নাট্যোপন্যাস (পর্ব ৩)

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পুষ্কর সঙ্গে সঙ্গেই আমতাণ্ডআমতা করে বলল, কেউ বলেনি প্রভু। স্বইচ্ছায় এনেছিলাম পুষ্করের দেওয়া গামছা ছুড়ে ফেলে দিলেন রঘুপতি। জলের ঘটিটিও পা দিয়ে ঠেলে ফেললেন। রঘুপতির মনের ভেতর মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের আদেশে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তার উত্তেজিত ও অসংযত প্রকাশ্যরূপই এসব।

পড়ন্ত বিকেলের বৃষ্টিভেজা আলো এসে পড়েছে রঘুপতির বয়স্ক মুখে। তিনি নাক ও ঠোঁট কুঁচকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তার এই দশা দেখে পুষ্করের বুকের ভেতর এক ভীষণ কষ্টের অবোধ অনুভূতির খামচাখামচি শুরু হল। গালের কোণে আঙুল ছুঁয়ে নির্নিমেষ চোখে সে শুধু তাকিয়েই রইল। রঘুপতির ব্যবহার তার কাছে রহস্যময় ঠেকাচ্ছে। সারা দেহের শিরা-উপশিরায় উচ্ছ্বসিত রক্তের অসহ্য তাপে রঘুপতি অস্থির। ঘূর্ণিঝড় উঠেছে তার বুকে। শুধুই অনুভব করছেন যে, তার শরীর ক্ষুব্ধ উত্তেজনায় বেশিক্ষণ স্থির থাকবে না। শরীরটা সকল শাসন-সংযমের বাঁধ ভেঙে বন্যবর্বর হয়ে উঠেছে। অকস্মাৎ রঘুপতি বললেন : থাক্, থাক্, তোমার এই জল ও গামছা আমি স্পর্শ করব না।

পুষ্কর তার গুরুর কাছ থেকে এরূপ ব্যবহারের কারণ বুঝতে না পেরে অবাক হলেও মুহূর্তে এক দায়িত্বশীল পুরুষে রূপান্তরিত হল। গামছা ভূমি থেকে তুলে যথাস্থানে রাখতে উদ্যত হল। তখনই দেখল রঘুপতির দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। শিষ্যসুলভ একরকম সংকোচ এত গভীরভাবে তাকে নাড়া দিল যে, রঘুপতির দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছে; অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল।

পুনশ্চ বিরক্তভাবে রঘুপতি বললেন, থাক্, থাক্, গামছায় আর হাত দিতে হবে না।

রঘুপতির বুকের ভেতর মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যের নির্দেশবার্তার সেই ধ্বনি সহসা অবিরাম দ্রুতলয়ে বাজতে থাকে। একনিমিষে তিনি অন্য মানুষ হয়ে গেলেন। রক্তে তার বিপুল উত্তাপ। শিরায় উপশিরায় টাটানো যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা নিয়েই তিনি গৃহে প্রবেশ করলেন।

পুষ্করের বুকের ধকধকানিটা তখনও শেষ হয়নি। একইসঙ্গে বুকের মধ্যে তীব্র চিনচিনে ভয়ও; গুরুর অভিশাপে যদি কোনও অনর্থ হয়, অমঙ্গল হয়- এই ভাবনায় দিশেহারা সে। যুগপৎ ভয় ও ভাবনায় শুধু মনে মনে বলতে লাগল : এখন কী হবে! অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে গোমতীর বুকে। মন্দির থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে বাতাসে। রঘুপতি তখন কাপড় ছেড়ে, শ্লথ পায়ে বারান্দার মাটি মাড়িয়ে এগিয়ে এসে জল নিয়ে পা ধুলেন।

আশ্চর্য চঞ্চল অথচ দ্বিধাভরা চোখে তাকিয়ে অনেক কিছু সন্ধানের চেষ্টা করল পুষ্কর। তারপর, কাঁপা কাঁপা গলায়, ধীরেআস্তে কণ্ঠে বলল : প্রভু, আমি কি কোনও অপরাধ করেছি?

রঘুপতির লুব্ধ অন্তর এই কথারই অপেক্ষায় ছিল। এই কথায় রঘুপতির চোখেমুখে এক অদ্ভুত অপার্থিব মুগ্ধতা জন্ম নিল। শরীরজুড়ে চলছে শিরশিরানি, অদ্ভুত শিহরন। শিষ্যের কথা গভীরভাবে তার বুকে বাজল, তৎক্ষণাৎ চকিতবিদ্ধ ব্যথায় ঝংকার দিয়ে, কিঞ্চিৎ উগ্রস্বরে বললেন : কে বলছে তুমি অপরাধ করেছ?

পুষ্কর ব্যথিত অন্তরে চুপ করে স্থির হয়ে রইল। রঘুপতি অস্থিরভাবে বারান্দায় হেঁটে চলেছেন। বৃষ্টিও পড়ছে অবিরাম, তবুও তার রক্তে দুরন্ত ক্ষোভ, কোষে অকোষে প্রবল প্রতিহিংসার আগুন। এইক্ষণে তার মনে হচ্ছে : জীবনের চরম প্রাপ্তি ও পরম নিবৃত্তি হল দেবীর জন্য জীববলি দেওয়া। তাছাড়া তো জীবনটা শুধুই ফাঁকি, এই ফাঁকি দিয়ে বৃথাই মোক্ষ খোঁজা হবে। এক উদ্ভ্রান্ত উত্তেজনায় তার বুক কাঁপতে থাকে।

রঘুপতির শিরা-উপশিরায়, শোণিতবিন্দুর প্রতিটি পরমাণু অংশে, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে ‘জীববধ নিষিদ্ধ’ ঘোষণাটি অবিচলিতভাবে বিদ্যমান; কিন্তু এই চিন্তার পাশেও আর-একটি চিন্তা মস্তিষ্কের মধ্যে ঘুরছে, ফিরছে। এক সময়ে এক মনে দুই প্রকার চিন্তার বাস অসম্ভবই বটে, কিন্তু মূল চিন্তার কৃতকার্যতা লাভের আশায় অন্য-একটি চিন্তা আশ্রয় করে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ না হলে তো হয় না। প্রথম চিন্তায় কৃতকার্য হওয়ার আশায়ই দ্বিতীয় চিন্তা প্রবল হয়ে উঠেছে। চিন্তার আধার মস্তক, তাই ‘জীববধ নিষিদ্ধ’ ঘোষণাটি মগজে চিরস্থায়ী হয়ে থাকলেও দ্বিতীয় চিন্তাটি উদিত হয়ে একেবারে হৃদয়ের অন্তঃস্থান অধিকার করে আছে। তাই তিনি পুষ্করের পিঠে হাত দিয়ে, কোমলস্বরে বললেন : বৎস, তুমি এখন কীর্তনে যাও, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

পুষ্কর একটু চিন্তামুক্ত হয়ে, বিচলিতস্বরে বলল, প্রভু আপনিও চলুন।

একথাটি যখন রঘুপতির কর্ণে প্রবেশ করল, তখন অন্তরে ব্যথা লাগল, হৃৎপিণ্ড আহত হল। রঘুপতির অন্তর আপাতত দ্বিতীয় চিন্তায়ই ব্যস্ত; কারণ, এই চিন্তার মধ্যে আশা, ভরসা, নিরাশা- সকলই নিহিত। কাজেই পূর্বভাবের কিঞ্চিৎ পরিবর্তন বোধ হচ্ছে। রঘুপতির নয়নে, ললাটে ও মুখশ্রীতে বিভিন্ন ভাব জন্ম নেয়। এইসব ভাব ধারণ করেই রঘুপতি বললেন : আমার আজ যাওয়া হবে না।

সসম্ভ্রমে পুষ্কর জিজ্ঞেস করল, কেন প্রভু?

পাপীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোথায় না আছে? কিন্তু মায়ের পদাশ্রিত হতে পারলে পরকালের মুক্তিপথের পাপকণ্টক বিদূরিত হয়ে স্বর্গের দ্বার পরিষ্কার থাকবে। যে-ব্যক্তি তার প্রতি একবার ভক্তির নয়নে দৃষ্টিপাত করে, সেই ব্যক্তি নরকাগ্নি থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গে নীত হবে। তার অধিক কী বলব? আমি মনের আনন্দে মায়ের পবিত্র চরণে আত্মসমর্পণ করব। অন্য কোনও বিষয় অন্তরে স্থান দেব না। অপূর্ব চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে রঘুপতি বলে যেতে লাগলেন : দেখো বৎস, তোমার প্রতি আমি একটু আগে যে-কঠোর আচরণ করেছি, এতে তুমি কিছু মনে কোরো না। আমার মন আজ ভালো নেই।

বিস্মিত হয়ে পুষ্কর বলল, কী হয়েছে প্রভু!

মায়াপূর্ণ আঁখিতে পুষ্করের দিকে একবার তাকিয়ে তাকে দেখে নিয়ে রঘুপতি বললেন, মহারাজকে মায়ের কৃপায় তুচ্ছ জ্ঞান করি, কেননা মায়ের সেবায় যে বাধা দেয়, সে অধঃপাতেই যায়। মহারাজই মায়ের উদ্দেশ্যে জীববলি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।

পুষ্করের শরীর রোমাঞ্চিত হল, হৃদয় কাঁপতে লাগল, আকণ্ঠ শুকিয়ে উঠল। সে শুষ্ককণ্ঠেই বলল, সে কী প্রভু!

আত্মগৌরব ও আত্মপ্রশংসায় মত্ত রঘুপতি বললেন, মহারাজের আদেশ।

পুষ্কর চমকে উঠল- চমকিতভাবে একদৃষ্টে রঘুপতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার অঙ্গ শিউরে উঠল। চক্ষু অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ভয়ে থতমত খেয়ে বলল, কোন্ মহারাজ?

এখানে কয়জন মহারাজ আছেন? একজনই তো! মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য। এই নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই রঘুপতির মনের আগুন দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ জ্বলে উঠল। এই আগুন বের হওয়ার পথ না পেয়ে তার অন্তর একেবারে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তিনি বিদ্রুপের কণ্ঠে যোগ করলেন : তিনিই আদেশ করেছেন, তার রাজ্যে জীববলি আর হবে না।

পুষ্কর কাতরস্বরে জিজ্ঞেস করল, জীববধ?

একটু রোষভাবে বললেন রঘুপতি, আহ্, কী উৎপাত! আমি বলছি জীববলি, আর তুমি বলছ জীববধ।

পুষ্কর স্বগতোচ্চারণ করতে লাগল : প্রভু যদি মহারাজের শত্রু হয়ে দাঁড়ান, তাহলে প্রভুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া নিতান্তই কঠিন; বিশেষত প্রভু যদি তার শত্রুতাসাধনে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, তাহলে এই কার্য শেষ না করে প্রাণ থাকতে ক্ষান্ত হবেন না। ক্ষান্ত হবেনই-বা কেন? তার সঙ্গে অনেক লোক রয়েছে। তাদের নানাপ্রকারে উৎসাহিত করে উত্তেজিত করতে তার কোনও সমস্যা হবে না। একবার বিফল হলেও দ্বিতীয়বার কিংবা তৃতীয়বার অবশ্যই সফল হবেন- এই কথাই পুষ্করের কর্ণে বাজতে লাগল। আর প্রকাশ্যে বলল, কোনওরকম জীববলিই হতে পারবে না?

না। কিন্তু ‘মা’ই আমার সহায়, আমার রক্ষাকর্তা। মায়ের রাজ্যে বাস করে তার সাধনায় জীবন শেষ করে দেয়াই আমার কর্তব্য! একথা বলে রঘুপতি মনে মনে বলতে লাগলেন : রাজমন্ত্রী ত্রিপুরা রাজ্য রক্ষা করার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ বা সন্ধির মন্ত্রণা দেন, নির্জনে বসে কতপ্রকার বুদ্ধির চালনা করেন, কিন্তু আমার এই সাধনা রাজকার্যের অপেক্ষা কম নয়। যেখানে অস্ত্রের শক্তি নেই, মহাবীরের বীরত্ব নেই, সাহস নেই, সাধ্য নেই, সেইখানেই মায়ের সেবক এই আমি- রঘুপতি। শত অর্গলযুক্ত দ্বারও অতি সহজে উন্মুক্ত করে থাকি। যেখানে বায়ুর গতিবিধি নেই, সেখানেও আমি অনায়াসে গমন করি। যে যোদ্ধার অন্তর কঠিন পদার্থে গঠিত, তার মনও গলিয়ে তরল পদার্থে পরিণত করতে পারি। যে গুহাসাধক সূর্যের মুখ কখনও দেখেননি, চেষ্টা করলে তার সঙ্গেও দুটি কথা বলে আসতে পারি। তারপর পুষ্করের উদ্দেশ্যে বললেন : নিশ্চয় জেনে রেখো, পাপশূন্য কোনও দেহ নেই, ধর্মশূন্য কোনও জগৎ নেই। যেখানে যা খুঁজবে, সেইখানেই তা পাবে।

হৃদয়কম্পন বজ্রধ্বনির মতো রঘুপতির কথা শ্রবণে পুষ্করের চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মহারাজ গোবিন্দমাণিক্যকে পুষ্কর বালক বয়স থেকেই দেবতা বলে জেনে এসেছে। আকাশের পূর্ণচন্দ্রের প্রতি শিশুদের যেমন একপ্রকার আসক্তি থাকে, মহারাজের প্রতি পুষ্করের সেইরূপ মনোভাব রয়েছে। তার প্রতি পুষ্করের মুগ্ধতা, তীব্র আকর্ষণ। তার প্রশান্ত মুখশ্রী দেখে সে নিজের প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। সে ভাবতে লাগল : বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যত সহজ, ঘরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ততই কঠিন- দুষ্কর! বাইরের শত্রু দূরে থাকলে অবশ্য আতঙ্কে থাকে- কোন্ সময়ে, কোন্ সূত্রে, কোন্ সুযোগে, কী উপায়ে, কোন্ পথে, কার সাহায্যে এসে সুকৌশলে শত্রুতাসাধন করবে; কিন্তু ঘরের শত্রু! আর ঘাতক যদি হন স্বয়ং প্রভু- তিনিই তো ত্রিপুরার ধর্মপ্রাণ, ত্রিপুরার ধর্মাত্মা- তাহলে বিনাশ অনিবার্য! নিজ আত্মাই বিসর্জক। কী নিদারুণ! এসব ভাবতেই কষ্ট বোধ করছে পুষ্কর! ধর্ম ও মহারাজ তো ভিন্ন নন? তাদের আত্মা এক, বাসনা এক, কামনা এক, আশা এক, ভরসা এক- সকলই এক। তবুও কী পরিতাপ! পরিতাপের স্বরেই পুষ্কর বলল : মহারাজ জীববলি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন?

একথা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গেই রঘুপতি অতি দৃঢ়স্বরে বললেন : হ্যাঁ, এক কথা আর কতবার বলব! তারপর পুষ্করের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে যোগ করলেন, মহারাজ যে আদেশই দেন না কেন, তার একটা প্রতিবিধান করতেই হয়। মনে রেখো, মুখে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকে, বাস্তবে তার অর্ধেক পরিমাণও সিদ্ধলাভ করে না, করলে জগতে এত অশান্তির কারণ থাকত না।

একথা বলে রঘুপতি অনুভব করলেন তার শুকনো গলাটি আরও শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে যা ঘটতে চলেছে তাতে এবার ধন-প্রাণ দুটিই হারাতে হবে।

তা অবশ্য। একথা বলেই পুষ্কর সামনের দিকে তাকিয়ে রঘুপতির চোখ দুটি দেখার চেষ্টা করল। যদিও তিনি তার দিকে তাকিয়ে নেই, বরং আঁতিপাঁতি করে কী যেন অন্বেষণের চেষ্টা করছেন বারান্দার এককোণে- বোধহয় নিজের কথার যথাযথ প্রমাণ অনুসন্ধান করছেন। কিন্তু আর কোনও মানুষ তো দূরে থাক্, বারান্দার কোণে নির্জন আধা-অন্ধকার জায়গাটিতে একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। নিজের মাথার চুলগুলো বুলাতে বুলাতে আনমনে পুষ্কর বলে উঠল : আমি মহারাজের কাছে যাই, তাকে মিনতি করে বলি...।

কথাটি শেষ হওয়ার আগেই রাগের একটা ঝটকা বয়ে গেল রঘুপতির শিরদাঁড়া বেয়ে। রাগে তার শরীর চিড়বিড় করছে। রাগ সামলাতে ও নিজের হাতকাটা জামার পকেটে রাখা পানের কৌটা বের করে একটি পান মুখে তুলে নিলেন। কয়েক দফা পানের রস গিলে নিলে অন্তরের রাগ আর রসের লড়াইয়ে রাগ খানিকটা প্রশমিত হয়ে আসতেই পুষ্করের দিকে তাকিয়ে ডান-হাতের অনামিকা নেড়ে বলে উঠলেন, সেই চেষ্টা বৃথা।

একেবারেই চোখের পলকে পুষ্কর বলল, তবে কী করতে হবে?

কিছুক্ষণ ভেবে রঘুপতি বললেন, মায়ের তৃপ্তি সাধিত হয় রক্তপানে। তিনি বলি চান। তারপর স্বগতোচ্চারণ করলেন : আর বিলম্ব করা উচিত হবে না, কোন্ সময় কার অদৃষ্টে কী ঘটে, তা কে বলতে পারে? কিন্তু যত বিলম্ব হবে, ততই ভাগ্যে অমঙ্গলের ভাগ বেশি পড়বে। যা করতে হবে, তার ওপর আর কোনও কথা নেই। শুভকার্যে বিলম্ব কেন? অতঃপর পুষ্করের উদ্দেশ্যে বললেন : বৎস, তুমি একবার রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে গোপনে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অনুরোধ করবে। এখন তুমি কীর্তনে যাও।

একথা শুনে বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে গেল পুষ্করের। সব হিসাব তার ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সে মনে মনে বলতে লাগল : আমি যতই রাজভক্তই হই না কেন, মহামহিম ধার্মিকপ্রবরই হই না কেন, বলশালী বীরপুরুষই হই না কেন, মহাপ্রাজ্ঞ সুপণ্ডিতই হই না কেন, আমার প্রভুর মায়াজাল ভেদ করা ভীষণ কঠিন। তার বিরুদ্ধে যাওয়াও সহজ নয়। অতঃপর সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবেগমথিত স্বরে বলল : আপনার আদেশ উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই, প্রভু।

বৃষ্টি থেমে গেল, তবে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কোথাও মেঘের রং হালকা, যেন অবিরাম ঠিকানা পরিবর্তন করে উড়ে যাচ্ছে। একটি প্রায় ধূসর ধোঁয়ার স্তর এলোমেলোভাবে ঝুলে আছে ভেজা মাটি ও মেঘলা আকাশের মাঝামাঝি। কখন ছুঁয়ে ফেলেছে ত্রিপুরার উঁচু পাহাড়ের মগডাল। ঝিমণ্ডধরা সন্ধ্যা এগিয়ে আসতে থাকে।

মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে অনেক দীপ জ্বালানো হল। একদল দেবদাসী অপূর্ব বেশে সজ্জিত হয়ে যুক্তকরে মন্দির-দ্বার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ভুবনেশ্বরী মন্দিরের প্রধান দেবদাসী সত্যবতী মন্দিরের অভ্যন্তরে বিগ্রহের পুরোভাগে পঞ্চপ্রদীপ হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। দুইজন দেবদাসী মৃদঙ্গ ও মন্দিরা বাজাতে থাকে। দর্শকের সংখ্যা বেশি নয়; পুষ্কর তাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে অঞ্জলিবদ্ধ হাতে দণ্ডায়মান হল। আরতি আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেবদাসীবৃন্দ সুঠাম দেহে নৃত্যের তালে ছন্দিত হয়ে উঠল। মৃদঙ্গ ও মন্দিরার ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সঙ্গে নূপুর ও কঙ্কণকিঙ্কিণীর নিক্বণ ভেসে বেড়াচ্ছে। নৃত্যের সঙ্গে পুষ্করের কীর্তনকণ্ঠ উদ্ভাসিত হল, গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু তাল দ্রুত। এই কীর্তনের ধ্বনিতে দেবদাসীরা যেন আত্মহারা হয়ে পড়েছে। তাদের দেহ আলোড়িত করে নৃত্যের ঘূর্ণাবর্ত উদ্বেলিত হতে থাকে; কিন্তু পুষ্করের কীর্তনে মন বসল না, ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়তে থাকে তার। নিদারুণ বেদনা জড়ানো দুঃসহ গ্লানি আর এক অজানিত আতঙ্কে এই সময়টা তার কাছে বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। প্রভুর সঙ্গে যেসব কথা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, দেখতে দেখতে তার শাখাপ্রশাখা বেরিয়ে আসতে থাকে। পুষ্করের মনে অনিবার্য বেগে এমনসব কথা উঠতে থাকে, যা তার আশৈশব বিশ্বাসের মূলে অবিশ্রাম আঘাত করে। পুষ্কর পীড়িত ক্লিষ্ট হচ্ছে, কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো ভাবনাগুলো কিছুতেই ক্ষান্ত হতে চায় না।

যে-দেবীকে পুষ্কর এতদিন ‘মা’ বলে জেনে এসেছে, প্রভু আজ কেন তার মাতৃত্ব অপহরণ করলেন, কেন তাকে হৃদয়হীন শক্তি বলে ব্যাখ্যা করলেন? শক্তির সন্তোষই কী, আর অসন্তোষই-বা কী! শক্তির চোখই-বা কোথায়, কানই-বা কোথায়! শক্তি তো মহারথের মতো তার সহস্র চক্রের তলে জগৎ কর্ষিত করে ঘর্ঘর শব্দে চলে; তাকে অবলম্বন করে কে চলল, তার তলে পড়ে কে চূর্ণ হল, তার ওপরে উঠে কে উৎসব করল, তার নিম্নে পড়ে কে আর্তনাদ করল, সে তার কী জানবে! তার সারথি কি কেউ নেই? পৃথিবীর নিরীহ অসহায় ভীরু জীবের রক্ত বের করে কালরূপিণী নিষ্ঠুর শক্তির তৃষ্ণা নির্বাণ করতে হবে, এ-ই কি তার ব্রত? সে তো নিজের কাজ নিজেই করে চলেছে, তার দুর্ভিক্ষ আছে, বন্যা আছে, ভূমিকম্প আছে, জরা-মরা-দাহ আছে, নির্দয়-মানব-হৃদয়স্থিত হিংসা আছে।

একসময় কীর্তন থেমে গেল। দেবদাসীদের নৃত্যও।

পুষ্কর জাতিতে রাজপুত, রাজ্যত্যাগী রাজপুত্র। তার পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পর পিতৃব্য রঘুপতি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন ত্রিপুরায়। এখানে এসেই রঘুপতি হন রাজপুরোহিত। সেই সময় পুষ্কর নিতান্ত বালক ছিল। এই অনাথ বালককে রঘুপতি ভুবনেশ্বরী মন্দিরের কাজেই নিযুক্ত করেন। রঘুপতির দ্বারাই সে লালিত-পালিত-শিক্ষিত-দীক্ষিত। বালকবেলা থেকে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের আশ্রমে পালিত হয়ে পুষ্কর একেই নিজ গৃহের মতো ভালোবাসতে শিখেছে। ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাথরের ঘাটের প্রত্যেক কৃষ্ণসোপান, প্রত্যেক কৃষ্ণপ্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় রয়েছে। তার মা নেই বলেই হয়তো-বা ভুবনেশ্বরী মন্দিরের প্রধান দেবদাসী সত্যবতীকে সে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করে, ভালোবেসে ‘খুড়িমা’ বলে ডাকে। মন্দিরসংলগ্ন আশ্রমবাটির প্রধান ভবনেই তার খুড়িমা থাকেন। এই আশ্রমবাটিতে বহুসংখ্যক দেবদাসীর বসবাস। বেশির ভাগ সুন্দরীর বিয়ে হয় না, নৃত্যগীত দ্বারা দেবসেবা করে যৌবনকাল যাপন করে, আর যাদের বিয়ে হয়, তারা এই মন্দির ত্যাগ করে চলে যায়।

খুড়িমার সঙ্গে আশ্রমবাটিতে প্রবেশ করতেই পুষ্কর দেখল দময়ন্তী ছোট্ট পিতলের প্রদীপ হাতে দাওয়া থেকে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা-আরতিটা হয়তো-বা আজ একটু দেরি করেই দিয়েছে। আলো মরেছে তো অনেক আগেই। রান্নাঘরের কোণে রাখা উনুনের নিচে থেকে একখুঁচি ছাই তুলে নিল সে। নিয়ম করেই পিতলের প্রদীপটা সন্ধ্যা-আরতির আগে ও পরে প্রতিদিন মাজে, কিন্তু আজ এত দেরি করে মাজতে যাচ্ছে কেন? প্রায় অর্ধচন্দ্রাকার এই আশ্রমবাটির প্রধান ভবনের পাশাপাশি কয়েকটি আশ্রমকক্ষের প্রথমটি রঘুপতির, তার পরেরটি সত্যবতী ও তার কন্যা দময়ন্তীর। আর শেষের ঘরটি পুষ্করের। মাঝখানে গোটা চারেক অন্য দেবদাসীদের ঘর। আরও আছে কয়েকটি অতিথিশালা। সামনে উঠোন। সত্যবতীর ঘরের ঠিক উলটো দিকে, একটু দূরে, উঠোনে মৃত্তিকার বাঁধানো ছোট্ট তুলসীমঞ্চ। খানিকটা পার্থক্যে বেড়া দেওয়া কলতলা, জল রাখার জায়গা। একপাশে বাসকপাতার ঝাড়, আর বৃষ্টির জল পেয়ে বেড়ে ওঠা আগাছাগুলো। মাজা প্রদীপটিতে প্রতিদিন ঘৃত দিয়ে সলতে জ্বালিয়ে নেয় দময়ন্তী। কয়েক পা হেঁটে গিয়ে তুলসীমঞ্চে পৌঁছে সে জ্বলন্ত প্রদীপটি তুলসীমঞ্চের গায়ে ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে প্রণাম করে। তারপর প্রদীপটি এনে কুলুঙ্গির মধ্যে রাখে। গলায় আঁচল টেনে প্রণাম করে। ঘৃত ফুরিয়ে গেলে প্রতিদিনই প্রদীপটি আপনা-আপনি নিভে যায়। তবুও যে খানিকক্ষণ জ্বলে, তাতেই শিসের ধোঁয়ায় কুলুঙ্গির ভেতরটা কালিতে ছেয়ে যায়। দময়ন্তীর এই নিয়ম করে সন্ধ্যা-আরতি দেওয়াটা দূর থেকে দেখে পুষ্কর, কিন্তু আজ তার দেখা হয়নি। মাজা প্রদীপটি নিয়ে দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে পিচ্ছিল উঠোনে পা দিল দময়ন্তী। বৃষ্টি হয়ে হয়ে রান্নাঘরের সামনটায় শেওলা জমে উঠেছে। প্রতিদিনই উনুনের ছাই রান্নাঘরের সামনে ফেলে দময়ন্তী, পিচ্ছিল ভাবটা কমবে বলে, কিন্তু কেবলই বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায়; আর যেটুকু বাকি থাকে, প্রতি সকালে সত্যবতীর ঝাঁটার আঘাতে তাও হাওয়া হয়ে যায়।

পা টিপে টিপে সাবধানে কলতলায় পৌঁছে গেল দময়ন্তী। আবছা অন্ধকারে বারান্দার ধারে এসে দাঁড়াল পুষ্কর। কলতলার পথ দেখিয়ে নেওয়ার প্রদীপের আলোয় তার কাছে মনে হল : দময়ন্তী মানবী নয়, স্বর্গচ্যুত এক দেবী। দময়ন্তী যে-বয়সে পা দিয়েছে এই বয়সে তার শারীরিক সৌন্দর্য অকস্মাৎ কোথা থেকে যেন উপচে পড়ে সর্বাঙ্গ দখল করে নিয়েছে। একসময় পুষ্করের ভুল ভাঙল, মনে মনে বলল : না, দময়ন্তী মানবীই বটে!

প্রদীপটি ধুয়ে নিয়ে ফিরে আসতে গিয়েই পুষ্করের গলা পেল দময়ন্তী। পুষ্কর বলল, খবরাখবর কিছু পেলে? কার কণ্ঠস্বর এ? স্তম্ভিত বিস্ময়ে আকুল হয়ে এক-হাতে শাড়ি চেপে ধরে ঘুরে দাঁড়াল। খুঁজে বেড়াতে গিয়ে দৃষ্টি গিয়ে বিঁধল পুষ্করের ওপর। দময়ন্তীর চেতনাকে রুদ্ধ করে কালচক্র একমুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে আবার বিপরীত দিকে আবর্তিত হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গেই পুষ্করের কণ্ঠস্বর আবার তার চেতনার দ্বার উন্মুক্ত হল, পুষ্কর বলল : খবরাখবর কিছু পেলে?

শ্বেতকমলের মতো মুখকান্তি রক্তকমলের রূপ ধারণ করে। দময়ন্তী সহসা এমনই বিস্মিত হয় যে, কিছুক্ষণ নড়তেই পারল না। তারপর বলল, আমাকে কিছু বলছ, পুষ্করদা? চলবে