের দিকে তাকিয়ে মানবিক দৃষ্টিতে ক্ষমা চোখে দেখে বললো ঠিক আছে মেম্বার সাহেব। তবে এরপর এমন করলে কিন্তু...
মেম্বার-জোনাকির বাপ মনুকে বললো দেখো
মনু, মেয়ে তোমার কালো তাতে কি হয়েছে?
পড়া লেখা করে আঁধার রাতের জোনাকির আলোর মতো এই মেয়ে একদিন তোমার মুখ আলো করবে দেখে নিও।
এভাবে বাংলাদেশের বুক হতে রোধ হলো- একটা যৌতুক ও অকাল বাল্য বিবাহ।