ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্বসাধন সিদ্ধি হয় তার। মানুষ ভোজনই বাউল দর্শনের মূল তত্ত্ব। মানুষ ভোজনই ছিল লালন সাঁইয়েরও মূল তত্ত্ব। এই মানবসেবক লালন সাঁই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি, যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে একজন বাউল সাধক, মানবতাবাদী এবং দার্শনিক ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। লালন ফকিরের জীবন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে, তার নিজের রচিত অসংখ্য গান রয়েছে। লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝেই একটা মনের মানুষ বাস করে। তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। তার মত ও পথ উভয়ই মানব দর্শনের পরিপূরক এবং নামান্তর। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে স্থান দিয়েছেন। তার এই দর্শন প্রচারের জন্য তিনি শিল্পকে বেছে নিয়েছেন। তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। লালনের গানের গূঢ়তত্ত্ব হচ্ছে মানুষ ভজা। অথচ জাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও কালের ভিন্নতায় পৃথিবীজুড়ে যুগে যুগে মানুষের মধ্যে দ্বন্ধ, সংঘাত ও ভেদাভেদ তৈরি হয়ে আসছে। সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মাঝেও সোচ্চার ছিলেন লালন সাঁই। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি ভেদের বিপরীতে তিনি বলেছিলেন, মানুষের নাই জাতের বিচার-এক এক দেশেই এক এক আচার। লালন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মাকে। তার মতে, আত্মাকে জানলেই সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। ‘মানুষের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা’ এটাই লালন দর্শনের অন্যতম প্রধান মতবাদ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে ধর্মীয় শোষণ ও সামাজিক অবিচার সমাজের গভীরে শেকড় বিস্তার করেছিল। শাক্ত পদাবলীতে সাধকদের আকৃতির মধ্যে তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই অবিচার ও শোষণের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই বাউল সাধক কোনো দেবতার আশ্রয়কে নয়, মনের মানুষকে খুঁজেছেন। সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এসে বাউল সম্রাট লালন অখণ্ড মানবতার আদর্শ প্রচার করেছেন। উপলব্ধি করেছেন জীবনের পরম সত্য চিরকালের মানুষকে। তাইতো লালন বলেছেন, ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার’। লালনের আদর্শ মেনেই সমকালীন নানা আচার সংস্কারে আবদ্ধ ও ভেদাভেদ খণ্ডছিন্ন এবং অপমানে অত্যাচারে দুর্গত মানুষের মধ্যে জেগেছে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়। গড়ে উঠেছে নিবিড় ঐক্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।