রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের ঢাকাগামী প্লেনটি। আকাশী নীল টি-শার্ট আর কালো জিন্স পরা নীরু বেশ উৎফুল্ল মন নিয়ে প্লেনে বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হয়ে ওঠে। বিমানটি যেই আকাশে ওড়ে নিরুর চোখে ভাসতে থাকে
বাংলাদেশের শরতের দৃশ্যপট। মনে পড়তে থাকে উঠানের শিউলি গাছ, কীর্তনখোলার বুকে পালতোলা নৌকা, মায়ের বানানো তালবড়া, বিস্কিসিদ্ধ আরও অনেককিছু। সাথে সাথেই মনে পড়ে শিহাবের কথা। কী দারুণ গানের গলা শিহাবের। ফুপুরা এলে প্রায় রাতের আড্ডায়ই শিহাব দরাজ গলায় গাইত- ওরে নীল দরিয়া...। নিরু চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেত শিহাবের চোখের ঝিলিক। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক নীরুর পেট একেবারে মেদহীন আজও। নাসার বিজ্ঞানী স্বামী এবার একা দেশে আসতে কিছুটা আপত্তি জানিয়েছিল। নিরু বলেছে- প্রায় চার শরত আমি দেশে যাইনি এবার আমাকে যেতেই হবে সুইটু, মেরি বেবি! আসাদ একটু দুষ্ট হাসি দিয়ে বলেছে- শরত আর হেড মাস্টার দুইই তোমার ভীষণ প্রিয় তাই না! নীরু যেন শুনতেই পায়নি এমন নির্বিকার থেকেছে।
০২
নিরু চোখ লেপ্টে কাজল পরেছে। তার পাশে বসা ভদ্রলোক এরইমধ্যে নিরুর প্রসংশা করেছে। এই বয়সে এসে এসব নুলো প্রসংশা নিরুকে একেবারে টানে না। নিরুর চোখ যে ভীষণ সুন্দর একথা শিহাব একজীবনে অনেকবার বলেছে। অনেকবারই নিরু কাজল আর কালো টিপ গিফট পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত মানুষের কাছ থেকে।
ভাবনার অতলে ডুব দেয় নিরু। জীবন যে কী রহস্যময়!
কী চেয়েছিল নিরু, আর কী হল! কত ভালো ছাত্র ছিল সিহাব! ওর খাতায় কোনোদিন কোনো স্যার দাগ কাটতে পারত না! এসএসসি এবং এইচএসসি দুটোতেই সিহাবের গোল্ডেন এ+। কিন্তু হায় নিয়তি! হঠাৎই ফুপা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন। শিহাবের ছোট দুই ভাই, একবোন আর বৃদ্ধ দাদী। শিহাব তখন চোখে অন্ধকার দেখছে! মনে পড়ে যায় নিরুর- একদিন কাকভোরে মিরা ফুপু এসেছিল বাবার কাছে। এসে বলেছিল- ভাই তুমি তো কাকাশুরা হাইস্কুলের কমিটির চেয়ারম্যান। তুমি শিহাবরে স্কুলে চাকরি দিয়া দেও। নাইলে আমি পোলাপান লইয়া বাঁচমু কেমনে?
মা সবসময় মীরা ফুপুকে নিয়ে বাবাকে খোঁচা দিতেন।
মা বলতেন- বাবার এই চাচাতো বোনের সাথে নাকি বাবার প্রেম ছিল। বাবা মিরা ফুপুর চাইতে মাত্র দুই বছরের বড়। খুব সুন্দরী মিরা ফুপুকে মেট্টিক পাস করেই তার বাবা-মা বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মীরা ফুপু সবসময়ই আমাদের নারকেলের নাড়ু, তালের বড়া, খেজুরের গুড় এটাসেটা দিতেই থাকতো।
নিরুর বাবা বরিশাল সরকারি কলেজের গনিতের অধ্যাপক ছিলেন। তার প্রচেষ্টায়ই শিহাবের চাকরি হয় স্কুলে। এরপর শিহাব বিএসসি করেছে, বিএড করেছে। এখন শিহাব কাকাশুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হেড মাস্টার। মনে মনে নিরু সেই নবম শ্রেণির কথা ভাবে- যেদিন শিহাব একজোড়া রূপার নুপুর ওর পায়ে পারিয়ে দিয়ে প্রপোজ করেছিল। হঠাৎই নিরুপায়ের দিকে তাকায় তারপর আর কোনোদিন নিরু অই নুপুর খুলে ফেলেনি। মনে পড়ে খুব- যেদিন স্কুলে যোগদান করে শিহাব তার আগেরদিনের কথা। কেমন হু হু করে কেঁদে উঠেছিল শিহাব! নিরু সেদিন কিছুতেই বুঝতে পারেনি শিহাব কেন কেঁদেছিল! বুঝেছে বহু পরে।
০৩.
স্মৃতির স্রোতে ভাসতে ভাসতে নিরু পৌঁছে যায় ঢাকায়।
এয়ারপোর্ট থেকে ধানমন্ডি ভাইয়ের বাসায় যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। তারপর বাসায় এসে লোডশেডিং। একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে নিরু। যাহোক এবার বরিশাল যাবার পালা। নিরুর ভাই বিসিএস ট্যাক্স অফিসার। ব্যবস্থা করেছে সার্কিট হাউসে থাকার। নিলয় জিজ্ঞেস করেছে নিরুকে পদ্মাসেতু হয়ে গাড়িতে যাবে কি না? নিরু বলেছে লঞ্চে যাবে। পারাবত-৭ এ উঠে চেপে বসে নিরু। পদ্মার ঢেউয়ের সাথে দ্বিগুণ পাল্লা দিয়ে বাড়ে নিরুর হৃদয়ের স্রোত। নিরবধি পাড় ভাঙে সে। মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় এসেছিল শিহাবের সাথে।
এমনই এক জোছনা স্ন্যাত শরতের রমণীয় রাত ছিল সেদিনও। শিহাব সেদিন নিরুর আব্দার মেনে সারারাত লঞ্চের ব্যালকনিতে বসে আবৃত্তি শুনিয়েছে, গান শুনিয়েছে। কী যে গমগমে গলা শিহাবের! আর কী যে ব্যক্তিত্বের ধার! একটাবারও শিহাব নিরুর হাতটাও ছুঁয়ে দেখেনি। বরং নিরুই গিয়ে কয়েকবার ছুঁয়ে দিয়েছে শিহাবের ঘন-কালো চুল। শিহাব কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যেদিন বাবার বুয়েট পড়ুয়া ছাত্র আসাদের সাথে বিয়ে ঠিক হয় সেদিন মীরা ফুপু খুব কেঁদেছিল। মীরা ফুপু নিরুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- সবই আমার কপাল! কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল- পৃথিবীর সব সুখ তোর হোক মা! আমার শিহাবের সাথে যোগাযোগটা রাখিস। শিহাব সারাদিন বিয়ের সমস্ত এরেঞ্জমেন্ট করেছিল কিন্তু একটা দানাও মুখে না দিয়ে চলে যায়।
বাবাও সবটা বুঝেই শিহাবকে খেতে জোর করেনি।
তার আগের রাতে বহুকষ্টে নিরু দেখা করেছিল শিউলি তলায়, কাঁদতে কাঁদতে নিরুর ওষ্ঠজোড়া ছুঁয়ে দিয়েছিল শিহাবের বুক। সেখানে নিরু পেয়েছিল তাজা শিউলির ঘ্রাণ। আর শিহাব তপ্ত নিঃশ্বাসে ছুঁয়েছিল নিরুর চোখ।
০৪.
বরিশাল পৌঁছে সকালেই লঞ্চঘাটে শিহাবকে পায় নিরু।
অনেক বুড়িয়ে গেছে সে। নিরু একটু অবাক হয় শিহাবকে দেখে। বরিশাল শহরটা আজও পরিচ্ছন্ন সুন্দর। বিলে-ঝিলে ফুটেছে প্রচুর পদ্ম, সারা শহর জুড়ে সবুজের সমারোহ।
সারাদিন বরিশাল ম্যারিন একাডেমি, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বিবি পুস্করিণীর পাড় সব ঘুরে নিরুকে শিহাব নিয়ে যায় গ্রামের বাড়ি সাপানিয়া। তিনদিন শিহাবের দুই মেয়ে আর ওর স্ত্রীর ভালোবাসা আর আন্তরিক আপ্যায়নে নিরু একেবারে প্লাবিত হয়ে যায়। শিহাবের বৌ তালের বড়া, ইলিশ, চালের রুটি হাঁস সবকিছু করে খাইয়েছে।
ইলিশ-পান্তা সাথে ডালের বড়া সবই করে খাইয়েছে। নীরু মশকরা করে বলেছে- বুঝছি তুমি হিংসা কর! আমারে মোটা বানানোর জন্য এতসব খাওয়াচ্ছো! শিহাবের বউ নিরুত্তর মিষ্টি হেসেছে। বারো আর চৌদ্দ বছরের দুই মেয়ে শিউলি আর রঙ্গনের কাছে নিরু জানতে পারে - করোনাকালীল সময়ে অনেক ছাত্র ঝরে গেছে স্কুল থেকে। আরো জানতে পারে শিহাবের অর্থনৈতিক সংকটের কথা, শিহাবের হার্টের অসুখের কথা।
চলে আসার আগেরদিন নিরু শিহাবকে জানায় সে স্কুলে প্রাঙ্গণে একটা শিউলি চারা লাগাতে চায়। ব্যবস্থা করে শিহাব। গাছ লাগিয়ে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয় নিরুর নাম লেখা প্লাকার্ড। লঞ্চে উঠে জোর করে শিহাবের পকেটে ঢুকিয়ে দেয় একলক্ষ টাকা। আর ভালো করে চিকিৎসা করাতে বলে, নিরু তাকিয়ে দেখে শিহাবকে খুব ক্লিশে দেখাছে। শিহাব নিরুর হাতে তুলে দেয় একটা আকাশী নীল রঙের শাড়ি। সাথে একটা স্মিত হাসি দিয়ে বলে- ভেতরে তোর পছন্দের কাচের চুড়িও আছে।
০৫.
সদরঘাটে অনেক আলো। কিন্তু এই গল্পের নায়িকার মনে কীর্তনখোলার চাইতেও বেশি উথাল-পাতাল স্রোত। কখনো কখনো একটা মুহূর্ত জীবনের সব প্রাপ্তিকে উল্টেপাল্টে দেয়। মনে হয়- এই জীবন মিথ্যা। মিথ্যা দিয়ে সাজানো জীবনের সব প্রাপ্তি মিথ্যা। তেমনি নীরু ভাবে যে জীবন তার যাপন করার কথা ছিল তা ভেসে গেছে কোনো এক বন্যার তোড়ে...
লঞ্চের সামনের দিকের ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে আছে নিরু, নীচে সদরঘাটে শিহাব। ছেড়ে দিয়েছে লঞ্চ। ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে শিহাব। নিরুর চোখ জোড়া ছলছল করছে আর ভাবছে- আবার দেখা হবে তো শিহাব!