ঢাকা ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নাট্যোপন্যাস (পর্ব ৪)

রাজাবলি

ড. মুকিদ চৌধুরী
রাজাবলি

মাথার ওপর পুঞ্জে পুঞ্জে মেঘ জমানো। কীসের বেদনায় তারা ফুলে ফুলে গুমরে গুমরে গুঁড়ি গুঁড়ি বারিবর্ষণ করছে? শুক্লাদ্বাদশীর রাত্রি অমাবস্যার অন্ধকারে ঘিরে ফেলেছে কেন? আকাশের দিকে জিজ্ঞাসু হয়ে একবার তাকাল পুষ্কর, কী সর্বনাশ লুকিয়ে আছে এই নীল রহস্যের মধ্যে? গালে নীলচে দাড়ির আভাস, খোঁচা মারছে একটু একটু। পুষ্কর গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে কণ্ঠ থেকে অতীব ভারী স্বরটি ছিটকে বলল : আশপাশে আর তো কেউ নেই! তাছাড়া সাঁঝের মুখে হাওয়ার সঙ্গে কথা বলার মতিভ্রম এখনও আমার হয়নি!

দময়ন্তী শক্ত হল। পুষ্করের স্বরটা বাঁকা! ‘খবরাখবর’ বলতে সে কী জানতে চাইছে একথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই দময়ন্তীর, তাছাড়া এই সময় আর এই স্থান কোনওটিই এর জন্য উপযুক্ত নয়, তাই সে একটু নিমরাজি-গোছের মুখ করে চুপ করে রইল। কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে রইল। দময়ন্তীকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে, ক্রুদ্ধ ও কর্কশ কণ্ঠস্বরে পুষ্কর বলল : যাই তাহলে, কাজ আছে।

পুষ্কর আর দাঁড়াল না। তার মূর্তিটি আস্তেধীরে মিলিয়ে গেল ঝাপসা অন্ধকারে। টিপটিপ বৃষ্টি আবার পড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে ভিজে হাওয়াও। হাতে ধারণ করা প্রদীপটি কাঁপছে। হাত আঁকড়ে ধরল দময়ন্তী। অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে একমুহূর্তে। সে রান্নাঘরে ফিরল। অনুমান করল দময়ন্তী : যেকোনও মুহূর্তে পুষ্কর আবার ‘খবরাখবর’ জানতে বেরিয়ে আসবে। তবে একটু আগে ‘খবরাখবর’ এমন আচমকা সময়ে জানতে চাইবে তা সে প্রত্যাশা করেনি। পুষ্করের জন্য তার অন্তরে অনুকম্পা জেগে থাকায়, সে জানে, পুষ্করকে অপমান করার সময় মাথা ও মুখের ভাষা কোনওটিই ঠিক থাকে না রঘুপতির। পুষ্করের হৃদয়-জ্বালাও কম নয়। পুষ্করের এই অবস্থা বোঝে দময়ন্তী। কুলুঙ্গির ওপর প্রদীপ রেখে দিল সে। বাইরে ফিসফিসিয়ে বৃষ্টি পড়েই চলেছে, আবার দমকা হাওয়াও দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। একটা নয়, অনেক ভাবনাই দময়ন্তীর মাথায় ঘুরছে। ভাবল, হ্যারিকেন জ্বেলে রাত্রির আহারের আয়োজন করে নেওয়া ভালো। হ্যারিকেনের সন্ধানেই সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই একঝলক ভিজে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগল তার চোখেমুখে। বাইরে এখন ঝুপসি অন্ধকার। কুপি জ্বলছে উঠোন পেরিয়ে পুষ্করের ঘরেও, সে কী করছে বোঝা যা”েছ না। অন্যান্য আশ্রমকক্ষ থেকেও শব্দাশব্দি তেমন আসছে না, বৃষ্টির ছাট আটকানোর জন্য অধিকাংশ দ্বারই বন্ধ, তবে কিছু আলোর রেশ পাওয়া যাচ্ছে দ্বারের ফাঁকফোকর দিয়ে।

পুষ্করের কথা ভাবতে ভাবতেই দময়ন্তী আবার ফিরে এল রান্নাঘরে। এসেই দেখল দেয়ালে সত্যবতীর ছায়া নড়ছে। তার চারপাশে যাবতীয় রান্নার জিনিসপত্র- একটি জলের বালতি, কয়েকটি বাটি-হাঁড়ি-বাসন ছড়ানো। উনুনের পাশের একটি তাকের ওপর কয়েকটি ছোট-বড় কৌটো ও বাটা- হলুদ, লঙ্কা, জিরে, সরষে-মশলাপাতি; একটি মাটির পাত্রে নুন, আর হাতভাঙা একটি মাটির পাত্রে তেল, অন্যটিতে পলা। উনুনের একপাশে চেলাকাঠের টুকরোগুলোও রাখা আছে। মোটামুটি গনগনে হয়ে জ্বলছে কাঠের আগুন। হাঁড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা অগ্নিশিখার আলো পড়ছে সত্যবতীর মুখে। একইসঙ্গে দময়ন্তী দেখতে পেল, উনুনের পাশের দেয়াল ও চাল যেখানে মিশে গেছে, সেইখানেই কয়েকটি জলধারা সৃষ্টি হয়েছে। এক দিনের বৃষ্টিতেই চালের ফাটল বেয়ে জল গড়িয়ে আসছে দেয়ালে। খুব বেশি নয়, তবুও বৃষ্টি চলতে থাকলে তো ভাবারই কথা। ভাত ফুটে উঠেছে।

হাঁড়ির ঢাকনার শব্দে চমক ভাঙল দময়ন্তীর। সত্যবতী খুন্তি দিয়ে সন্তর্পণে ঢাকনাটি নামাতেই টগবগ করে ফুটে ওঠা শব্দের সঙ্গে ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। দু-একটা ভাত টিপে দেখলেন, প্রায় হয়ে এসেছে। আর কাঠের গোঁজা না দিলেও চলবে। ফেন গেলে ভাতের হাঁড়িটা আবার অল্প আগুনের ওপর রাখতে রাখতে সত্যবতীর বুক খালি করে একটি শ্বাস বেরিয়ে এল। সত্যবতীর সারাদিনের নানা ভাবনা, কাজ আর নীরব উত্তেজনা কীভাবে যেন এই সুনসান রাত্রিতে ঢিলে হয়ে পড়তে লাগল। কোথা দিয়ে একটা-পর-একটা দিন কাটে, রাত্রি আসে আর যায়, টের পান না তিনি; তবুও মাঝেমধ্যে হঠাৎ সময় থমকে দাঁড়ায়, তখন অসহ্য মনে হয়। কেননা, চারদিকের নৈঃশব্দ্য তাকে গিলে খেতে আসে, হাহাকার করে ওঠে একাকিত্বের যন্ত্রণা। মনে হয় তিনি আর পারছেন না। তবুও পেতলের কড়াইতে গরম তেলে বেগুন ও কাঁচকলার ডুমোগুলো অল্প ভেজে তুলে রাখেন। আবার সামান্য তেল ঢেলে দিলেন কড়াইতে। শুকনো লঙ্কা, পাঁচ ফোড়ন ও তেজপাতা ভাজতে থাকেন তিনি, পেতলের খুন্তি দিয়ে। সুগন্ধ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাঙা সরষে ঢেলে দিলেন। চুড়বুড় করে সরষে পুড়ে সুন্দর গন্ধ বের হওয়ামাত্র কিছুটা আদা-বাটা দিয়ে নেড়েই তরকারি ঢেলে দিলেন।

সামান্য একটু আটা গুলেও সঙ্গে দিলেন। পরিমাণ মতো নুন ও হলুদণ্ডবাটা দিয়ে থকথকের চেয়ে একটু ঝোলঝোল করলেন। তারপর ঘৃত ঢেলে ভালো করে মিশিয়ে নিলেন। আগুনের চূড়া থেকে ঠন করে মাটিতে কড়াইটি নামিয়ে পাখির ডানা-ঝাড়ার মতো হাত ঝাড়লেন। বেশ বোঝা গেল, কড়াইয়ের উষ্ণতার কিছু অংশ তার মেজাজেও সঞ্চারিত হয়েছে। কেননা, তিনি এখনও রঘুপতির বিছানা পরিপাটি করে নিতে পারেননি। একবার খাওয়া হয়ে গেলে আর রঘুপতিকে বসিয়ে রাখা যায় না। একথা ভেবেই সত্যবতী বারান্দায় এসে দেখতে পেলেন, দময়ন্তী তার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কন্যার ওপর স্থিরদৃষ্টি স্থাপন করলেও একমুহূর্তে অস্থির হয়ে উঠলেন। করুণ চোখে স্থবির ও অস্থির দৃষ্টিতে আর-একবার কন্যাকে দেখে নিলেন। তখনই তার মনে পড়ল, দেবদাসীদের মধ্যে কয়েকদিন ধরেই আলোচনা চলছে : যেভাবেই হোক দময়ন্তীকে পাত্রস্ত্র করা আবশ্যক। তার কানে সেকথা পৌঁছানোর জন্যই হয়তো-বা আজ সন্ধ্যায় ধর্মকর্ম করার সময় প্রকাশ্যেই কয়েকজন এই আলোচনায় লিপ্ত হয়। এসব শুনে তিনি বড্ড বিষণ্ণ হন। তিনি ইতঃপূর্বে এরকম দুরাশাকে নিজমনে ¯’ান দিয়ে এসেছিলেন। সত্যবতী আর দাঁড়লেন না।

সত্যবতী চলে এলেন রঘুপতির ঘরে। রাজ্যের জামা-কাপড় আর গামছা সবই স্তূপ হয়ে রয়েছে বিছানার ওপর। জিনিস বলতে এই ঘরের মধ্যে একটি কাঠের খাট, একটি আলনা, একটি আলমারি। কাঠের আলমারির মধ্যে যাবতীয় কাগজপত্র, দু-একটি তোলা ধুতি ও পাঞ্জাবি। তাকের ওপর কাগজ পেতে কয়েকটি আরশোলা মারার বড়ি রেখে দিয়েছিলেন সত্যবতী, এইজন্য যে, নেংটি ইঁদুর বা আরশোলা ঢুকে কাপড়গুলো কাটতে না পারে। খাটের একপাশে একটি মস্তবড় কাঠের সিন্দুকও আছে। তবে তা কোনওদিন খুলে দেখেননি সত্যবতী, যদিও বালিশের নিচে সিন্দুকের চাবি যেমন তেমনই রয়েছে।

কোনওরকমে জামা-কাপড়গুলো আলনার ওপরেই জড়ো করে রেখে দিলেন সত্যবতী, আর মনে মনে বলতে লাগলেন : দময়ন্তীকে বলব কাল যেন সবকিছু সে পরিপাটি করে রাখে। খাটের ওপর পাতা শাদা রঙের চাদরটি টানটান করে পেতে নিলেন তিনি। তারপর তিনটে বালিশও। একটি কাঁথাও পাশে রাখলেন। বাদলের দিন, তার ওপর হাওয়া দি”েছ, ঠান্ডা লাগতে পারে। মশারিটি টাঙাতে গিয়েই সজাগ হলেন সত্যবতী। বাইরে কার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। একটু অপেক্ষা করলেন, নিশ্চুপ থেকে।

কে হতে পারে! এমন রাতবিরাতে এই বাদল মাথায় করে কারও তো আসার কথা নয়, অথচ পায়ের আওয়াজ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছেন তিনি। সঙ্গে একপলক ক্ষীণ হ্যারিকেনের আলোও এসে পড়ছে দরজার বাইরে। মশারি খাটের ওপর রেখেই, একটু এগিয়ে এলেন সত্যবতী, প্রায় দ্বারের কাছে। হ্যারিকেনের আলো ততক্ষণে নেভানো হয়ে গেছে। কানখাড়া করে শুনতে গিয়েই বারান্দা থেকে রঘুপতির গলা পেলেন : আমার ঘরে আলো জ্বলছে দেখে...

একটা শাদা শাড়ি পরে আছেন সত্যবতী। একটু তামাটে রঙের চুল খোলা অবস্থায় লকলকিয়ে উঠেছে তার কাঁধের ওপর। তিনি চোখ টানটান করে থমথমে মুখে তাকালেন রঘুপতির দিকে। কৌতূহল জলের মীনের মতো সুরুত সুরুত করে আনাগোনা করছে তার চক্ষুদ্বয়ে। কৌতূহল দৃষ্টি চোখে ধারণ করেই সত্যবতী বললেন : এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?

সত্যবতীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব নরম স্বরে, খুব শান্তভাবে রঘুপতি জানতে চাইলেন, আহার হয়েছে?

কথাটির মধ্যে অসম্ভব একটা কামভাব ছিল, বুঝলেন সত্যবতী। অবদমিত কাম। হয়তো তাই তিনি তার চক্ষুদ্বয় সরু করে তাকালেন, বললেন, তোমাকে না-খাইয়ে কি কেউ অন্ন মুখে তোলে, কোনওদিন?

সত্যবতী সত্যি একদম কাছে চলে এসেছেন রঘুপতির! হাঁটার ছন্দে দুটি ভরাট সুডৌল ঊরু ফুটে ফুটে উঠছে, দুটি শাদা নিটোল দীর্ঘ হাতে ঝিকিয়ে উঠছে সোনার চুড়ি। তার হাতে তো আজীবন শুধু খয়ে যাওয়া দুটি স্বর্ণের চুড়ি। এই খয়ে যাওয়া চুড়ি দুটির ওপর দৃষ্টি পড়তেই রঘুপতির মনে হল : আপন গৃহকোণে যাদের আপনার বলে পেয়েছিলাম- বাবা, মা, ভ্রাতা, বৌদি- সকলই আজ যবনিকার অন্তরালে। সংসার-পথে চলতে চলতে পথের মাঝে নিবিড় সঙ্গ দিয়ে যে মানুষগুলো জীবনকে মধুময় করেছে, সংসার-পথের বাঁকে-বাঁকে তাদের অনেকেই বিদায় নিয়েছে। আজ সংসারের শত ঝঞ্ঝার মধ্যেও মনে হয়, যারা জীবিত আছে, তাদের মধ্যে সত্যবতী ছাড়া অন্যদের সঙ্গে অন্তরের বন্ধন শিথিল হয়ে গেছে। একথা ভেবেই রঘুপতি বললেন : ঠিক। তবে ঝড়-বাদলের দিনে ওরা কী অলস-চোখে অপেক্ষা করতে থাকবে! সকলের আহারের আয়োজন করো। কিছুক্ষণ উভয়ই চুপচাপ। তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঘরের প্রদীপের আলো নিভুনিভু করছে। হঠাৎ ঘাড় নেড়ে সত্যবতী জানালেন : তোমার সঙ্গে কিছু গূঢ় কথা ছিল। একটু পরামর্শও। তুমি একটু শুনবে? কণ্ঠস্বর শীতের কুয়াশার চেয়েও ভারী। রঘুপতি একবার আড়চোখে সত্যবতীর গম্ভীর বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকালেন। সহানুভূতিতে তার বুকের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে। অতি ক্ষীণস্বরে বললেন, অবশ্যই।

সত্যবতী খাটের পাশে থেকে রঘুপতির দিকে এগিয়ে এসে বলতে আরম্ভ করলেন, দময়ন্তীকে আর এখানে রাখা উচিত নয়।

রঘুপতি শিউরে উঠলেন। সত্যবতী যে একজন বুদ্ধিমতী নারী, এই বিষয়ে তার কোনও সন্দেহই কোনওদিন ছিল না। কিন্তু তার বুদ্ধির মাত্রা কতখানি উঁচু, সেটি একটু ভেবে নিয়ে, রঘুপতি ঘাড় নেড়ে ঈষৎ হাস্যে বললেন, কেন? কী হয়েছে?

সত্যবতীর হৃদয় একেবারে উপচে উঠল, বললেন, দময়ন্তীর রূপলাবণ্যের খ্যাতি এখন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। রঘুপতি জানেন, গৃহকর্ম নিপুণা সুশ্রী রমণীকেই তো বিয়ের পাত্রী হিসেবে সন্ধান করা হয়। অন্তত পাঁচজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারে সহজেই দময়ন্তী। সে গৃহ গুছিয়ে মানুষকে যত্ন করে, খাইয়ে-দাইয়ে সুখ পায়। তবে দময়ন্তী যে বিবাহোপযোগী হয়ে উঠেছে এমন কথা রঘুপতির চিন্তায় এর আগে আসেনি, এটি ভেবেই তার দুঃখ হ”েছ। আবার একইসঙ্গে গৌরব, উল্লাস ও হিম- এই ত্রিবিধ উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে গুরগুর করতে থাকে। অন্তরের গুরগুর যখন থেমে এল তখন রঘুপতি বললেন : দেখতে হবে না সে কার কন্যা! অত্যন্ত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে একবার রঘুপতির দিকে তাকিয়ে, তারপর মাথা ঘুরিয়ে অবজ্ঞার স্বরে বললেন সত্যবতী, এই কন্যা এখন যৌবনে উপনীত। তাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করা উচিত। একথা বলে আবার রঘুপতির মুখের দিকে তাকলেন সত্যবতী, তার মনে হল : রঘুপতি একটি ডোবা, চারদিকেই আঘাটা। তবুও বললেন : আচ্ছা, তার বিয়ের ব্যবস্থা করা কি অন্যায়?

সত্যবতীর পাশে এসে রঘুপতি দাঁড়ালেন। সত্যবতীকে তিনি নিজের কাছে টেনে নিলেন। তাদের চোখের সামনে প্রহৃত ও তাড়িত অন্ধকার দূর থেকে ক্রমেই দূরতর হতে থাকে। ক্রমে তাদের এই ছবিখানার ওপর ধূসর পরিবেশ আবরণ পরিয়ে দেয়। সত্যবতী একটু দূরে সরে গেলেন। রঘুপতি দ্বারের চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন : অন্যায় কেন হবে! তবে উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পাওয়া সহজ নয়।

একথায় সত্যবতী লাঞ্ছিত এক মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি একবার রঘুপতির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সর্ববিদ্যাবিশারদ চোন্তাইর মুখ চিন্তায় বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। দেখলেন, রঘুপতির গৌরবর্ণ মুখের ওপর প্রদীপশিখার আলো পড়ে কেমন ম্লান হয়ে আছে। তার প্রশস্ত ললাটের বাঁ-দিকে একটা এক-আঙুল-চওড়া চিন্তারেখা ঠিক ভুরুর নিচ থেকে শুরু করে সোজা মাথার চুলের ভেতর চলে গেছে। তার স্বভাববিষণ্ণ গম্ভীর মুখ কী একটা গভীর বেদনায় কাতর। কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর, সত্যবতী বললেন : উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান আমার কাছে আছে।

বীরদর্পে পা ফেলতে ফেলতে রঘুপতি বললেন, পাত্রটি কে?

তাড়াতাড়ি করে সত্যবতী বললেন, পুষ্কর আর দময়ন্তীর কী ভাব! এমনটি কি কেউ কোথাও দেখেছে! সত্যবতী আড়চোখে দেখে নিলেন, রঘুপতির মুখে যে এক-আঙুল-চওড়া চিন্তারেখা ফুটে উঠেছিল, তা এখন যন্ত্রণার রেখায় পরিণত হয়েছে, তা রঘুপতির অক্ষমতারই প্রতিবিম্ব। তার চোখ দুটি ছলছল করছে। এই দৃশ্য সত্যবতীর চোখে নতুন নয়। মানুষের পরিবার- মা-বাবা-ভাই-বোন- রক্তের সম্পর্ক মেনে নির্মিত হয়। বাইরে থেকে যে রমণীটি স্ত্রী হয়ে আসে, পুরুষকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করার প্রক্রিয়া দিয়ে সে রক্তে রক্ত মেশায়, কিন্তু জীবনকে বিরাট ও সনাতন বলে দেখতে গেলে বোঝা যায় সকল সমর্থ পুরুষই পিতা, সকল নারীই মাতা এবং সকল বালক-বালিকাই সমস্ত মানুষের পুত্র-কন্যা। তাদের মধ্যে এই গূঢ় অনাদ্যন্ত সম্পর্ক কখনও কখনও দুর্ঘটনাচক্রে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। রক্তের সংকেত তখন সে অগ্রাহ্য করে, আর তখনই ভবিষ্যৎ কালের, আরও সুসভ্য সুসংগত সমাজের সূচনা হয়। তাই যখন রঘুপতির মগজে চিন্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আরও বেড়ে চলেছে, ধীরে ধীরে তিনি ডুবে যাচ্ছেন যতদূর চিন্তা যায় ততদূর, তখন সত্যবতীর সংকেতটা তিনি বুঝে ফেলেন। তাই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে রঘুপতি বললেন : আরে তা হওয়ার নয়, দুইজনে ভ্রাতাণ্ডভগিনীর মতো একসঙ্গে মানুষ হয়েছে। এমন কথা ইতঃপূর্বে বহুবার শুনেছেন সত্যবতী এবং প্রতিবারই তার মনে হয়েছে যে, এই বীভৎস লোকটির পরিবর্তে যদি আর কেউ তার জীবনে আসত! মানুষের জীবনে অনেক অমানুষেরও অংশ থাকে তা সত্যবতী জানেন, যেমন : গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার, পাখি, পোকা, জীবাণু। এগুলো প্রত্যক্ষ। সম্পর্ক নির্ণয় করা সহজ। গাছপালা ছায়া দেয়, ভূমি সংরক্ষণ করে, ফল-ফুল শস্য দেয়। প্রধান প্রধান খাদ্যবস্তু উদ্ভিদ থেকেই আসে। গৃহপালিত জন্তু থেকে দুধ মাংস পরিবহণ পাওয়া যায়। বনের জন্তু-জানোয়াররা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। পাখি পোকাণ্ডমাকড় খেয়ে-দেয়ে জঞ্জালমুক্ত করে; কেউ কেউ মাংস এবং ডিম দেয়, মানুষের আহারের জন্য। জীবাণু ভালো আছে, মন্দও আছে। কিন্তু মানুষের জন্যই তারা যে সৃষ্টি হয়েছে একথা সত্যি নয়; কারণ, মানুষ সৃষ্টি হওয়ার আগেই গাছপালা, জন্তু-জানোয়ার, পাখি, পোকা, জীবাণু ছিল। আর রঘুপতি? তিনি তো সত্যবতীর জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ, তবুও তিনি ধাতুর তৈরি একজন অমানুষ। এই অমানুষটির কাছে সত্যবতী এক শক্তিহীন মানুষ। এই চিন্তা তার মনকে আঁকড়ে ধরে তাকে এমন পীড়া দিতে থাকে যে, তিনি মনে-মনে অস্থির হয়ে উঠলেন। এই অস্থিরতা নিয়েই বললেন, তবুও যদি একবার ভেবে দেখতে! চলবে

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত