গল্প

অনন্ত অভিশাপ

সুলেখা আক্তার শান্তা

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বড় রাস্তার পাশে খাল। খালের পাশে শ্মশান। জায়গাটা শ্মশানঘাট নামে পরিচিত। রাস্তার পাশে একটা মরা গাছের নিচে মাধবী দাঁড়িয়ে ছিল। গাছটা কবে মরেছে তা কেউ সঠিক জানে না। মাধবীর নিজেকে মরা গাছের মতো মনে হলো। অস্তিত্ব আছে; কিন্তু প্রাণ নাই। সেখানে দাঁড়িয়ে শ্মশান ঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাধবী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সবকিছু। কিছুক্ষণের মধ্যে লাশ চিতায় তুলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছিল জ্বলন্ত চিতার অগ্নি শিখা। সারা জীবনের ক্ষোভ বিতৃষ্ণা শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল চিতার লেলিহান অগ্নিকুণ্ডে ভস্মীভূত হয়ে। শ্মশানে নারীর প্রবেশ নিয়ে বিস্তর বিধিনিষেধের কথা সে শুনেছে। নারীর পদচারণা সীমিত করাই যেন পুরুষতন্ত্রের কাজ। সে ভাবে, কোনো নারী নিশ্চয়ই এই বিধিনিষেধ রচনা করিনি। আইন তৈরি করা পুরুষের কাজ। সংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী চলছে পুরুষের রচিত আইনে। এটাই দুনিয়ার প্রচলিত প্রথা। নিষেধ না থাকলেও শ্মশানে প্রবেশে তার আগ্রহ ছিল না। শ্মশানের কাছে মাধবীর উপস্থিতি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। প্রিয়জনের অকাল মৃত্যুতে শোক বিহ্বলতা তাকে শ্মশান পর্যন্ত টেনে এনেছে। ধন্য মাধবীর সদয় আচরণ, অনেকে মনে মনে ভাবে। সুদর্শন যুবক সুনীল কলেজে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকতে চায়। সে বুঝতে পারে, মাস্তানি উপরে ওঠার সহজ পথ। সে সহজ পথটি বেছে নেয়। ক্ষমতা অর্থ সম্পদের অর্জনের অলৌকিক ব্যবস্থা। পড়াশোনা তার কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। সকলে তাকে সমীহ করে সেটা ভয়ে কিংবা ভালো লাগায়, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সুদর্শন যুবকদের মতো তারও প্রত্যাশা যুবতীরা তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে। তাকে প্রেম নিবেদন করতে ব্যাকুল হবে। বিশেষ কোনো মেয়ের প্রতি তার আগ্রহ নেই। তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে পাশের বাড়ির মাধবী। ব্যক্তিত্বের গাম্ভীরে‌্য এক অনাবিল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মেয়েটি। উচ্চমার্গের বিকিরিত প্রভার সেই উজ্জ্বলতা সুনীলকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। এমন বিশেষত্ব যা অন্য কারো মধ্যে দেখতে পায় না।

সুনীল একদিন মাধবীকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। চরমভাবে অপমানিত হয় সুনীল। সেদিন প্রতিজ্ঞা করে যে করে হোক মাধবীকে বিয়ে করবে সে। সুনীলদের বাড়িতে দুপুরের দিকে পুলিশ এসেছিল। বাড়ির দরজায় জড়ো হওয়া উৎসুক মানুষের সামনে দিয়ে সুনীলকে নিয়ে যায় কোমরে দড়ি দিয়ে। লজ্জায় অপমানে সুনীলদের বাড়ির কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। পাশের বাড়ির মাধবী ঘর থেকে বের না হলেও সব কথা তার কানে আসছিল। বাসার কাজের মেয়ে রেনু বারবার এসে কী হচ্ছে তার বিবরণ দিয়ে যাচ্ছিল। মাধুরী উপরে নির্লিপ্ত ভাব দেখালেও খুঁটে খুঁটে সব শুনছিল রেনুর কাছ থেকে। ঘটনা ঘটেছে কলেজে। কলেজের ইলেকশনে দুই পক্ষের গোলযোগ। সেখানে উত্তপ্ত কথা কাটাকাটির তুঙ্গে উঠলে প্রতিপক্ষের এক ছেলের পেটে চাকু ঢুকিয়ে দেয় সুনীল। মারামারি-গুন্ডামির রেকর্ড থাকলেও খুনাখুনির ঘটনা এটাই প্রথম সুনীলের।? তার পকেটে সব সময় একটা চাইনিজ চাকু থাকত। সুদৃশ্য সেই চাকুটির উপস্থিতির কথা কারণে-অকারণে প্রকাশ্যে বলতে দ্বিধা ছিল না তার। শান্তিপ্রিয় শহরে এমন অশান্তি আগে কেউ দেখেনি। মাধবীদের একান্নবর্তী পরিবার না হলেও সব শরিকদের ঘরগুলো পাশাপাশি সাজানো। ঘরগুলো সামনে প্রশস্ত আঙিনা। সুনীল অপেক্ষায় ছিল। একদিন সে সুযোগ আসে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর যে যার ঘরে শুয়ে পড়ে। মাধবী কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে মায়ের ঘরে যায়। সেই সুযোগে সুনীল নিঃশব্দে মাধবীর ঘরে ঢুকে আলমারির আড়ালে গিয়ে লুকায়। মাধবী ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ মাধবীর বাবা মাধবীর ঘরের দরজায় আঘাত করে মাধুরীকে ডাকেন। আঘাতের ধরন খুব একটা স্বাভাবিক মনে হয়নি। মাধবী আশ্চর্য হয়ে দরজা খুলে দেয়। প্রথমে মাধবীর বাবা ঘরে ঢোকে। পেছনে লক্ষ্য করে তার দূর সম্পর্কের কাকা এবং আরো কয়েকজনকে। তার মধ্যে সুনীলের দুজন বন্ধুকে দেখতে পায়। মাধবীর বাবা উত্তেজিত স্বরে বললেন, দেখো! কোথায় কে আছে। সুনীল সবার সামনে ধীর পদক্ষেপে আলমারির পাশ থেকে বেরিয়ে আসে। চলে যায় নিঃশব্দে। সবাই স্তব্ধ, কারো মুখে কোনো কথা নেই। বিচ্ছুরিত কলঙ্কের কালিমা তীব্র বেগে আঘাত করে মাধবীর বাবাকে। তিনি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন, পাশের একজন তাকে ধরে ফেলে। মাধবীর মা ঘটনার আকস্মিকতায় মূর্ছা জান। মাধবীর কাকা সুনীলের বন্ধুদের বলেন, এ কলঙ্কের বোঝা আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। এখন কী করা? সুনীলের বন্ধু বিজয় আর সুশান্ত আশ্বস্ত করে, এ ঘটনা কেউ জানবে না। আপনারা সুনীল এবং মাধবীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাহলে সব ঝামেলা মিটে যাবে। নিরুপায় মাধবীর বাবা-মাকে প্রস্তাবটি মেনে নিতে হয়। মাধবীর সব প্রতিবাদ প্রতিরোধ উপেক্ষা করে সুনীলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে রাত হয়ে যায়। বাসর রাতের সব আয়োজন করা হয়েছে। সুনীল ঘরে ঢুকে দেখে কেউ নাই। কিছুক্ষণ পর মাধবী বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। অঙ্গে তার বৈধব্যের ভূষণ।

বিধবাদের একটা সাদা শাড়ি পড়েছে সে সুনীল চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, একি করলে তুমি । মাধবী নির্বিকার চিত্তে বলে, হ্যাঁ! আমি ঠিক করেছি। শাঁখা ভেঙে সিঁদুর মুছে আমি বিধবা হলাম। এটা আমার প্রথম প্রতিবাদ। যদি তোমার পৌরুষ খাটাতে যাও তখন হবে দ্বিতীয় প্রতিবাদ, আত্মহত্যা! আমি অভিশাপ দিলাম, যে জিভ দিয়ে তুমি মিথ্যা বলেছ, আমাকে কলঙ্কিত করেছো সেই জিভ যেন তোমার খসে পড়ে। মাধবীর প্রতিবাদী জীবন চলতে থাকে। পিতা-মাতা অলক্ষে অশ্রু মুছে। পড়াশোনায় মেধাবী দৃঢ়চেতা মাধবী শত প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতার জীবন শুরু করে। অপরদিকে সুনীল হয়ে পড়ে অসুস্থ। খাবার গলধঃকরণে কষ্ট হয় তার। দীর্ঘদিন স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় কোনো উন্নতি হয় না। পরিশেষে একজন ডাক্তার তাকে বলে, অবস্থা সুবিধা মনে হচ্ছে না। আপনি বিদেশে যান। বিদেশে সুনীলকে বলা হয়, আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। জিভে ক্যান্সার হয়েছে এবং তা মধ্যরেখা অতিক্রম করেছে। অপারেশন করে জিভ ফেলে দিয়ে ক্যান্সারের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। এখন এছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই। অপারেশন করতে হয়। জিভ ছাড়া সুনীল এসে মাধবীর সামনে দাঁড়ায়। অভিসম্পাত এভাবেও ফলে যায়।

শুধু তাই নয়, ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্যি হয়, ক্যান্সারের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয় না। সুনীল জীবনী শক্তির শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই করেও পরাজিত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। মাধুরীর চোখের সামনে চিতার আগুন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরে যায়।