নাট্যোপন্যাস প্রথম পর্ব

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী

প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১.

রতি ও বিরতির উপায়ন

ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাথরের ঘাটটি ত্রিপুরার গোমতী নদীতে গিয়ে প্রবেশ করেছে। দক্ষিণ-পূর্বের মৌসুমি বাতাস বঙ্গোপসাগরের জলীয় বাষ্প নিয়ে ত্রিপুরার সমতল স্থলভাগের আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই মৌসুমি মেঘপুঞ্জ থেকে ঝরে-পড়া জলধারায় ত্রিপুরার মাটি, পূর্বের পবর্তশ্রেণি থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বে খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মাথা পর্যন্ত ভিজে ওঠে, নরম হয়, খসে যায়, ধুয়ে যায়, ভেসে যায়; গোমতী নদী জেগে ওঠে, তার স্রোতের টানে, স্রোতের ভেতর থেকেই জেগে ওঠে নদী আর স্থলভূমির সীমানা। সমতলের গড়ন বদলায়। এই জলের বেগে-আঘাতে, ভেঙে-ভেসে যেতে চায় ময়নামতির প্রাচীন পাথরের গভীর খাতটিও। ফলে মাঝেমধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা ভেঙে যায়, রাষ্ট্রের সীমাও কোথাও কোথাও বিলুপ্ত হয়। তবে এখন গোমতী নদীর জলে ঈষৎ হিমেল স্পর্শ লেগে আছে। জল ও মাটি এখন আলাদা। থকথকে, থিকথিকে, হলহলে, ঝলঝলে, আঠালো, চ্যাটালো, গা-মাখা, পা-মাখা, জোকালো, খাঁকালো, সপসপা, ধপধপা, মোটা, পাতলা- কাদার রকমফের এখন নেই। এখন কাদা অন্যরকম, রঙের মতোই হাতে, পায়ে, শরীরে লাগে। মৌসুমি বাতাসও এই সময়ে পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে ফেরে। রোদও এখন বড় মোলায়েম। আকাশের রং ক্রমশ গাঢ় নীল হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমাণ শাদা তুলো-তুলো মেঘ।

রাজকুমার নক্ষত্ররায় অতিশয় শিকারপ্রিয়, বিনা কারণেই তিনি পশুবধ করে আমোদ পান। এক দিনে শতাধিক প্রাণীবধ করেও তার তৃপ্তি যেন হয় না। বনে উন্মত্তবৎ ছুটে বেড়ান তিনি, কিন্তু দিনের আলো সম্পূর্ণ নিভে গেলে রক্তাক্ত শরীরে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন। শিকার ব্যতীত রাজকুমার নক্ষত্ররায়ের আর কোনও কাজ নেই। তার বয়স যৌবন, শরীর স্বাস্থ্যবান, মন চঞ্চল। শিকারির জীবন পালনের কঠোরতায় তার বুকের অভ্যন্তরে ভালোবাসার পুকুর শুকিয়ে গেছে, আবেগও ফুরিয়েছে, রাজা ও রাজ্যের প্রতি কোনো আন্তরিকতা অনুভব তার নেই। তবে তিনি ভেতরে ভেতরে একরকম অস্থিরতা অনুভব করেন। একাকিত্বের যন্ত্রণা-হাহাকার তার সারাক্ষণের সঙ্গী।

তাই হয়তো-বা তার মনের চাঞ্চল্যের স্থানটি দখল করে নিয়েছে দারুণ এক জ্বালা। ক্রোধ, হিংসা, দুঃখ মিলিয়ে এক আগুন নিরন্তর তার বুকের মধ্যে জ্বলছে। এই জ্বালা ভোলার জন্য তিনি সকালেই পশু-শিকারের জন্য মেতে ওঠেন। কয়েক বছর আগেই তার পিতৃবিয়োগ হয়। তিনি আশা করেছিলেন যে, তার পিতা মৃত্যুকালে ত্রিপুরা রাজ্য দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে যাবেন। কিš‘ তা তিনি করেননি। ভাগাভাগি করলে রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে- এই বিবেচনায় তিনি সম্পূর্ণ ও অবিভক্ত রাজ্যটিকে দিয়ে যান তার প্রথম পুত্র গোবিন্দমাণিক্যকে। বয়সে কনিষ্ঠ হওয়ার কারণে নক্ষত্ররায় রাজা হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। সবাই তাকে রাজকুমার বলে বটে, তবে নক্ষত্ররায় একজন বৃত্তিভোগী কৃপাপাত্র মাত্র, রাজ্যশাসনে তাকে কোনও ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি।

বৎসরের এমন সময়টায় আকাশে কৃষ্ণহংস-দল খণ্ড খণ্ড মেঘের মতো উড়ে বেড়ায়। হয়তো-বা তারা তাদের চোখের তারায় কত ছবি আঁকে- গোমতীর উত্তাল ঢেউ, তীরে বাঁধা তরণি, নীল আকাশ, শান্ত চর, দুই পাশের উদাসীন তীর, তীরের অনতি দূরে-একপাশে-রাজপ্রাসাদ; আর অন্যপাশে আদিগন্ত বন, পাহাড়। আদিগন্ত বনেই হয়তো বা কৃষ্ণহংসকুল আশ্রয়ের সন্ধান করে। কিন্তু যে একঝাঁক কৃষ্ণহংস আকাশের বুকে মালার মতো দুলছে সেগুলোই নক্ষত্ররায়ের কাছে তার শত্রু, দ্বিতীয় আর নেই। তখনই, হরিণ শিকারে তার একধরনের অরুচি ধরে যায়, মস্তিষ্কের সকল সীমায় আবদ্ধ হয়ে কেবল একটি কণ্ঠ ফিসফিস করে বলতে থাকে : ‘হংসবধ’, ‘হংসবধ’; তিনি এক যন্ত্রণাবিদ্ধ কণ্ঠের কাছে উৎকর্ণ বোবা হয়ে যান। দুই চোখের কোণ দিয়ে টপটপ করে অগ্নিধারা গড়িয়ে পড়তে থাকে। অন্তরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কৃষ্ণহংস-দলের প্রতি তার কোনও অনুকম্পা জাগে না। হয়তো-বা নক্ষত্ররায় কৃষ্ণহংস-শিকারে শান্তি খুঁজে নিতে চান। তাই তিনি মেতে উঠলেন কৃষ্ণহংস-বধের খেলায়। রোদ অগ্রাহ্য করে ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে এবং শিকারির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি ধ্বংস করতে থাকলেন কৃষ্ণহংসকুল।

একটি নিঃসঙ্গ ও নিঃস্ব কৃষ্ণহংস তিরের আঘাতে আহত হয়ে শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে পড়তে থাকে নিচে। নক্ষত্ররায় এই কৃষ্ণহংসটিকে অনুসরণ করে ছুটতে থাকেন। কৃষ্ণহংসটি এসে পড়ে রাজোদ্যানে। নক্ষত্ররায় সেখানে এসে পৌঁছানোর আগেই তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কৃষ্ণহংসটি ধরে ফেললেন। সারাদিনের রাজকার্যের পর মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য এই সময় উদ্যানে পরিভ্রমণ করে চিত্তবিনোদন করেন, এমন সময় তার সামনেই একটি মাধবীলতার কুঞ্জে ঝপ করে এসে পড়ে কৃষ্ণহংসটি।

কৃষ্ণহংসের রূপ দেখে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য মুগ্ধ হয়ে তার শরীর থেকে তিরটি তুলে ফেলেন। ক্ষত তেমন বেশি নয়, সেবা-যত্ন করলে কৃষ্ণহংসটি বেঁচে যেতে পারে। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য যখন কৃষ্ণহংসের তিরটি তুলে ফেলেন তখনই রাজকুমার নক্ষত্ররায় ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হলেন রাজোদ্যানে। এক চমকানো ব্যথায় বুকের ভেতর টনটন করে উঠল। এক দুরন্ত অভিমান, ঘৃণা, বিদ্বেষ- এইসবের ইন্ধনই যেন হঠাৎ ফুঁসে উঠল। মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠল তার ভ্রাতার ওপর, ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর। মনের অস্থিরতাকে চাপা দেওয়ার জন্য নিজের মনকে শক্ত আর কঠিন করলেন তিনি। পশুবলি দেয়ার মতো মনটাকে দৃঢ় করলেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেন। মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য তার প্রতি স্নেহাসক্ত কি না তা জানার কোনও প্রয়োজন নেই তার কাছে, বরং অপরিচয়ের ব্যবধান ও দূরত্বের সীমানা লঙ্ঘন করে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কতটা আপনজন হয়ে উঠবেন তার সংশয় নক্ষত্ররায়ের অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। ভ্রাতা নামক এই ব্যক্তির সঙ্গে তার তো কোনও সম্পর্ক কিংবা আত্মীয়তা গড়ে ওঠেনি। তাই হয়তো-বা ভ্রাতার প্রতি কোনও ভক্তি, শ্রদ্ধা, অনুরাগ তার মনে জন্ম নেয়নি।

মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যের সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে তিনি চান না, তাই অসহায় অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে হাত প্রসারিত করলেন। কিন্তু কৃষ্ণহংসটি তার দিকে এগিয়ে দিলেন না মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য। ভ্রাতার এমন ব্যবহারে নক্ষত্ররায়ের অত্যন্ত আপন মনটি মরে গেল। অনুভূতি তো শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই হয়তো-বা এই মুহূর্তে মহারাজা গোবিন্দমাণিক্যকে ভ্রাতা বলে মনেপ্রাণে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারছেন না তিনি। ক্ষোভ, দুঃখ তাকে আঘাত করতে থাকে। ভ্রাতাকে এক নিষ্ঠুর মহারাজ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না তিনি। তিনি জানেন, মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের বিপুল প্রভাব ও ক্ষমতা আছে, তবে নিজে নিজেকে রক্ষা না করতে পারলে হয়তো-বা কারও সাধ্য নেই বহির্বিশ্বের নানাবিধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার। তিনি বলে উঠলেন, এই কৃষ্ণহংসটি আমার!

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য বললেন, ভ্রাতা, আমি সংবাদ পেয়েছি, ইতোমধ্যেই তুমি সহস্রাধিক কৃষ্ণহংস বধ করেছ, তাতেও কি তোমার তৃষ্ণা মেটেনি? এই কৃষ্ণহংসটি আমিই রেখে দিলাম।

মহারাজের কথা শোনামাত্র নক্ষত্ররায়ের বুক ধুকপুক করতে শুরু করে। অসহায়ের মতো তাকালেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের দিকে। তারপর দৃষ্টি নত করে বললেন, আপনার যদি কৃষ্ণহংসের প্রয়োজন হয়, যে কতিপয় প্রয়োজন আপনি নিজে ধনুর্বাণ নিয়ে শিকার করুন, কিংবা রাজকর্মচারীদের আদেশ দিন তারা যেন জাল ফেলে ধরে দেয়। আপনি আমার ন্যায্য শিকারটি কেন নিতে চাইছেন? ওর ওপর আমার অধিকার রয়েছে।

বুকের ভেতর জমে ওঠা দীর্ঘনিশ্বাসকে আর-একটু চেপে ধরে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য বললেন, আর কোনও কৃষ্ণহংস আমি চাই না। এটিকেই বাঁচিয়ে তুলতে চাই।

হাত প্রসারিত করে নক্ষত্ররায় বললেন, প্রথমে যে অস্ত্র নিক্ষেপ করে, নিহত বা আহত সেই প্রাণীটির ওপর তারই অধিকার থাকে- এই তো রাজনির্দেশ। রাজনির্দেশ অনুযায়ী, এই কৃষ্ণহংসের ওপর আমারই ন্যায্য অধিকার। সুতরাং এটি আমারই। এটি আমাকে ফিরিয়ে দিন!

নক্ষত্ররায়ের উদ্ধত বাক্য শ্রবণে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য ¯ি’রভাবে তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, তুমি যাও, বিশ্রাম কোরো গিয়ে। আর যাওয়ার পথে মহামন্ত্রীকে ডেকে দিয়ো। আমি এই রাজ্যে প্রচার করতে চাই : আজ থেকে জীববধ নিষিদ্ধ করা হল; কোনও জীবকে কেউ বধ করলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

নক্ষত্ররায় অবরুদ্ধ ক্রোধ বক্ষে নিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে রাজোদ্যান ত্যাগ করলেন; আর মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কৃষ্ণহংসটির সেবা-শুশ্রƒষায় মনোনিবেশ করলেন।

ত্রিপুরার মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য রাজাসভায় বসে বাতায়ন পথে বাইরে তাকিয়ে আছেন। এখান থেকে পূর্ণ আকাশ দেখা যায় না। আধখানা খোলা আকাশ অনন্ত প্রশ্নের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশ্ন, প্রশ্ন- কত প্রশ্ন তার মাথার ভেতর। কেন মনে এত প্রশ্ন জাগে? কত দার্শনিক চিন্তা মনকে ছুঁয়ে যায়, জীবনপ্রবাহ অনন্ত, তার শেষ নেই, ক্ষয়ও নেই; কোনও কারণেই নিরব”িছন্ন গতি রোধ করা যায় না। গোমতীর স্রোতের মতো চিন্তার গতিধারা অহরহ বদলায়। মানুষের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে- যার কোনও প্রয়োজন নেই, এর শুরু তিনি দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু শেষ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই হয়তো রহস্যময় অস্পষ্টতায় থমথমে আকাশটি তার চোখে ধরা পড়ে। এই বিষণ্ণ স্তব্ধতা তার হৃদয়কেও ভারাক্রান্ত করে। তার শান্ত ও ভাবলেশহীন মন আজ কিছুটা হলেও চঞ্চল। যদিও ভালোবাসা, সম্মান আর সফলতম শাসনের মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের মুকুটে দু-একটা শুষ্ক পালকও রয়েছে; যেমন : তার শাসন আমলে আরাকানের জলদস্যুদের উৎপাত তিনি সামলাতে পারেননি, তবে এখানেও তার চেষ্টার কমতি রাখেননি। জলদস্যুরা দস্যুতা ছেড়ে যেন শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসায়ে লিপ্ত হতে পারে সেজন্য তাদের বিশেষ অনুমতিপত্র প্রদান করেছেন তিনি। তারপরও ত্রিপুরাকে আরাকান জলদস্যুদের হাত মুক্ত রাখতে পারেননি, তবে তার শাসন আমলেই তিনি পার্শ্ববর্তী মণিপুর রাজ্যের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের শাসন আর স্থানীয় মানুষের ভালোবাসায় ত্রিপুরার মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য তার পরিবার-পরিজন নিয়ে চমৎকারভাবেই জীবনস্রোতের তোড়ে প্রবাহিত করছেন নিজের সময়। তিনি যখন এসব ভেবে চলেছেন তখনই ভুবনেশ্বরী মন্দিরের রাজপুরোহিত বা চোন্তাই রঘুপতি কার্যবশত রাজদর্শনে এলেন। (চলবে)