বকুল পুষ্পর শীতকাল
ফারুক আহম্মেদ জীবন
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কু ঝিক ঝিক... কু ঝিক ঝিক... কু...ঝিক ঝিক...
বাজনা তুলে যশোরের রেলগেট থেকে আঁকাবাকা রেলের লোহার পাটি ধরে বাতাসের বেগে ছুটে চলেছে ট্রেনটি। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে। সেই ট্রেনের ছোট্ট একটা বগিতে মা- লতার কোলে শুয়ে আছে দুই বছরের মেয়ে পুষ্প। পাঁচ বছরের ছেলে বকুল, মায়ের পাশে শুকনো মুখে ওর মাকে ধরে বসে আছে।
লতার দুটি চোখেমুখে কেবলই হতাশা আর দুঃশ্চিতার ছাপ। বগির জানালা দিয়ে ঝড়ের বেগে বাতাস আসছে। তবুও ঘামছে লতা। বার বার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুখের সে ঘাম মুছছে লতা। নানান দুঃশ্চিন্তা তার মনের মধ্যে আর মাথায় ভর করেছে। কি করবে সে! যদি শহরে গিয়ে লতা ওদের বাবাকে খুঁজে না পাই? মেয়ে পুষ্পের জন্মের পর, সংসারে প্রচন্ড অভাব দেখা দিলে। লতার স্বামী কথা। উপার্জনের জন্য বউ ছেলেমেয়েকে রেখে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে রিকশা চালিয়ে প্রতি মাসে কমবেশি টাকা পাঠাতো সংসার খরচের জন্য কথা।
সেই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো রকম ডালভাতে চলছিল লতার সংসারটি। মাঝেমধ্যে মোবাইলে কথাবার্তা হত ছেলেমেয়ে আর লতার সাথে লতার স্বামী কথার। এরমধ্যে একবার বাড়িতেও এসেছিল কথা। ছেলে-মেয়ের জন্য কিছু খেলনা। বউ লতার জন্য একটা টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। আর সংসারের জন্য টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে। দুই-একদিন বাড়ি থেকে আবার শহরে চলে যায় লতার স্বামী কথা। যাওয়ার সপ্তাহ খানিক পর কথা একবার মোবাইল করেছিল বাড়িতে বউ লতার কাছে। তারপর গত ছয়মাস আর স্বামীর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি লতা। তার দেয়া নাম্বারে কল দিলে বলে। সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে। হতাশ হয়ে মোবাইল মুখো তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে লতা। সে নিঃশ্বাসে কতো যে কষ্ট লুকানো তাণ্ড বুঝি কেবল সৃষ্টি কর্তাই জানে।
লতা তার ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে পরের বাড়ি বাড়ি কাজ করে এই ছয়মাস খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে খুব কষ্টে কালযাপন করছে। অবশেষে সে তার স্বামীর খোঁজে শহরে যাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে। লতার শেষ সম্বল বাড়ির কয়েকটা পোষা হাঁস মুরগি। সেসব বিক্রি করে শহরে যাওয়ার খরচ গুছিয়ে কোলের সন্তানদের নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। সে তার স্বামীর মুখে শুনেছে তার স্বামী কথা গুলশান বনানীর কোল ঘেষে। যে কড়াইল বস্তিটি রয়েছে সেখানেই সে থাকে। অন্য মনস্ক হয়ে এইসব ভাবছিল লতা। হঠাৎ! ছেলে বকুলের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো লতা। বকুল বললো...মা, আমার না...খুব ক্ষিদে লেগেছে। লতা বকুলের মাথায় মায়ার হাতটি বুলিয়ে। সাথে রাখা ব্যাগ থেকে জলের বোতল আর টুপলা থেকে কিছু শুকনো চিড়ে বের করলো। তারপর জলের বোতল বকুলের হাতে দিয়ে বললো...এই নে বাবা বকুল, চিড়ে আর পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ কর।
ঢাকায় তোদের আব্বুর কাছে গেলে দেখবি। তখন তোদের আব্বু তোদের দেখে কতোকিছু কিনে আনবে। তখন মাছ গোস্তো দিয়ে পেট ভরে খেতে
পারবি। বকুল বললো...সত্যি মা? তখন পেট ভরে
খেতে পারবো? লতা বললো...হ্যাঁ বাবা, তখন পেট
ভরে খেতে পারবি। বকুল হাসি মুখে মায়ের হাত
থেকে চিড়ে জল নিয়ে খেলো। তার ঘণ্টা খানেক
পর ট্রেনটি পৌঁছালো ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে। সকলের মতো লতা মেয়ে পুষ্পকে কোলে নিয়ে। ছেলে বকুলের হাত ধরে ট্রেন থেকে ধীরেধীরে নিচে নামলো। অচেনা শহর। ঢাকার কোথাও কিছু চেনে না লতা। এই প্রথম সে ঢাকার শহুরে পা রেখেছে। লোকজনের পাছে জিজ্ঞাসা করলো বনানীর কড়াইল বস্তি কোনদিকে? লোক-
জন লোকেশন বলে দিলো। লতার কাছে তেমন টাকাকড়িও নেয়। যে, ভান রিকশা কিম্বা অটোই যাবে। আর তাই, কোনো গাড়িতে না উঠে বনানীর কড়াইল বস্তির উদ্দেশ্য পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিল। সেখানে পৌঁছে অনেকের কাছে তার স্বামী কথা কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করলো। কিন্তু কেউ কথার সন্ধান দিতে পারলো না। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখন লতা কোথায় যাবে? দু, চোখে যেনো অন্ধকার দেখছে লতা। অবশেষে নুর নামের একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো...আপনি কি হন কথার? লতা বললো, কথা আমার স্বামী। আর বকুল পুষ্পকে দেখিয়ে বললো..এ দুটো আমাদের ছেলেমেয়ে। নুরের দুটি চোখে জল। লতা বললো..আপনার চোখে জল কেনো? কি.. কি হয়েছে কথার? কিছু বলুন? নুর কাঁদতে কাঁদতে বললো...কথা আর বেঁচে নেই। বোন। লতা বললো..কি...কি...বললেন? না..না..না
এ হতে পারে না। আমার স্বামী কথা আমাকে ছেড়ে, ছেলেমেয়েদেরকে ছেড়ে...না...না...আপনি মিথ্যে বলছেন। তারপর ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। নুর বললো...হ, বোন
আমরা একসাথেই রিকশা চালাইতাম। তারপর
কল্পনায় বললো...সেদিন রাতে ও আমার আগেই
বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। পথে
হঠাৎ! অ্যাক্সিডেন্ট করে। এমনভাবে পরিবহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, চেনার উপায় ছিল না। আর আমিও ওর বাড়ির ঠিকানা জানতাম না।
আর তাই ওর লাশ আপনাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। লতা নির্বিকার, পাথর হয়ে গেছে যেনো। নুর বললো...এতো রাতে বাচ্চা
দুটো নিয়ে কোথায় যাবেন বোন? তারচেয়ে আমার
সাথে চলুন। লতা বললো...না ভাই। আমরা রাতের
ট্রেন ধরেই গ্রামে চলে যাবো। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও লতা গেলো না। অবশেষে নুর চলে গেলো। লতা বাচ্চা দুটোকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো..
কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে
গেলো লতা রোডের পাশে। বকুল পুষ্প কাঁদছে...
তাদের মাকে ধরে। বিধির লীলাখেলা যে বুঝা বড় দ্বায়। একটু পরেই মুখ দিয়ে গেজলা উঠছে। কিছুক্ষণ পর ওদের মাও চলে গেল চিরদিনের জন্য বকুল পুষ্পকে ছেড়ে। আশপাশের লোকজন বকুল পুষ্পের কান্নাকাটির শব্দ শুনে এক-দুই জন করে রাস্তার আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলো। কেউ কেউ বলতে লাগলো আহারে...এখন এই বাচ্চা দুটোর উপায় কি হবে? দশের কাছ থেকে টাকা তুলে দাফন করা হলো লতার লাশ। বকুল দুই বছরের ছোট বোন পুষ্পকে নিয়ে পথে পথে ঠোকর খেতে লাগলো। কোনো দোকানে খাবার চাইতে গেলে কেউ আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দূর দূর করে বের করে দেয়। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মানুষের বাসী এঁটো ঘাটা ডাস্টবিনের দুর্গন্ধময় পঁচা আবর্জনা পূর্ণ খাবার খেয়ে কোনো রকমে আজ বকুল পুষ্পের জীবন কাটে। প্রখর গ্রীষ্ম, বর্ষা, হাড়কাঁপানো পৌষের প্রচন্ড শীতে বকুল পুষ্প পড়ে থাকে হাই-ওয়ের ফুটপাতের ধারেতে। আজ আর ওদের মাথায় তেল জোটেনা।
চিরুনি দিয়ে মাথার চুল আঁচড়ায়ে দেওয়ারও কেউ নেই। ময়লা ধুলোবালি ভর্তি উষ্কখুষ্ক মাথার চুল। ছিঁড়া ছুটো ধুলো ময়লা ভর্তি জামা-কাপড় ওদের গায়ে। ওরা জানে না, ওদের দেশের বাড়ি কোথায়? ওরা দু, ভাই বোন বকুল আর পুষ্প সমাজের মানুষের চোখে এখন যে কেবলই শুধু ফুটপাতের টোকাই শিশু। এই শীতের রাতে বরফগলা হিম শিশির ঝরা খোলা আকাশের নিচে। গরম কাপড়ের অভাবে বড়ই যে দুর্বিষহ জীবন কাটে এখন বকুল পুষ্প নামের ছোট্ট ছোট্ট দুটি ছেলেমেয়ের।