যৌতুকের বলি

ফারুক আহম্মেদ জীবন

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রূপসী বাংলার যশোর জেলার ঝিকরগাছার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিরসবুজে ঘেরা গাঁ নারাংগালী। সে গাঁয়েরই এক বর্গাচাষি নাম ধনী। তারই উঠতি বয়সী ১২-১৩ বছরের কৃষ্ণ বরণ কিশোরী এক মেয়ে চৈতী। যার দেহের রঙটা কালো। কিন্তু দেহের রঙ কালো হলে কি হবে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট বেলুনে বলা দেহের গড়ন তার। মুখশ্রীও বেশ গোলগাল আকর্ষণীয়। আর মুক্তার মত গালে ঝকঝকে সারি বাঁধানো দাঁত। হাস্যউজ্জ্বল, চঞ্চলা, দূরান্তমনার এক বালিকা। সারাদিন যার এ গাছে ও গাছে চড়ে বেড়ানো আর গায়ের সারা পাড়া ঘুরে দাপিয়ে বেড়ানো অভ্যাস। সে গুনগুন করে গান গাই। আর তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে নেচে এ গাছের ফল ও গাছের ফল পেড়ে খায় আর মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। গাঁয়ে চলার মেঠো পথে যখন যার সাথে দেখা হয়, সে হেসে বলে কি দাদু ভালো তো? কি দাদী ভালো আছ? চাচা কেমন আছ? চাচি তোমার শরীর কেমন আছে? কিরে ছোট? কিরে পিচ্চি ভালো আছিস? এভাবে হেসে হেসে সকলের সাথে সে কথা বলে। কখনো কেউ তার মুখে দুঃখের কালো মেঘ দেখতে পাই না। গাঁয়ের লোকজন কমবেশি সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। তবে কোন কোন হিংসুটে পুরুষ-মহিলারা আবার হিংসাও করে।

সত্যি বলতে...

‘এই সমাজে ভালো মানুষের বড় অভাব...

আর কুচক্রী নিন্দে ভর্ৎসনা করাটাই যেনো স্বভাব।

এমন বহু মানুষ আছে...

যারা অপরের হাসি মুখ, সুখ সৈহ্য করতে পারে না।

কিন্তু কারোর চোখে জল দুঃখ-কষ্ট দেখলে

তাদের মনে যেনো আর আনন্দ ধরে না।

তেমনি চৈতীকে দেখে গাঁয়ের কোন কোন মহিলা মুখ ভ্যাংচিকেটে বলে হুম...ধনীর একটা মেয়ে হয়েছে বটে।

ধুমড়ি মেয়ে একটা। মেয়ে তো নয়, যেনো একটা গ্যাঁচো ইঁদুর। আবার কেউ কেউ বলে গাছ বাওয়া একটা কাঠবিড়ালি।

সারাদিন কাঠবিড়ালির মত শুধু পরের গাছ বেয়ে বেড়ায়। বলি, ধনী কেনো যে অমন ধুমড়ি মেয়েটাকে বিয়ে দেয় না, কে জানে? চৈতী কারোর কোনো কথা কানে করে না। শুনে হেসে উড়িয়ে দেয়।

এ বছর সে তার নারাংগালী গাঁয়ের পাশের গ্রাম পানিসারার সুরুজজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। কিন্তু বয়সের তুলনায় চৈতী বেশ দাওড়াচাওড়া আর উঁচু লম্বা হয়ে উঠেছে। একদিন গাঁয়ের একটা মধ্যবয়সী লোক, নাম কালু সে ধনীর বাড়িতে এসে বলে...

‘বাপু, তোমার জন্য যে আমাদের গাঁয়ের

গেলো সব কুল, মান, জাত’

বুঝিনে বাপু, ধাঙ্গড় মেয়ে ঘরে রেখে তুমি

কি করে যে মুখে তোলো ভাত?

এভাবে আরো নানান লোকে নানান কথা বলতে থাকে। আরেকদিন একটা কুটনী বুড়ী, যার গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষের খুঁচা মারা আর এর বাড়ির কথা ও বাড়ি বলে বেড়ানো স্বভাব। সেও মুখ ঝামটি কেটে চৈতীর মাকে বললো...বাপু মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারো না শুনি? নাকি ঘরের খুঁটি করে বাড়িতেই রেখে দেবে হুম...? চৈতীর মা শুনে কোনো কথা বলে না। এভাবে ধনীর স্ত্রী পূর্ণবতী গাঁয়ের পাঁচজনার পাঁচ কথা শুনতে শুনতে একসময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

সে রাতে শোয়ার সময় চৈতীর বাবা ধনীকে বলে। ওগো, এভাবে তো গাঁয়ের মানুষের কথা শুনে আর পারা যায় না। তারচেয়ে একটা ছেলে দেখে মেয়ে চৈতীকে বিয়ে দিয়ে দাও। শুনে ধনী বললো, বিয়ে বললেই তো আর বিয়ে দেয়া যায় না তাইনা? বিয়েতে তো একটা মোটা অংকের খরচণ্ডখরচারও ব্যাপার-স্যাপার আছে।

আসলে....

‘চৈতীর বাবা নামেই যা- শুধু ধনী,

অথচ ধনদৌলত বলতে কোন কিছুই তার নেই।

‘পরের জমি বর্গা চাষ করে আর গাঁয়ের মানুষের

ক্ষেতখামারে জনমজুরী খেটে স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে কোন রকম তার টানাপড়নের সংসারটা চলে।

তবু, রাতে যখন তার স্ত্রী পূর্ণ বতী মেয়েকে বিয়ে

দেওয়ার কথা বললো। ধনী বললো, চৈতীর মা,

তুমি যে চৈতীকে বিয়ে দিতে বলছো...। কতোই-বা বয়স হয়েছে মেয়েটার বলো? আর তাছাড়া ওর এখন কিশোরী মন। এখনো ওর ছেলে মানুষী যায়নি। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি সংসার বোঝার মতো বয়স কি এখনো ওর হয়েছে বলো? এই বয়সে বিয়ে দেয়াটাকে যে বাল্যবিবাহ বলে। পূর্ণ বতী বললো, সেতো ঠিক আছে; কিন্তু গাঁয়ের মানুষের পাঁচজনের পাঁচ কথা শুনে তো আর পারা যাচ্ছে না। আর তাছাড়া বিয়ে দিলে দেখবে আস্তে আস্তে সব বুঝে যাবে। আমিও তো কোন ছোট্টকালে এ ঘরে এসেছি তোমার বউ হয়ে। কই! আমি কি সংসার করছি না?

ধনী বললো, ঠিক আছে তুমি যখন বলছো। কাল

ঘটককে একটা ভালো সম্বন্ধ আনতে বলে দেবো।

পরদিন সকালে ঘটক কুতুবউদ্দিনকে বললো। সে

যেনো একটা ভালো ছেলে দ্যাখে তার মেয়ের জন্য। এরপর থেকে মাঝেমধ্যে ঘটক কুতুবউদ্দিন

এক একটা সম্বন্ধ নিয়ে ছেলে পক্ষের লোকজন নিয়ে হাজির হয় ধনীর বাড়ি। দেখা, মতামত নাস্তা পর্ব শেষ হলে দেনা-পাওনা, মানে যৌতুক নিয়ে দরকষাকষি চলে। কিন্তু সব ধনীর সাধ্য সামর্থ্যরে বাইরে হওয়ায় বিয়ে আর হয়ে ওঠে না। সর্বশেষে

চৈতীর মা-বাপ দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো। মেয়ে

তাদের কালো। মোটা যৌতুক ছাড়া কেউ মেয়েকে

বিয়ে করবে না। তাই তার নিজের যে ১০ কাঠা জমি আছে। সেটুকুই সে বন্ধক রেখে মেয়ে চৈতীর বিয়ে দেবে। ধনীর যেকথা সেই কাজ। তারপরদিন ঘটককে বললো...শেষে যে পাত্র নিয়ে এসেছিল তাদের গার্জেন পক্ষদের নিয়ে আসতে। সে তাদের দেনা-পাওনার বিষয় কথা বলবে। ঘটক দুদিন পরেই ছেলের গার্জেন পক্ষকে নিয়ে আসলো ধনীর কাছে। দেনাপাওনার কথা উঠতেই ছেলের বাপ হেসে বললো...খুব বেশি কিছু দিতে হবে না বুঝলেন বেয়াই মশাই?

এই ধরুন সাংসারিক টুকিটাকি যেসব লাগে আর কি... যেমন থালাবাসন, হাঁড়িকুঁড়ি, কাঁথা বালিশ, আর আমার ছেলের বহু দিনের শখ একটা নতুন মোটরসাইকেল চড়ার। আর ৫০ হাজার মতো টাকা দিলেই হবে বুঝলেন? চৈতীর বাবা ধনী বললো জ্বি বুঝেছি। চৈতীর বাবা ধনী রাজি হয়ে গেলো দিতে। তবে সে ৫০ হাজার টাকা বিয়ের কিছুদিন পরে দিবে বলে সময় নিলো ছেলের বাপের কাছে। দুদিন পর শুক্রবার চৈতীর বিয়ে।

বিয়ের কথা শুনে চৈতী কান্না শুরু করেছে। এতো দিন গাঁয়ের লোকজন যারা চৈতীর মুখে হাসি দেখতো। এই প্রথম তারা চৈতীকে কান্না করতে দেখলো। এদিকে চৈতীর বাবা ধনী তার দশ কাঠা জমি গাঁয়ের টাকা-ওয়ালা একজনের কাছে বন্দক থুয়ে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিলো। দুই চারটি আত্মীয় ঘরের লোকজন। আর গাঁয়ের কিছু গণ্যমান্য লোকজনকে দাওয়াত দিলো ধনী।

গতকাল শুক্রবার বিয়ের দিন সকালে চৈতীকে বেনারসি শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে বউ সাজানো হয়েছে। বাড়িভর্তি লোকজন। চৈতীর বয়সী তার গাঁয়ের সখিরাও এসেছে। দুপুরের আগেই বরযাত্রী চলে এলো সব। বর এসেছে বর এসেছে বলে হৈ-হুল্লোড় করে চেচামেচি করতে লাগলো। জুমার নামাজের পর কাজি সাহেব চলে এলো বিয়ে পড়াতে। তারপর বিয়ে হয়ে গেলো চৈতীর। বিয়ের পর বরপক্ষের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। খাওয়া শেষ হলে তারা সব গাড়িতে গিয়ে বসলো। চৈতী বিদায়কালে মা-বাবাকে ধরে অনেক কান্না-কাটি করতে লাগলো। তারপর একসময় বরের হাত ধরে বউ সাজে নতুন এক সংসারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো গাড়িতে। বিয়ের ফুলশয্যা থেকে শুরু করে কয়েকটি মাস বেশ সুখেই কাটতে লাগলো চৈতীর সংসার জীবন। তারপরেই চৈতীর জীবনে কাল হলো যৌতুকের বাকি ৫০ হাজার টাকা। উঠতে বসতে খেতে চৈতীর শ্বশুর-শাশুড়ি কমবেশ ছোট-বড় কটু কথা বলতে থাকে। চৈতীর স্বামী স্বজলও আগের মতো এখন আর চৈতীকে ভালো-বাসে না। মাঝেমধ্যে মারধর করে চৈতীকে।

চৈতী কিছু না বললেও, ধনী মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে মেয়ে চৈতীর মুখ দেখে যা-বুঝার বুঝতে পারে যে, মেয়ে তার সুখি নেই। কি করবে ধনী বাড়ি ফিরে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু কোথাও সে টাকা জোগাড় করতে পারে না। এদিকে চৈতী দিনের পর দিন শ্বশুর-শাশুড়ির পচা কথা আর স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

দিনকে দিন দেহের হাড় বেরিয়ে জীর্ণশীর্ণ হয়ে যায়। কথায় আছে...শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ দেবররা যদিও খারাপ হয়, স্বামী ভালো হলে মেয়েরা বেঁচে থাকার অন্তত অবলম্বন খুঁজে পাই। কেননা, সারাদিন সংসারের ঝামেলা শেষে নারীরা স্বামীর বুকে মাথা রেখে সমস্ত দুঃখগুলো ভুলে যায়। কিন্তু, কপালপোড়া হতভাগি চৈতীর সেই আশ্রয়- টুকুও নেই। একদিন ওর শশুর-শাশুড়ি চৈতীকে মা-বাবা তুলে ছোটলোকের জাত, ফকির নানান কথা বলে গালমন্দ করে। চৈতী সহ্য না করতে পেরে দুই একটি কথা বলে প্রতিবাদ করে। রেগে স্বজল বেদম মারধর করে চৈতীকে।

ধৈর্য হারা হয়ে চৈতী ঘরে গিয়ে নিজের গলায় ফাঁস দেয়। তাৎক্ষণিক মারা যায় চৈতী। এ সংবাদ ধনীর কাছে পৌঁছালে পাগলের মতো কান্নাকাটি করতে থাকে চৈতীর মা-পূর্ণ বতী আর বাবা ধনী। আর আহাজারি করে বলতে থাকে, ও আল্লাহ আমাদের একি হলো? আমরা মেয়েটা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে মেরে ফেললাম। কেনো যে, যৌতুকের শর্তে রাজি হয়ে বিয়ে দিলাম আমাদের মেয়ে? একসময় থানা থেকে পুলিশ এলো। চৈতীর লাশ নিয়ে গেলো পুলিশ কভার ভানে। তারপর লাশ পোস্টমর্টম করার পর চৈতীকে দাফন করা হলো। এভাবে অকাল বাল্যবিবাহ আর যৌতুকের লোভের বশবর্তীর শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে গেল নিষ্পাপ হাসিখুশি ভরা ফুলের মতো চৈতী নামের একটা মেয়ের জীবন।