ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নাট্যোপন্যাস (পর্ব ২)

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী
রাজাবলি

ভুবনেশ্বরী দেবীর পুজো চতুর্দশী তিথিতে, তা অনুষ্ঠিত হয় গভীর রাত্রিতে। পুজোর আর-মাত্র কয়েকদিন বাকি। এই পুজোয় এক দিন ও দুই রাত্রি কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারে না। এমনকি মহারাজও পারেন না। মহারাজা যদি বেরুতে চান, তাহলে চোন্তাইর কাছে তাকে অর্থদণ্ড দিতে হয়। পুজোর সমাপনী রাত্রিতে মন্দিরে জীববলি দেওয়া হয়। তখন সর্বপ্রথমে যেসব পশুবলি হয়, তা রাজবাড়ির দান বলে গৃহীত হয়। এই বলির পশু গ্রহণ করার জন্য চোন্তাই রাজসমীপে এসেছেন। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যকে অভিবাদন করলেন রঘুপতি। রাজাজ্ঞাপ্রাপ্তিক্রমে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে মহামন্ত্রীর সঙ্গে মহারাজের কথোপকথন শোনার অপেক্ষায় উৎসুক রইলেন। এরই মধ্যে নক্ষত্ররায় ফিরে এলেন।

রাজকক্ষটি আকারে যেমন বৃহৎ, তেমনই বিশাল গোলাকৃতি ছাদযুক্ত। মোগল স্থাপত্যের প্রভাবেই রাজপ্রাসাদের শীর্ষে গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। দেয়ালগুলো পাতলা রেশমের পর্দা দিয়ে আবৃত। রাজকক্ষের প্রধান অংশে মণিমুক্তাজড়িত মর্মর-সিংহাসনে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য বসে আছেন। তার পাশে মসৃণ শিলা-কুট্টিমের ওপর বসে মহামন্ত্রী দুরূহ চিন্তা মাথায় নিয়ে মহারাজের সঙ্গে মন্ত্রণায় লিপ্ত। মন্ত্রণা শেষ করে মহারাজ ও মহামন্ত্রী পরস্পরের চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইলেন। তারপর মহারাজ হঠাৎ বলে উঠলেন, মহামন্ত্রী, এখন থেকে আমার রাজ্যে আর জীববধ হবে না।

অপ্রস্তুত-অর্ধপ্রস্তুত মহামন্ত্রী বললেন, মহারাজ, আমি আপনার দাসানুদাস আজ্ঞাবহ ভৃত্য। যা আদেশ করেন তা শিরোধার্য করে প্রতিপালন করি।

যে যাই বলুক না কেন, প্রচলিত একটা ধারণা হল ত্রিপুরার মহারাজদের পশুবলির চেয়ে নেশা এই ধরাধামে আর নেই। কথাটি এই মুহূর্তে খুব গভীরভাবে অনুভব করতে পারছেন রঘুপতি। আড়চোখে একবার মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের দিকে তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, হে রাজন, আপনি পৌরুষে দিব্যকান্তি জ্যোতিষ্মান রতিপতি, তেজে ইন্দ্রতুল্য, হৃদয় বারুণের মতো বিশাল; আপনাকে তুচ্ছ মনে করার কোনও কারণ নেই; কিন্তু আপনি এ কেমন অবাক-করা কথা বললেন! মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি!

রঘুপতি ভেবেছিলেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য তার কথায় বিরক্ত হবেন। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না, বরং খিলখিল করে হেসে উঠে তাকালেন রঘুপতির দিকে। নিশ্চয় একটু আগে বলা জীববধ নিষিদ্ধের ঘোষণাটি তার চোখেমুখে দীপ্ত হয়ে উঠেছে। রঘুপতির মনে হল, মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের হাসির সঙ্গে সঙ্গে বাইরে মিষ্টি রোদ ঝলমলিয়ে উঠেছে। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য হাসি থামিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না, বরং মহামন্ত্রীর দৃষ্টি অনুসরণ করে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল রঘুপতির ওপর, তারপর বললেন : না ধর্মরাজ চোন্তাই, এতদিন বরং আমরাই স্বপ্ন দেখেছি। আজ চেতনা ফিরে এসেছে। নিশ্চয় আপনার যেকোনও কাজে যদি আমি বিন্দুমাত্র সহায়তা করতে পারি তাহলে ধন্য হই; তবে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মা যে আমাকে দেখা দিয়েছেন। তিনি বলে গেছেন, করুণাময়ী জননী হয়ে তিনি তার জীবের রক্ত আর দেখতে চান না।

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের কণ্ঠস্বরে জীবপ্রেম, জীবস্নেহ, জীবরক্ষা টলটল করছে। তার সৌম্যমূর্তি চোখণ্ডধাঁধানো, রং-তুলি দিয়ে আঁকা তার চোখণ্ডমুখ। তার হৃদয়ে প্রচুর স্নেহরস বিরাজ করছে। তার কর্মবহুল ভাবনাবহুল জীবনের কেন্দ্রস্থলে অধিষ্ঠিত ছিল এই স্নেহরসটি। তাই সুযোগ পেয়ে তা গোমতীর স্রোতধারার মতো প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু রঘুপতির মুখে আতঙ্ক; বিষাদের ছায়া- নিমিষে একখণ্ড মেঘ দিনমণিকে ঢেকে ফেলেছে। বিষণ্ণতা তার মনের অভ্যন্তরে শিকড় গেড়ে বসেছে। একে সহজে উপড়ানো সম্ভব নয়। উত্তেজনায় তার বুকের ভেতরটা কাঁপছে- ঝড়ের মুখে এক বিপন্ন পাতার মতো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। মনে হচ্ছে, তিনি তার কালের পেছনে ফিরে যাচ্ছেন। কী করে সম্ভব! কালের নিজের কোনও উদয় বা অস্ত নেই। মহাকালের দাপটে সব লুপ্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই প্রশ্ন জাগল তার মনে : সত্যি কি তাই? কাল কি শুধু ধ্বংস করে চলে? সবকিছু পুরাতন করে, নূতন করে না? রঘুপতির জীবনও পুরাতন হয়ে গেছে, বয়সে যৌবনের লালিত্য নেই, দৃষ্টি সীমা ছাড়িয়ে বহুদূরে, চোখে কোনও দূরদৃষ্টি নেই- স্মৃতি ভারাক্রান্ত, মুখে বয়সের বলিরেখা, চুলে শাদা রং, দেহ সৌষ্ঠবহীন, চেহারায় জীর্ণপুরাতনের ছায়া লেপটে রয়েছে। কিন্তু মন? মন তো অতীতকে দেখতে ব্যগ্র। আসলে কাল নিরপেক্ষ- বিনাশ হয় না, ধ্বংস হয় না, শুধু রূপান্তর হয়। নিজেকে তার কালের এক অপ্রতিরোধ্য সৃষ্টি মনে হচ্ছে। মনের ভেতর একমুহূর্তের জন্য কোথা থেকে এক তরঙ্গ এসে ধাক্কা খেলো। উচ্ছ্বসিত কলহাস্যে কেন এমন কথা বললেন মহারাজ? না-বলাই উত্তম ছিল। তখনই লজ্জা, বিষম লজ্জা তার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করল। রঘুপতি বললেন : আপনি নিশ্চয় কৌতুক করছেন, মা এতদিন ধরে জীবের রক্ত পান করে আসছেন, হঠাৎ তার এমন বাসনার জন্ম নিল কেমন করে?

উচ্চ স্বরে এবার হেসে উঠলেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য, হাসির চোটে মনে হল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। এরকম দিনে এমন বৃষ্টি হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক, তবে এই বৃষ্টিই আজকাল ত্রিপুরায় নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে। রঘুপতির দৃষ্টি আর কল্পনা দুটিই পাখা মেলে ছুটতে থাকে। কিন্তু মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের এই মুহূর্তটিকে অনেক বেশি আনন্দদায়ক বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য এই মুহূর্তে রঘুপতিকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে, বললেন : না, পান করেননি, বরং রক্তপাতে তিনি বিমুখ ছিলেন। মুখ ফিরিয়ে নেন প্রতিবার রক্তপাত দেখে।

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের কথা শুনে রঘুপতি আর-একটু আহত হলেন। রঘুপতি কোনওমতে বললেন, মহারাজ, সন্দেহ নেই, আপনি রাজকার্যে অতি উত্তম, আর আমি ধর্মকাজে। মায়ের সেবায় যে বদ্ধপরিকর সে কি পারে দেবীর সেবা অন্যের হাতে তুলে দিতে? দেবী যদি কিছুতে অসন্তুষ্ট হন, তাহলে আমিই সবার আগে তা জানতে পারি।

রঘুপতির দিকে তাকিয়ে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য এবার যে-হাসিটি ছুড়ে দিলেন সেটির মাত্রা পূর্বের হাসির চেয়ে অনেকটা ক্ষুদ্র, কিন্তু এই হাসিটাকে ত্রিপুরার রহস্যের মতো দেখাল। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের রহস্যময় হাসির উত্তরে রঘুপতিরও সম্ভবত একটা প্রতিবাদের প্রতিউত্তর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন রাজকক্ষের প্রধান দ্বারের দিকে। রঘুপতির এই দৃষ্টি মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য আর সহ্য করতে পারছেন না, বললেন, হৃদয় যখন কঠিন, তখন দেবীর কথা কি শোনা যায়!

রঘুপতির সঙ্গে এরূপ কথাবর্তা মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের জীবনে এই প্রথম। তিনি হাসিমুখে বৃত্তান্ত শেষ করে কিছুক্ষণ প্রীতিমুখে নিজ কানের মণিকুণ্ডল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন; কিন্তু রঘুপতির শীর্ণ আকৃতির, বৈশিষ্ট্যহীন মুখ মেঘাচ্ছন্ন হতে থাকে। তিনি বললেন, মহারাজ, আপনি অধর্মের পথে পতিত হচ্ছেন।

কথাটি শুনেই আনমনে আবারও সামান্য হেসে উঠলেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য। জীবন থেকে সবই যদি হারিয়ে যায়, তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী! তবে আজ যা-ই ঘটুক-না কেন, সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত আছেন তিনি। একথা ভেবেই হয়তো তিনি বলে উঠলেন : ধর্মরাজ চোন্তাই, আপনি যেদিন ভুবনেশ্বরী মন্দিরের রাজপুরোহিতের আসন ধারণ করেন, সেইদিন থেকেই রাজাদেশ পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন।

রঘুপতি বুঝতে পারলেন, মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যকে জীববধ বন্ধের নেশা ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে। অবশ্য বসেছে বললে ভুলই হবে। তিনি কোনও কিছু করতে সিদ্ধান্ত নিলে এরকমই করে থাকেন সবসময়। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের কথাগুলোয় তিনি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন, এমন বিরাটকায় একজন মানুষ এরকম শিশুর মতো হতে পারেন, তা না-দেখলে ভাবাই যায় না। একজন ধর্মগুরু সর্বক্ষণ একজন মহারাজের নির্দেশ মেনে নিয়ে রাজনির্দেশ অনুযায়ী চলবেন, তা ভিন্ন নয়- এতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছুই নেই; কিন্তু রঘুপতি তা মনে মনে অস্বীকার করছেন- তা অস্বাভাবিক ব্যাপারই বটে; হঠাৎ রঘুপতির অন্তরের কথাই মুখে প্রকাশ পেল, বললেন : তাই বলে আপনার অন্যায় অনুরোধ! আমার পক্ষে এই রাজাদেশ রক্ষা করা সম্ভব নয়।

একথা বলেই রঘুপতি বুক টানটান আর শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ঠিক সামনেই পাহাড়ের মতো ও পাথরবৎ বসে আছেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য। শারীরিক ভঙ্গিই হল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু। ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে স্রেফ এই শারীরিক ভঙ্গি দিয়ে রঘুপতির মন জয় করা সম্ভব। কিন্তু তা করতে পারছেন না বলেই হয়তো চোখেমুখে ফুটে উঠেছে একধরনের অবজ্ঞার হাসি, একইসঙ্গে খানিকটা কৌতুকের ভঙ্গিও। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য বললেন : আপনি তাহলে আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন?

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য আজ কোনও কথা শুনবেন না, তা তার গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। তার কথাগুলো শুনে নিজের মাথাকে সামান্য ঘুরিয়ে মুখ তুলে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের দিকে আর-একবার তাকালেন রঘুপতি। গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের পরনে। মাথায় একটি পাগড়ির মতো মুকুট আর গলার স্বর্ণের হার চকচক করছে। বিশালকায় মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের হাতে লোহার রাজদণ্ড আর মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। তার হাসিটি সত্যিকারেরই তাচ্ছিল্যের। রঘুপতি এই হাসিটির ওপর দৃষ্টি রেখে বললেন, ভুবনেশ্বরী মন্দিরে মায়ের উদ্দেশ্যে পশুবলি দিলে পাপমুক্ত হয়। এই বলির ব্যবস্থা করাই আমার প্রধান কর্ম ও ধর্ম।

রঘুপতির কথা মহারাজের মনঃপূত হল না, তাই বলতে বাধ্য হলেন : তবে মনে রাখবেন, রাজাদেশ অমান্যকারীর কী দুর্দশা হয়।

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের কথার কোনও উত্তর নেই। সবাই চুপচাপ তাকিয়ে আছেন তার দিকে। এক-একজনের চেহারায় এক-এক ভাব, তবে সবার চেহারায় পুরাতন রীতি দোদুল্যমান। সবারই মনে একই ভাবনা : প্রাণ ক্ষয়? কারণ, এই বৃহত্তর ত্রিপুরাশাসিত মহারাজের নির্দেশের অস্বীকার করা মানে সব হারানো তো বটেই, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।

রঘুপতি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের দিকে। আর মনে মনে বলতে লাগলেন : শূন্য থেকেই আসে মানুষ, শূন্যে মিলিয়ে যায়, শূন্য থেকেই ঘুরে দাঁড়ায়, শূন্যতেই জীবন সাজায়। ধন, সম্পত্তি, রাজ্য বা রূপের আমি প্রত্যাশী নই। মানুষের মন বড়, আশাও বড়; তাদের সকল কার্য আড়ম্বরবিশিষ্ট, অথচ কিছুই নেই। বিশ্বাসের ভাগ অতি অল্প। স্থূল কথা : বিষয়বিভব, রাজপ্রাসাদ এবং রাজভোগের লোভী আমি নই। এই লোভ এই জীবনে কখনও হবে না। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বললেন : মায়ের কাজ করতে গিয়ে শাস্তিগ্রহণ করার সৎসাহস আমার আছে, মহারাজ। আপনিও মনে রাখবেন, আমার দেহে রাজপুত-রক্ত। ছোটবেলা থেকেই নিজের মতো করেই চলে এসেছি। আমার কাছে সবচেয়ে বড় ও সত্য আদেশই : মাকে সন্তুষ্ট করা, মহারাজকে অবশ্যই নয়।

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য মুখ তুলে তাকালেন অসম্ভব শুকনো রঘুপতির দিকে, শরীর তো কঙ্কাল, কিন্তু পরনের পরিচ্ছদ বেশ দামি। আর হবেই-না-বা কেন? তিনি ত্রিপুরার রাজপুরোহিত। মানুষটার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে কোনওমতে একটু হাসি জোগাড় করে মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য বলে উঠলেন : তাহলে এখানে থেকে আপনি আর সময় নষ্ট করবেন না। বরং ভুবনেশ্বরী মন্দিরের কাজে সময় ব্যয় করুন। আপনি এখন প্রস্থান করুন। আর যাওয়ার পথে প্রচার করে দিয়ে যাবেন, এই রাজ্যে যে-ব্যক্তি জীববধ করবে তার নির্বাসনদ- দেওয়া হবে। এ-ই রাজাদেশ।

রঘুপতি সবার দিকে আর-একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। একটাও বন্ধুভাবাপন্ন মুখ চোখে পড়ছে না। শুধু রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের চোখে কোনও ভাব নেই। তার দিকে তাকিয়ে একটু আশার আশ্রয় খুঁজলেন রঘুপতি। মনে মনে ভাবলেন : জীবন ক্ষণস্থায়ী। জীবনের আশা কী? এই চক্ষু মুদ্রিত হলেই সকল আশা-ভরসা ফুরিয়ে যাবে। তারপর মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন : মহারাজ, আপনি একজন পুরুষশ্রেষ্ঠ, বীরত্বের অধিকারী, রূপেগুণে দেবতুল্য; তাই ইচ্ছে করলে আপনি আপনার প্রজাদের সর্বস্ব হরণ করতে পারেন; কিন্তু মায়ের উদ্দেশ্যে বলিপ্রথা আপনি হরণ করতে পারেন না! তাই বলছি, আপনার কী সাধ্য আছে, আমি রঘুপতি মায়ের সেবক থাকাবস্থায়, তার পুজোয় কোনওপ্রকার ব্যাঘাত ঘটানোর? অবশ্যই আমি তা দেখে নেব।

রঘুপতি মহারাজকে অভিবাদন করে বিদায় নিতে প্রস্তুত হলেন। মহারাজ তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরে নিলেন। রঘুপতি রাজকক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। রাজপ্রাসাদের সোপানমুখে শস্ত্রহস্ত দুই প্রহরীকে পাশ কাটিয়ে বজ্রপদে এগিয়ে চললেন তিনি। পেছন থেকে প্রহরীদ্বয় তাকে উত্তমরূপে দেখতে লাগল। তার চলন-পথের পাশে গোমতীর জল কলকল করে বয়ে চলল। উচ্ছল কলহাস্যে গোমতী নদী তার আনন্দবার্তা ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে অভিসারিকার মতো। বসন্ত-রতি-রঙের সুখ লেগেছে তার ঢেউয়ের দোলায়। সে ভুবনমোহিনী নটীর মতোই অভিসারে তরঙ্গ ভাঙতে লাগল।

ক্রুদ্ধ অধীর রঘুপতির গমনে মহামন্ত্রী বিস্মিত হলেন। তিনি অবগত আছেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের স্বভাব-লক্ষণ সম্বন্ধে। তিনি জানেন সংকল্প থেকে তাকে সহজে বিচলিত করা যাবে না। সভয়ে মহামন্ত্রী বললেন : মহারাজ, আপনার স্বর্গীয় পিতৃপুরুষ বারংবার দেবীর কাছে নিয়মিত বলি দিয়ে এসেছিলেন। কখনও এক দিনের জন্যও তার অন্যথা ঘটেনি। আজ এতদিন পরে, আপনার পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন পুজোর ব্যাঘাতসাধন করলে স্বর্গে তারা অসন্তুষ্ট থাকবেন।

সত্যি কথা হলো, নক্ষত্ররায়ের জীবনটা এই মুহূর্তের মতো চরম সুখী না হলেও কখনই দুঃখী ছিল না। অন্ততপক্ষে সম্পদের দিক থেকে তো একেবারেই নয়। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য তার একমাত্র ভ্রাতা। অঢেল সম্পত্তি ও সম্পদ তার। অভাব কাকে বলে নক্ষত্ররায় কখনও দেখেননি জীবনে। অর্থের চিন্তা তাকে কখনই করতে হয়নি। কিন্তু অতি অর্থের মধ্যে নিজ থেকেই একটা অনর্থ ব্যাপার চলে আসে। যেখানে অনেক বেশি অর্থের ছড়াছড়ি, সেখানে খানিকটা অনর্থ ঘটবেই। ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটেছে নক্ষত্ররায়ের ক্ষেত্রে। বিলাসকে কীভাবে আরও প্রসারিত করে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ্য করা যায়, এটিই তার জীবনের প্রাত্যহিক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। নক্ষত্ররায় বললেন : আজ্ঞে, স্বর্গে তারা অসন্তুষ্ট হবেনই বটে! আমার বিবেচনায় এই প্রথা বন্ধ করা উচিত নয়।

মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কড়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন, আজ শান্ত থাকতে হবে তাকে; তবে উত্তর দেওয়া আবশ্যক, তিনি বললেন : উচিত, অনুচিত এসব আমার বিবেচনার বিষয়! তোমার নয় ভ্রাতা।

রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায় ও মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের মনের গতি ভিন্নমুখী। ত্রিপুরার ভাগ্যদেব এক-হাতে সব দিয়ে, অন্য-হাতে সব হরণ করে নিচ্ছেন। নক্ষত্ররায়ের অন্তরাকাশে জ্বলছে ঘৃতদীপ, আর মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের হৃদয়াকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। নক্ষত্ররায়ের মনের কষ্ট অনুভব করেই মহামন্ত্রী বলে উঠলেন : হে রাজন, আপনার মতো সুপুরুষ ও সর্বগুণান্বিত মহারাজ সমগ্র ভারতবর্ষে আর-একজনও নেই। তবুও বলছি, আপনি বরং একটি কাজ করুন, যেখানে সহস্র বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে সেখানে একশত বলির আদেশ দিন।

সভাসদরা বজ্রাহতের মতো অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য কিছুক্ষণ ভাবতে লাগলেন, তারপর সিংহাসন থেকে নেমে, দৃঢ়স্বরে, মহামন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন : আজ থেকে আমার রাজ্যে আর জীববধ হবে না। আজ থেকে জীববধ নিষিদ্ধ। তার ওপর আর কথা নয়।

রাজসভা সহসা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিশাল এই রাজকক্ষে কেবল কয়েকটি শব্দের ‘জীববধ নিষিদ্ধ’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। এই ধ্বনি কর্ণপাত করে মহামন্ত্রী বললেন, যথা আজ্ঞা মহারাজ।

রঘুপতি ঊর্ধ্বশ্বাসে চলছেন, বিরাম নেই। নিতান্ত ক্লান্ত। চলৎশক্তি রহিত। ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর। কিন্তু নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বপর্যন্ত বিশ্রামহেতু সময় অপব্যয় করতে নারাজ। একে তো পাহাড়ি অঞ্চল, তার ওপর প্রচণ্ড বর্ষণ, বিশ্রাম করার স্থান অতি বিরল। যুবকের পক্ষে বরং সহজ, কিন্তু বৃদ্ধের পক্ষে এই পাহাড়ি পথ ভাঙা নিতান্তই দুঃসাধ্য। কিছু পথ পর্যন্ত অবিশ্রান্ত চলে এইক্ষণে অনেক দুর্বল হয়ে অতিকষ্টে পথ ভেঙে চলেছেন, নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

প্রতিদিনই ভুবনেশ্বরী মন্দিরের উদ্যোনের বৃক্ষসমূহ বেড়ে চলেছে, লতাগুলো বাড়ছে, শাখা পুষ্পিত হচ্ছে, ছায়া বিস্তৃত হচ্ছে, শ্যামল পল্লবীর যৌবনগর্বে নিকুঞ্জ পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে; কিন্তু পুষ্করের প্রাণের কথা, ভালোবাসার কথা, অন্য কেউ জানে না; তার বিপুল শক্তি ও সাহসের জন্যই সে খ্যাত, তার দক্ষতা বিস্ময়কর। পুষ্করের পদবি নিষ্প্রয়োজন। ছয় ফুটের সামান্য বেশি লম্বা, ছত্রিশ ইঞ্চি বুকের ফ্যাকাশে ফর্সা এক যুবক। মন্দিরের কাজকর্ম শেষ করে সে তার কুটিরের দ্বারে বসে আছে। সম্মুখে মন্দিরকানন। বিকেল প্রায় শেষ। ঘন মেঘ করে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির জলে গাছগুলো স্নান করছে, বৃষ্টিবিন্দুর নৃত্যে পাতায় পাতায় উৎসবের আয়োজন যেন; বৃষ্টিজলের ছোট ছোট শত শত প্রবাহ ঘোলা হয়ে, কলকল করে গোমতী নদীতে গিয়ে পড়ছে। পুষ্কর পরমানন্দে তার কাননের দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে মেঘের স্নিগ্ধ অন্ধকার, বনের ছায়া, ঘনপল্লবের শ্যামশ্রী, বৃষ্টির অবিশ্রাম ঝরঝর শব্দ; কাননের মধ্যে এইরূপ বৃষ্টির ঘোরঘটা দেখে তার প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। তখনই ভিজতে ভিজতে ধর্মরাজ রঘুপতি এসে উপস্থিত হলেন। পুষ্কর তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পা ধোয়ার জল ও শুকনো গামছা এনে দিল। সে তাকিয়ে আছে রঘুপতির দিকে। তিনি কী ব্যবহার করছেন তা বোঝার চেষ্টা করছে। মনের গহিনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বিরক্তির স্বরে রঘুপতি বললেন : তোমাকে গামছা ও জলের ঘটি এনে দিতে কে বলেছে? চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত