নাট্যোপন্যাস (পর্ব ৫)
রাজাবলি
ড. মুকিদ চৌধুরী
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
=একথা শুনেই রঘুপতি একটু হকচকিয়ে গেলেন। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সেই ভরসা তেমন একটা দিতে পারি না।
রঘুপতি সমস্ত কিছু উপলব্ধি করেন, আর তাই হয়তো একথা বলে একটু হাসলেন। এই হাসিতে বিদ্রুপ কতটুকু প্রসন্ন তা বুঝতে পারলেন না সত্যবতী, কিন্তু বেদনা যে নিহিত তা বুঝতে তার অসুবিধে হল না। হয়তো তাই সত্যবতীর ঠোঁটের ফাঁকে বেরিয়ে এল : আমি সবই জানি, তবুও মায়ের মন, দময়ন্তী ওকে খুব ভালোবাসে।
মহাবিপদের ইঙ্গিতে রঘুপতির হৃদয় শঙ্কিত হয়ে উঠল। ইত্যবসরে মিনমিন করে বললেন, সমস্যা একটা আছে। আর তা হল, এইমুহূর্তে আমার একেবারেই ইচ্ছে নেই, দময়ন্তীকে শীঘ্রই বিয়ে দিই।
সত্যবতী মনের মধ্যে একটা তীক্ষè বেদনা অনুভব করলেন। বললেন, তা তো জানি, কিন্তু জানো তো, দময়ন্তীর একটু বাড়ন্ত গড়ন, তাই অনুরোধ করছি যদি পুষ্করকে...
দময়ন্তী-পুষ্কর ব্যাপারটির মধ্যে কোনওরকম অস্বাভাবিকত্ব বা আতিশয্য আছে বলে সত্যবতী ধারণাই করতে পারছেন না। সত্যি কথা বলতে কী, এই ব্যাপারটির সঙ্গে রঘুপতির চরিত্রের এমন কোনও সামঞ্জস্যতা নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অসামঞ্জস্য কণ্ঠে রঘুপতি বললেন : না, একথা আমি ভাবতেই পারি না। পুষ্করকে কোনওমতেই বলতে পারব না। এই বিয়ের কথা পাড়লে পুষ্কর কি আমার মুখ দেখবে? সে সমাজের কথা ভাবে। এমন প্রস্তাবে সে কখনও রাজি হবে না।
সত্যবতীর ভেতরে জাল বুনে যাচ্ছে, অভ্যস্ত চিন্তার জাল। মন চিন্তা ছাড়া থাকতে পারে না! রঘুপতিকে তিনি আজও চিনতে পারছেন না, তার মন বড় অদ্ভুত-উনুনের আলোর মতো-হাঁড়ির নিচই আলোকিত করে, ভেতরটা অতল অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে। ব্যথিত চিত্তে সত্যবতী বললেন : আমি তাহলে রান্নাঘরেই যাই। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
রঘুপতি ফিসফিস করে বললেন, সাবধানে যেয়ো, আকাশের যা অবস্থা!
বারান্দায় বেরিয়ে এলেন সত্যবতী। তার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। মুখে-মুখে উত্তর দেয়ার মতো উপস্থিত বুদ্ধি সত্যবতীর জোগায় না সবসময়। পরে জবাবটা ধরা দেয়। সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এসে তিনি আবার রঘুপতির কাছে ফিরে এলেন। চৌকাঠের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন : রাজা ও প্রজার হৃদয়ের ভালোবাসার কোনও তফাত হয় না, চোন্তাই। তুমিও তো একজন রাজপুত্র, কিন্তু ঘর করছ একজন সাধারণের সঙ্গে।
একটু অপ্রস্তুভাবে মাথায় ডান-হাতটি বুলিয়ে নিলেন রঘুপতি। দু-একটা পাকাচুল বিপর্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। একজন ভারীগলার রাশভারী লোক রঘুপতি বললেন : তোমার মতো তো আর সব্বাই হয় না। তুমি ব্যতিক্রম বলেই তো আমি বেঁচেবর্তে আছি। আসলে, সত্যবতী, মন গুণে ধন। যা-ই হোক, তুমি রান্নাঘরে যাও। ও হ্যাঁ, আমার হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে দিয়ে যেয়ো, কলতলা থেকে একবার ঘুরে এসে নিভিয়ে নেব।
হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রঘুপতির হাতে তুলে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ধীরেসুষ্পে নেমে গেলেন সত্যবতী, অন্ধকারের মধ্যে। রঘুপতি দাঁড়িয়ে রইলেন হ্যারিকেন হাতে আরো মুহূর্তকয়েক। সত্যবতীর ছোটখাটো মূর্তিটি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল রান্নাঘরের ভেতর।
হাওয়াটাও কমে এসেছে। গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির জল এখন শব্দ করে ঝরে পড়ছে মৃত্তিকায়। একটি বেড়াল বোধহয় শব্দ তুলে বাসকপাতার ঝোপে ঢুকে পড়েছে। হয়তো পার হয়ে যাচ্ছে নির্জন- মনুষ্য-সংসারের পাঁচিলে আলসেয় ঘোরাফেরাই তার স্বাস্থ্য বজায় রাখা। নেড়ি কুকুর তুরতুর করে দৌড়ে গেল শুকনো পাতায় খড়খড় শব্দ তুলে। বেড়াল, কুকুর, ইঁদুর, ফড়িং- সব জীবলীলা অবাধে চলতে থাকে এই আশ্রমের মধ্যে। এইসব জীবনের চলাচল, শব্দবর্ণগন্ধ- সবই রঘুপতি উপলব্ধি করতে পারেন, কিন্তু তার কাছে কোনও কিছু চেয়ে কেউই আসে না। বাসকপাতার কাছে হয়তো প্রাণীর প্রার্থনা আছে, কিন্তু রঘুপতির কাছে নেই কোনও প্রত্যাশা, কোনও প্রার্থনা এবং এটি রঘুপতির এক রহস্যময় অহেতুক ভয়ও বটে। বড্ড নিঝুম এই পরিবেশ, তবুও রঘুপতির মনটা একটু চঞ্চল। একটি বিদ্যুৎস্পর্শ করে গেল তাকে। তার সমস্ত সত্তার একমুখী স্রোত দুরন্ত এক গতিতে তার দিকে ধাবমান। উজান বেয়ে চলার শক্তি তার আর নেই। রঘুপতির অভ্যন্তর ভেসে যাচ্ছে এক অমোঘ নিয়তির নির্দেশে। তার বুক ব্যথায় চিনচিন করছে সত্যবতীর কথা ভেবে। কিন্তু তার অভ্যন্তরের বুদ্ধিমান, বিবেচক ও প্রজ্ঞাবান চোন্তাই তাকে সাবধান করে দিচ্ছে।
রান্নাঘরে পৌঁছে সত্যবতী তার কষ্টলঘু করার জন্য আহার সাজাতে থাকেন। এই কাজে ব্যস্ত থাকায় একটা অখণ্ড শান্তি তৈরি হয় তার মনে- কোনো দুঃখ নেই, চিন্তা নেই, সমস্যা নেই। ‘মা’ যদি সত্যিই থাকেন তাহলে তার মধ্যে নিশ্চয়ই এইরকম প্রসন্নতা বিরাজ করে। প্রশান্তির একটি শ্বাস নিলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনলেন : মা।
দময়ন্তীর ‘মা’ ডাকে সত্যবতীর মুখেচোখে এক অদ্ভুত অপার্থিব তৃপ্তি নেমে এল। চোখ দুটি কী গভীর স্নেহে, করুণায় ছলছল করছে। সত্যবতী মাতৃসম্বোধনে সহসা কেমন হয়ে গেলেন। তিনি কিছুক্ষণ আহার সাজানোর কাজ ভুলে গেলেন, শুধু চোখ দুটি প্রসারিত করে রাখলেন দময়ন্তীর মুখের ওপর। তার অপার্থিব তৃপ্তি তার অন্তরে গলে গলে পড়তে থাকে। কিছুক্ষণ সত্যবতী কোনও কথা বলতে পারলেন না। এই নীরবতার অর্থ অনুধাবন করার সময় পায় দময়ন্তী। মায়ের ভাবান্তরে তার বুকের ধকধকানিটা শুরু হয় একসময়। বুঝতে পারে, সত্যবতী তাকে কিছু বলতে চাইছেন। এক অপ্রতিরোধ্য স্নেহের প্লাবন তাকে শুধু সত্যবতীর কাছেই টানতে থাকে। সে জানে, তার মায়ের স্বভাব এমনই যে, তিনি শুধু নিজের জন্য কিছু করার উৎসাহ পান না। দময়ন্তী তার ব্যতিক্রম হতে পেরেছে কি? মায়ের নিজের বলতে কি কিছুই নেই! মাথা থেকে মানুষটির যেন পটপট করে দুশ্চিন্তা ঝরে পড়ছে। মায়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই দময়ন্তী বলল : মা, তুমি ওঠো, আমি আহার পরিবেশন করছি। একথা শুনে হঠাৎ আবার সত্যবতী খুব ক্লান্তি বোধ করলেন। আহার সাজানোর কাজটি অসমাপ্ত রেখে ক্লান্তির হাতেই নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই নেই এখন। এখন তার মাথার মধ্যে কি”ছু নেই। এত অবসন্ন, প্রায় অসহায় তার কখনও লাগেনি। তিনিও কি জীবনভর এক অন্তর্নিহিত নাটকের মধ্যে ভেসে চলেছেন? নিজের ওপর মা-মেয়ের চিন্তার ভার তুলে নেননি কি? খয় তো ভেতরে ভেতরে চলছেই। কাজ না-থাকলে এই অনুভূতিটা তাকে চেপে ধরে ভীষণভাবে। সত্যবতী উঠে যাওয়ার পর দময়ন্তী বলল, তুমি এত চিন্তা করছ কী নিয়ে? তোমার থমথমে ভাবটা গেল না। অনেক ভেবেচিন্তে সত্যবতীর মনে হল : তিনি আসলে চিন্তা ছাড়া থাকতে পারেন না। ঘুরছেন, ফিরছেন কিন্তু মগজটা কিছু ব্যাখ্যা, কিছু-একটা বিষয় নিয়েই ভেবে চলে। এই প্রক্রিয়াটা ভেতরে ভেতরে চলেই। শরীরের মধ্যে যন্ত্রগুলো তার বিগড়ে বসে। তাকে এক শীতার্ত পাহাড়ে রেখে চলে যায়- তার মানসিক ক্ষমতা। তাই তিনি শিথিল, ইচ্ছাশক্তিহীন অসহায়।
দময়ন্তী বলল, এত ভেবে কী লাভ বলো তো, মা?
একমাত্র সন্তানই পারে মায়ের চিন্তিত মনকে একটু হলেও আনন্দ দিতে। বাঘিনী কীরকম শাবকের সঙ্গে খেলা করে। মা হস্তি কচিগুলোকে নিয়ে কেমন পেরিয়ে যায় অরণ্য। এ-ই স্বাভাবিক। প্রকৃতি শিশু দিয়েছে মায়ের হৃদয়ে স্নেহ ও করুণা জাগিয়ে তোলার জন্য। ধূমকেতুর মতো দময়ন্তীর প্রশ্নটি সত্যবতীকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে নিয়ে এল, বললেন : সত্যি, সত্যিই তুই একটুও বদলালি না। পাগল মেয়ে আমার! আমার চিন্তা নিয়ে কৌতুক করতে নেই। শত্রুর অভাব নেই। কার মনে কী আছে, কে জানে? মায়ের কৌতুক দময়ন্তী বুঝল, হাসল, তারপর স্নিগ্ধস্বরে বলল, তোমার সন্তান আমি। বদলালে কি হয়! সত্যবতী একটু অপ্রতিভ বোধ করতে লাগলেন। বললেন, অবশ্যই তুই আমার সন্তান, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে, আমার-যে স্বস্তিতে তৃপ্তি নেই!
হঠাৎ সত্যবতীর এমন কথায় দময়ন্তীর বুকের ভেতরটা ধুকধুক করে উঠল। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে, তারপর জানতে চাইল : কী হয়েছে তোমার, মা?
সত্যবতী তার কন্যার চোখে চোখ রেখে বিবশ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বুকভরা ভয়, উৎকণ্ঠা, দ্বিধা, মাথায় এলোমেলো সহস্র চিন্তা। ক্ষীণ গলায় বললেন : না, তেমন কিছু না। শুধু ভাবছি, তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি বড্ড একা হয়ে যাব!
দময়ন্তীর সারা শরীরে শিহরন বয়ে গেল, তারপর ভুরু কুঁচকে, মায়ের শ্রীময়ী মুখখানি দেখে নিয়ে, একটি সুন্দর হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি কোথাও যাব না। তোমার কাছেই থাকব। (চলবে)