রুমিকে বলা হয় প্রেম ও ভালোবাসার মহান কবি। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তাবাদ নির্বিশেষে তিনি ঈশ্বর, মানুষ, আত্মা এবং মহাবিশ্বের প্রেমের গান গেয়েছেন। তার উদ্দীপনামূলক কবিতাগুলো প্রচণ্ড শক্তি এবং অনুরণন নিয়ে বৈশ্বিক কণ্ঠে প্রতিটি মানব হৃদয়কে আন্দোলিত করে। তিনি চিত্রকল্প- রুপক হিসেবে তুলে ধরেছেন মানুষের অতি পরিচিত- চারপাশের অনুষঙ্গ। বিষয়বস্তুও বিবরণে তিনি সূক্ষ্ম অর্ন্তদৃষ্টিতে তুলে এনেছেন ফুল, পাখি, নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্য, নদী, মাছ, ইত্যাদির দার্শনিক চিত্রকল্প যা একইভাবে জীবন্ত রয়ে গেছে শত শত বছর পরেও। অনেকেই রুমির কবিতাকে ফার্সি কুরআন হিসেবে অভিহিত করেন। প্রায় কয়েক সহস্রাধিক লাইন কোরআন থেকে ফার্সি অনুবাদ হিসেবে তিনি তার কবিতায় সরাসরি ব্যবহার করেছেন। ইতিহাস, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে মানব জীবনের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয় তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষনে তুলে এনেছেন তার কবিতায়।
দাতব্য সেবা, সৃষ্টার অনুভূতি, ধৈর্য, ভালোবাসার মাধ্যমে সহনশীলতার ৮০০ বছর পরও লাখ লাখ পাঠককে বিমোহিত করছে, আন্দোলিত করছে আধ্মাত্মিক জগতের চিন্তা-চেতনা।
তেরো শতাব্দীর ফার্সি কবি, দার্শনিক, সূফী, জালালুদ্দিন রুমির জন্ম ৩০ সেপ্টেম্বর, ১২০৭ সালে আফগানিস্তানে। ১২১৫ থেকে ১২২০ সালের মধ্যে সপরিবারে বর্তমান তুরস্কে যান। তার অধিকাংশ লেখা পারসিক ভাষায় হলেও, তুর্কী, অ্যারাবিক ও গ্রীক ভাষাও তিনি ব্যবহার করেছেন। রুমির শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ‘মসনবী’, যাতে প্রায় ফার্সি সাহিত্য হিসেবে ২৭০০০ লাইন রয়েছে। তার অন্য আরেকটি সাড়া জাগানো ও গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে ‘দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ’। এর বাইরেও তিনি আনুমানিক ৩৫০০০ ফার্সি শ্লোক এবং ২০০০ ফার্সি রুবাইয়াৎ লিখেছেন। সম্ভবত বর্তমান বিশ্বের কবিতার সর্বাধিক বিক্রিত বই রুমির।
প্রায় পঞ্চাশের অধিক ভাষায় তার কবিতা অনুদিত হয়েছে। গত শতাব্দীর শেষদিকে পাশ্চাত্যে রুমির কবিতার অনুবাদের পর থেকে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। Harper One প্রকাশিত ‘Essential Rumi’ বইটি সারা বিশ্বে ২৩টি ভাষায় দুই মিলিয়নের অধিক কপি বিক্রি হয়। রুমির কবিতা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কোলম্যান বার্কসের অনুবাদের পর থেকে। ইউনেস্কো ২০০৭ সালে তার নামে একটি মেডেল চালু করে এবং ঐ বছরকে ‘আন্তর্জাতিক রুমি বছর’ হিসেবে ঘোষণা করে। আমেরিকার লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিনেমা, গল্প, উপন্যাসে যুক্ত হচ্ছে রুমির সাহিত্যকর্ম। প্রায় ১২টি দেশের জাতীয় কবিরা তার কবিতা দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত। এর মধ্যে বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম এবং পাকিস্তানের স্যার আল্লামা ইকবাল অন্যতম।
‘তুমিই রহমতের জলধারা, ভেজাও নিয়ত আমাদের
তুমি প্রবহমান বাতাস, আমরা তো ধূলিকণামাত্র
সকলেই দেখে নড়াচড়া, ওড়াওড়ি, ধুলিঝড়ের
অদেখা বায়ুর মতো প্রবাহিত তুমি অহোরাত্র।’
(তুমিই আনন্দ- জালালুদ্দিন রুমি)
বিধাতার অপার রহস্য সবাই দেখতে পায় না। দেখতে হলে দেখার মত তৃতীয় চোখ লাগে। তাইতো আধ্মাত্বিক কবি জালালুদ্দিন রুমি বলেন-
‘অনন্ত অসীম তার রূপের বাহার
সে-ই শুধু দেখে, আছে যার দৃষ্টি দেখার।’
(সুন্দর যে দেখে... জালালুদ্দিন রুমি)
জালালুদ্দিন রুমির কবিতার সতেজ ভাষা এবং ছন্দ সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তার প্রতিটি শব্দ শুনে মনে হয় এগুলো সাধারণ ভাষা নয়, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ভাষা। তিনি তার কবিতা বা গজল লেখার অনুপ্রেরণা পেতেন তার পারিপার্শ্বিকতা থেকেই। কখনো বা রাখালের বাজানো বাঁশির সুর শুনে, কখনো ঢাকের আওয়াজ শুনে। প্রায়ই তিনি কবিতা বা গান রচনা করার সময় অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। কখনো কখনো তিনি তার গজলগুলোর সাথে এতটাই একাত্ম সাথে হয়ে যেতেন যে গভীর মগ্নভাবে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করতেন। তার নাচ দেখে মনে হতো, নাচের মাঝেই অন্য কোনো জগতে চলে গিয়েছেন, বাস্তব জগতের সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি নাচতেন, যখন তিনি সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার সাথে একাত্মতা অনুভব করতেন। তার নাচ তার কাছে একধরনের ইবাদত ছিল। তিনি বলেছিলেন-
‘আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি
যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে।
তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে,
এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।’
তিনি বিশ্বাস করতেন ভালোবাসাই সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম পন্থা। এজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘স্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর অজস্র পথ আছে। তার মাঝে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম।
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে তার বাণীতে তিনি বলেছেন-
‘প্রেমই মুক্তি, প্রেমই শক্তি, প্রেমই পরিবর্তনের গুপ্তশক্তি, প্রেমই দিব্য সৌন্দর্যের দর্পণ স্বরূপ!’
তাইতো তিনি লিখেছেন- ‘
আমার প্রথম প্রেমের গল্প শোনামাত্র তোমাকে খুঁজতে থাকি! কিন্তু জানি না ওটা কতটা অন্ধ ছিল। প্রেম আসলে কোথাও মিলিত হয় না। সারাজীবন এটা সবকিছুতে বিরাজ করে।’
তিনি বলেন-
‘আমি আমার জন্য মরে গেছি এবং বেঁচে আছি তোমার কারণে।’
তিনি আরো লেখেন-
‘যদি তুমি কারো হৃদয়কে জয় করতে চাও, তাহলে প্রথমে অন্তরে ভালোবাসার বীজ রোপণ করো। আর যদি তুমি জান্নাত পেতে চাও তাহলে অন্যের পথে কাঁটা বিছানো ছেড়ে দাও।’
রুমির জানাজায় অংশ নিতে প্রায় সব ধর্মের মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, রুমির কবিতা তাদের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আরও গভীরভাবে বিশ্বাসী করে তুলেছে। রুমির কবিতার শক্তি এ জায়গাতেই। বিশ্বব্যাপী ধর্ম-বর্ণের যে বিরোধ আর সংঘাত, রুমির কবিতা তা মুছে দেয়।
তাইতো তিনি লিখেছিলেন-
‘ভুলে যাও বিশ্বের সব জাতি, ধর্ম, বর্ণের সকল ভেদা ভেদ। কেবল নিজের লক্ষ্য ও গন্তব্য ঠিক করে নাও। মনে রেখ তুমি হলে একটি আত্মা আর তোমার কর্ম হল শুধুই ভালবেসে যাওয়া।’
তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ কোনো মসজিদ বা গির্জার পাওয়া সম্ভব নয়, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করতে হয় নিজের হৃদয়ে। সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন-
‘আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছিলাম। তাই আমি মন্দিরে গেলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম না। আমি গির্জায় গেলাম, সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি মসজিদে গেলাম সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি নিজের হৃদয়ে তাকে খুঁজলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম।’