লে খকরা তাদের লেখার ইন্দ্রজালে পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। এ শৈল্পিক কাজটি যারা খুব দক্ষতার সাথে করতে পারেন, তারা দখল করেন পাঠকদের হৃদয়। সাহিত্যের যেমন নানা শাখা-প্রশাখা রয়েছে, তেমনি সাহিত্য সমালোচনারও রয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতি। সাহিত্য পাঠের পরপরই শুরু হয় সাহিত্যের মূল্যায়ন-আলোচনা-সমালোচনা। বাংলা সাহিত্য সমালোচনার পথ উন্মুক্ত করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা যেমন হাজার বছর ধরে বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে, তেমনি বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের বয়স কম হলেও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ব্যক্তি-গ্রন্থ-লেখার সমালোচনা করার পূর্বে অবশ্যই আলোচক বা সমালোচককে নিখুঁতভাবে সমালোচনার বিষয় নিয়ে ব্যাপক জানতে হয় পড়তে হয়। মনগড়া সমালোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। একজন সমালোচক লেখকের বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলো আলোচনা করেন। একজন পাঠকের পড়া আর একজন সমালোচকের পড়া এক নয়। এ দুইয়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ভিকো তার বিখ্যাত গ্রন্থ লা সিনজানুভায় সাহিত্যের মূল্যায়ন সম্পর্কে বলেছেন- যদি ইলিয়াড-ওডিসিকে জানতে হয় তাহলে হোমারের সমকালকে জানতে হবে। কারণ- শিল্পের সাথে শিল্পীকেও জানতে হয়।
প্রমথ চৌধুরীর মতে- সমালোচককে থাকতে হয় নিরপেক্ষ, ব্যক্তিগত রাগ-বিদ্বেষ-হিংসার বা প্রেমের বশবর্তী হয়ে সাহিত্য সমালোচনা করা যাবে না। তাহলে সাহিত্যের মান নিরূপণ করা যাবে না। অনুরাগ বা বিরাগ কাব্য জগতের বিষয় নয়। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা- যে সমাজে বা দেশে নির্ভয়ে করা যায়, সে দেশে তৈরি হয় সৃজনশীল মানুষ। বিশেষ করে সাহিত্যের সমালোচনা লেখকদের দর্পণ। সমালোচনার আয়নায় নিজের লেখাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা যায়। লেখকরা পাঠক তৈরি করেন পাঠকদের সমর্থন পেয়ে লেখকরা ক্রমাগত লিখছেন। বর্তমান সময়ে মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। যার ফলে লেখকদের সাথে পাঠকদের খুব সহজেই যোগাযোগ হয়।
লেখকের প্রতিটি আপডেট ভার্চুয়াল টাইমলাইন থেকে সহজেই জানতে পারেন। লেখকরা কালকে শব্দের মাধ্যমে ধারণ করেন স্বদেশের মুখ বর্ণমালা দিয়ে আঁকেন। পাঠকরা তা পাঠ করে হন বিমুগ্ধ। কিন্তু বাধ সাধে তখন- যখন কোনো পাঠক-লেখকের লেখা পাঠ করে নেতিবাচক সমালোচনা করেন। অনেক লেখকই সহজে নেতিবাচক সমালোচনা মেনে নিতে পারেন না। অনেক লেখককে ভার্চুয়ালে এই বলে ঘোষণা দিতে দেখেছি- আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারি; কিন্তু সমালোচনা একদম সহ্য করতে পারি না। অনেক সময় দেখা যায় সমালোচকের প্রশংসা না করে তাকে তিরস্কার করা হয়। সমালোচকের গুণ না হয়ে সেটি দোষে পরিণত হয়।
আমরা বিভিন্ন সময় লেখকের ফেসবুক ওয়ালে দেখতে পাই তারা ভার্চুয়াল গরম রাখার জন্য মাঝে মাঝে অস্পষ্ট চুটকি সমালোচনা করেন কিন্তু এই অস্পষ্ট চুটকি সমালোচনাটুকুই যদি পেশাদারিত্বের সাথে গঠনমূলক সমালোচনায় পরিণত করতেন তাহলে এই সমালোচনাগুলো সাহিত্যের জন্য আরো উপকার হতো। এ সময়ের অধিকাংশ গ্রন্থ আলোচনা শুধু লেখকের লেখার প্রশংসা ও তেলমর্দনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সমালোচক ও লেখকের সম্পর্ক পীর-মুরিদের ন্যায় হওয়া উচিত নয়। পীর যা বলবে মুরিদ শুধু জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর করবে! লেখকদের লেখার সমালোচনা হজম করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হয়।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর পূবের হওয়া কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর মাঘ ১৩৩২ সংখ্যা প্রবাসীতে একটি সমালোচনা প্রকাশ হয়। পূবের হাওয়া (কবিতার বই)- কাজী নজরুল ইসলাম। ডি এম লাইব্রেরি। দাম পাঁচ সিকা। বইখানির বাঁধন এবং ছাপা বেশ ভালো। কবিতাগুলো একেই অর্থহীন। তাহার উপর ছাপার ভুলে কতগুলো একেবারে অপাঠ্য হইয়াছে। কবি নজরুলের পূর্বপ্রকাশিত অনেক কবিতা অর্থহীন হইলেও ছন্দগুনে সুখপাঠ্য ছিল, আলোচ্য কবিতাণ্ড পুস্তকে ছন্দকে কোতল করা হইয়াছে- একে অর্থহীন তাহার উপর ছন্দহীন, অর্থাৎ গ-স্যোপরি বিস্ফোটং। যেখানে কোনো অনুপ্রেরণা নাই, সেখানে কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে কবিতার বই ছাপানোর মতো বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে? এমন সমালোচনা প্রকাশ হওয়ার পরও কবিকে এসব মাথায় না নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে হাজার হাজার লেখক রয়েছে যদি তাদের গ্রন্থের এমন একটি সমালোচনা কোনো একটি দৈনিকে প্রকাশ হতো একবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন- লেখকদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারত? সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো একটি লেখা বা কোনো একটি কবিতার নেতিবাচক সমালোচনা করলেই আমরা দেখতে পাই লেখক কান্নাকাটি করে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেন। পরবর্তীতে ওই সমালোচক কে তার বন্ধু তালিকা থেকে ব্লক করে দেয়া হয়। আরো কত কী! বাংলা সাহিত্যের সমালোচকরা সাহিত্যের রস আস্বাদনে গভীর চিন্তার প্রমাণ রাখছেন। সমালোচকরা লেখকের সৃষ্টি যজ্ঞের পুরোহিত।
একজন লেখকের সব লেখাই যে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হবে এমন নয়, আবার হতেও পারে। পাঠক বা সমালোচকদের ভালোলাগা না লাগার বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেই পারেন। এ নিয়ে লেখককে বিচলিত হলে চলবে না। লেখক ও সমালোচকের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই। সমালোচনা গ্রহণ করতে হয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যা লেখকের পরবর্তীতে সংশোধন বা পরিমার্জিত করতে সুবিধা হয়। কোন লেখা বা গ্রন্থ সমালোচনার উপর ভিত্তি করে রচিত হয় না বরং গ্রন্থ বা লেখার উপর ভিত্তি করে সমালোচনা হয়। সুতরাং সাহিত্যের মান যত উন্নত হবে সমালোচনাও তত উন্নত হবে। সাহিত্যের পথ উন্মুক্ত করে সমালোচনা সাহিত্য।